নজরুল জীবনে দুঃখ ফজিলাতুন্নেসা


প্রকাশিত: ০২:১২ এএম, ২৭ মে ২০১৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে নজরুল ইসলামের পরিচয় ঘটে ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে, ১৯২৮ সালে দ্বিতীয়বার কবির ঢাকা সফরের সময়। এই পরিচয় কবির দিক থেকে ক্রমে পরিণয়ের দিকে ধাবিত হলেও ফজিলাতুন্নেসা সাড়া দেন নি। ব্যাকুল কবি ফজিলাকে নিয়ে একের পর এক গান-কবিতা লিখতে লাগলেন। বন্ধু মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে চিঠি লিখে ফজিলার খবরাখবর জানতে চাইতেন। কবির এই উদ্বেগাকুলতা দেখে মোতাহার হোসেন এক সময় প্রমাদ গুণলেন। কিন্তু নজরুল দমার পাত্র নন। ফজিলাতুন্নেসার অব্যাহত উপেক্ষার প্রেক্ষাপটে কবি বেশ কিছু কবিতা-গান রচনা করেন।

তার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য দীর্ঘ কবিতা ‘এ মোর অহঙ্কার’। এতে কবি প্রিয়াকে না পাওয়ার বেদনাধারা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘নাই বা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার/তোমায় আমি করব সৃজন, এ মোর অহঙ্কার।/ এমনি চোখের দৃষ্টি দিয়া/তোমায় যারা দেখল প্রিয়া/তাদের কাছে তুমি তুমিই। আমার স্বপনে/তুমি নিখিল রূপের রাণী মানস-আসনে! ...।’

আদি ঢাকার বনেদীপাড়া বনগ্রামের অধিবাসী ছিলেন রানু সোম। সুমিষ্ট কণ্ঠের জন্য ১৩ বছর বয়সেই গান গেয়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ রায়ের কাছে প্রথম তার নজরুল গীতির হাতেখড়ি। ইতোমধ্যে ক’খানা গ্রামোফোন রেকর্ডও বেরিয়ে গেছে। কলকাতায় নজরুল দিলীপ রায়ের কাছেই ঢাকার মেয়ে রানু সোমের কথা প্রথম জানতে পারেন। পরবর্তী জীবনে রানু সোম কবি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং প্রতিভা বসু নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে ঢাকায় এসে কাজী মোতাহার হোসেনের সহায়তায় ঠিকানা খুঁজে নিজেই একদিন নজরুল উপস্থিত হন রানুদের বাড়িতে।

প্রথম সন্ধ্যায় গুরু দর্শনের রেশ কাটিয়ে না উঠতেই কিশোরী প্রতিভা পরের সকালে পুনরায় চমকিত হলেন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে। দরজায় তখন দাঁড়িয়ে নজরুল ইসলাম। হাসতে হাসতে বললেন, ‘এসে পড়লাম বুঝলে? বেলা বাড়তে দিলে কি আর উপায় আছে? সব ছেলেরা ঠিক ভিড় করবে, ধরে নিয়ে যাবে কোথাও। এখান থেকে ফিরে গিয়ে কাল রাত্তিরে একটা গান লিখেছি, এক্ষুণি শিখিয়ে দিতে হবে। নাও, নাও, শিগগির চা খেয়ে নাও। আবার ভুল হয়ে যাবে।’

সেই সাত সকালেই শুরু হয়ে গেলো প্রতিভার গান শেখার পালা। রাতের লেখা গানটি তুলতে লাগলেন কবি ..... ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী এ কোন সোনার গাঁয়/আমার ভাটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায়।’

প্রতিভা জানাচ্ছেন, ‘এই গানটি লিখেছেন রাতে। দেখা গেলো তখনো তার বয়ান ও সুরারোপ সম্পূর্ণ হয়নি, আমাকে শেখাতে শেখাতেই বাকিটা ঠিক করে নিলেন। পকেট থেকে কলম বেরুলো, কাটাকুটি কাগজ বেরুলো, গলা থেকে সুর বেরুলো, গানে সম্পূর্ণতা এলো। দিন তিনেক বাদে আর একটি গান তৈরি হলো, ‘এত জল ও কাজ চোখে পাষাণী আনলে বল কে।’

যখন গানে বসতেন অবিশ্রান্ত চা খেতেন বলে আমার মা মাঝে মাঝেই অপ্রত্যাশিতভাবে এককাপ চা এনে দিতেন হাতে, আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠতেন, ‘নাহ তোমার মতো মেয়ে হয় না’- সেদিন গেয়ে উঠলেন, ‘এতো চা ঐ পেয়ালায় এমন করে আনলে বলো কে? এইটুকু থেকেই পরের দিন ওই গান রচিত হয়ে এলো।’

এভাবেই নজরুলের কাছে রানু সোম ওরফে প্রতিভা বসুর গান শেখার পালা শুরু। এ যাত্রায় নজরুল প্রায় মাস খানেক ঢাকায় থাকেন এবং প্রায় প্রতিদিনই রানুকে গান শেখাতে তাদের বনগ্রামের বাসায় যেতেন। এমনই এক গানের জলসায় ১৩৩৫ সনের ৭ আষাঢ় রানুদের বাড়িতে বসেই ‘শ্রীমতি রানু সোম কল্যাণীয়াসু’ কে উদ্দেশ্য করে লিখলেন, ‘মাটির ঊর্ধ্বে গান গেয়ে ফেরে/ স্বরগের যত পাখি/ তোমার কণ্ঠে গিয়াছে তাহারা/ তাদের কণ্ঠ রাখি’।/ যে গন্ধর্ব-লোকের স্বপন/ হেরি’ মোরা নিশিদিন/ তুমি আনিয়াছ কণ্ঠ ভরিয়া/ তাদের মুরলী বীণ।/ তুমি আনিয়াছ শুধু সুরে সুরে/ ভাষাহীন আবেদন/ যে সুর মায়ায় বিকশিয়া ওঠে/ শশী তারা অগণন।/ যে সুরে স্বরগে স্তব-গান গাহে/ সুন্দর সুরধুনী/ অসুন্দর এই ধরায় তোমায়/ কণ্ঠে সে গান শুনি।’ ‘কবিতা’।

রচনার দীর্ঘ ষোলো বছর পর ‘কবিতা’ পত্রিকার নজরুল সংখ্যায় প্রথম এ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশকাল কার্তিক-পৌষ ১৩৫১। এটি ঢাকার বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী নতুন সংস্করণের তৃতীয় খণ্ডে গ্রন্থিত হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় যে, ১৩৩৫ এর ৭ আষাঢ় উক্ত কবিতাটি রচনার পরের বছর ১৩৩৬ এর অগ্রহায়ণে কলকাতার ডি.এম. লাইব্রেরি কবির ‘চোখের চাতক’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করে। এটি কবি প্রতিভা বসুকে উৎসর্গ করে ‘উৎসর্গ-পত্রে’ লিখেছেন, ‘কল্যাণীয় বীণাকণ্ঠী/ শ্রীমতি প্রতিভা সোম/ জয়যুক্তাসু।’

১৯২৮ সালটি নজরুল ইসলামের জীবনে নানা কারণে বৈচিত্রময়। এ বছর ঢাকায় কবির সঙ্গে তিন গুণী তরুণীর ঘনিষ্ঠতা হয়। এদের প্রথম দু’জন ফজিলাতুন্নেসা ও রানু সোম (প্রতিভা বসু)। যাদের কথা ইতোমধ্যেই বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় জন উমা মৈত্র। উমার পিতা অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র ছিলেন ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল। তিনি খুব ভালো কবিতা লিখতেন। গান এবং সনেটও লিখে ছিলেন বেশ কিছু। ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীতও গাইতেন। তার স্ত্রীও ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট এবং ছবি আঁকাসহ ভালো পিয়ানো বাজাতেন। তাদের একমাত্র মেয়ে উমা মৈত্র, ডাক নাম ‘নোটন’। এই গুণী তরুণীও একাধারে ছিলেন সুন্দরী-বিদূষী এবং সেতার বাজাতে সিদ্ধহস্ত। তার ওস্তাদ ছিলেন বিখ্যাত সেতারী হায়দার আলী। ভালো ছবিও আঁকতেন নোটন। টেনিস ও দাবা খেলাতেও ছিলেন পারদর্শিনী। সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা না পেলেও অথবা এ বিষয়ে আগ্রহী না হলেও নজরুল ইসলাম ও দিলীপ কুমার রায়ের গানের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে সেতারে সঙ্গত করতেন।

নোটনের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন বিলাতী ধাঁচের ব্রাহ্মণ, বন্ধুবৎসল ও উদার মনের অধিকারী। দেশের বিখ্যাত সব শিক্ষাবিদ, শিল্পী সাহিত্যিকরা ছিলেন এদের পারিবারিক বন্ধু। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দাবাড়ু কাজী মোতাহার হোসেন, গণিতের অধ্যাপক বঙ্কিমদাশ ব্যানার্জী প্রমুখ। সেই সুবাদে নজরুল ইসলামও হয়ে উঠেছিলেন মৈত্র পরিবারের একজন অকৃত্রিম বন্ধু। হিন্দু-মুসলমানের কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিলো না ওই পরিবারে। উভয় ধর্মের গুণী মানুষরাই পরিবারটির সজ্জন ব্যবহার ও উষ্ণ অভ্যর্থনা পেতেন।

উমা মৈত্র ওরফে নোটন ছিলেন অভিজাত ব্যক্তিত্ব ও শান্ত স্বভাবের ‘অপূর্ব সুন্দরী’ রমণী। অধ্যাপক মোতাহার হোসেন একে ‘কাব্য প্রেরণাদায়ী আনন্দের নির্ঝরিণী’ ‘Phantom of delight’ রূপে মন্তব্য করেন। নজরুল সে যাত্রায় নোটনকে বেশ কিছু গান শেখান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান হচ্ছে, 

১. ‘নিশি ভোর হ’ল জাগিয়া/ পরান-প্রিয়া।/ কাঁদে ‘পিউ কাহা’ পাপিয়া/ পরান পিয়া’
২. ‘আজি এ কুসুম-হার/ সহি কেমনে।/ ঝরিল যে ধুলায়/ চির-অবহেলায়/ কেন এ অবহেলায়/ পড়ে তা’রে মনে’
৩. ‘বসিয়া বিজনে/ কেন একা মনে/ পানিয়া ভরণে/ চললো গোরী।/ চল জলে চল/ কাঁদে বনতল/ ডাকে ছলছল/ জল-লহরি’

বাংলা সঙ্গীতের জগতে সমকালে এই গানগুলো বহুল প্রচারিত হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ ধরনের আরো বহু বিখ্যাত গানে নোটনের সঙ্গে নজরুল সেতারে সঙ্গত করেন।

গান শেখাতে ও শোনাতে গিয়ে নজরুল কি নোটনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে ছিলেন? ভালোবেসে ফেলেছিলেন নোটন ওরফে উমা মৈত্রকে? এ প্রশ্নের উত্তর মেলা ভার। কিন্তু যখনই নজরুলের জীবনে নারীর প্রসঙ্গ এসেছে বা কবি জীবনের প্রেমের অধ্যায় আলোচিত হয়েছে তখনই নার্গিস-প্রমীলা-ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে উমা মৈত্রের নামও উচ্চারিত হয়েছে।

ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন তার একাধিক প্রবন্ধ-রচনায় নোটন তথা উমা মৈত্রের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তার এই উদ্ধৃতি পরবর্তীতে নজরুল গবেষণায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রায় সব নজরুল গবেষকই নোটন প্রসঙ্গকে গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করেছেন। যদিও নার্গিসকে, প্রমীলা বা ফজিলাতুন্নেসাকে যে ভাষায় কবি প্রেম নিবেদন করেছেন- উমা মৈত্রের ক্ষেত্রে সে ভাষা বা অনুভূতি প্রকাশের কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া না গেলেও ‘গানের আড়াল’ কবিতাটি উমার প্রতি কবির দুর্বলতাকেই অনেকাংশে প্রকাশ করেছে। ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থে পরবর্তীতে কবিতাটি সঙ্কলিত হয়েছে। উদ্ধৃতি বিবেচ্য, ‘তোমার কণ্ঠে রাখিয়া এসেছি- মোর কণ্ঠের গান-/ এইটুকু শুধু রবে পরিচয়? আর সব অবসান?/ অন্তরতলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়/ গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয়?’

এ প্রসঙ্গে কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন, ‘..... কিন্তু নোটনের কাছ থেকে কোনো রকম সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। তার মুখের ভাবে স্বীকৃতির বিন্দুমাত্র চিহ্ন ফুটে উঠেনি কখনো। যেন দা ভিঞ্চির মোনালিসার মতো তিনি ছিলেন সকল ধরা-ছোঁয়ার বাইরের এক মূর্তিমতী রহস্য। কারো কারো হয়তো মনে হতে পারে উল্লেখিত কবিতাটি প্রতিভা সোম ওরফে রানুকে উপলক্ষ করে লেখা; কিন্তু আমার আদৌ সন্দেহ নেই যে কবি তার কাব্য প্রেরণাদাত্রীর পরিচয়টিকে যথাসাধ্য গোপন করার চেষ্টা করেছেন। কেবল নোটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অন্তরঙ্গতার জন্য নির্বাক আবেদনের যতোটা প্রয়োজন ছিল অন্যের বেলায় ততোটা ছিল না।’

নোটন প্রসঙ্গে স্মরণীয় আরো একটি উলে­খযোগ্য গান হচ্ছে, ‘নাই পরিলে নোটন খোঁপায় ঝুমকো জবার ফুল’। তবে মোতাহার হোসেনের স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়, রানুর কণ্ঠে ‘অপূর্ব দ্যোতনায় রূপলাভ করত’ নিজের গজলটি, ‘কে বিদেশী/ বন-উদাসী/ বাঁশের বাঁশি/ বাজাও বনে।/ সুর-সোহাগে/ তন্দ্রা লাগে/ কুসুম-বাগের/ গুল-বদনে’

নজরুল ইসলামের সঙ্গে জাহানার চৌধুরীর পরিচয়ের সূত্র তার ভাই আলতাফ চৌধুরী। সে কথার উল্লেখও করেছেন জাহানারা বেগম চৌধুরী তার স্মৃতিচারণে। এ প্রসঙ্গে ১৯৮৫ সালে রচিত ‘নজরুল স্মৃতি’ প্রবন্ধে আলতাফ চৌধুরী লিখেছেন, ‘কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৩০ সালে। কলকাতার পার্ক সার্কাসে তখন আমরা থাকতাম। নজরুলের বন্ধু নলিনীকান্ত সরকার আমাদের বাড়ি কোটাল পুকুরের (সাঁওতাল পরগণা) নিকটস্থ নিমতিতা (মুর্শিদাবাদ) গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ছেলে বেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন উনি। উনি বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। গানের টিউশনিও করতেন। সঙ্গীত শিল্পী আর সাহিত্যিক মহলেই কাটতো তার সারা দিন। সেই নলিনীদাই কাজী নজরুলকে আমাদের পার্ক সার্কাসের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। প্রথম দিনই দেখলাম, নজরুলের মনোভাব হচ্ছে সবাই তার আত্মীয়। নজরুলের সঙ্গে পরিচয় ক্রমেই গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হতে দেরি হলো না। তখন আমি আমাদের মা আর জাহানারা এক বাড়িতে থাকতাম।

জাহানারা বেগম লিখেছেন, ‘..... গানের প্রতি আমার খুব আকর্ষণ ছিলো, কিন্তু গলা ছিলো না। কবিতার ওপর ঝোঁক ছিলো সবচেয়ে বেশি। তাই নতুন কবিতার জন্যে কবিদাকে তাগাদা দিতাম সব সময়, কিন্তু প্রায়ই কোনো মাসিকপত্র সম্পাদক বা প্রকাশক আগেই তা হস্তগত করে ফেলতেন। একদিন তাকে বললুম, ‘আপনি লেখেন আপনার গোপালদার (ডি.এম. লাইব্রেরি) জন্যে, কালিকা প্রেসের শরৎবাবুর জন্যে, তারা ছাপাবেন তখন আমি পড়তে পাবো। তা হতে পারে না। আমি খাতা দেবো আপনি তাতে লিখবেন, আমি কোনদিন সে কবিতা কাউকে ছাপাতে দেবো না। তা আমার একান্ত নিজের থাকবে। ওরা সবাই হলেন দোকানদার। কিন্তু আমি তো আপনার ভক্ত। আমার সৌভাগ্য, ভক্তের প্রার্থনা মঞ্জুর হলো।’

কবি জাহানারা বেগমকে লাল কাপড়ে মোড়ানো যে খাতায় বিভিন্ন সময়ে কবিতা, গান লিখে দিয়েছেন, তার উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে, ‘মীরাকে’/ ‘নজরুল ইসলাম।’/ ‘দার্জ্জিলিঙ’।

জাহানারা চৌধুরীর ডাক নাম ছিল মীরা। উপরের স্মৃতিচারণে জাহানার প্রথম কোথায় কবির হাতে গানের খাতাটি তুলে দেন তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া না গেলেও এই খাতাটিতে কবি প্রথম লেখেন দার্জিলিঙে। উৎসর্গ পৃষ্ঠাই এর প্রমাণ। কিন্তু পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও বর্ণনা থেকে মনে হয় কলকাতার ল্যান্সডাউনের বাসায়ই জাহানারা কবিকে খাতাটি দিয়ে ছিলেন। তা হলে কি ওই মহামূল্যবান খাতাটির প্রথম দিককার কিছু পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে? অথবা কোথাও ছাপার জন্য দেয়ার উদ্দেশ্যে খুলে নেয়া হয়েছে?

ওই গানের খাতায় মীরাকে উৎসর্গ করা নজরুলের মোট আটটি কবিতা ও সাতটি গান রয়েছে। এগুলোর প্রথম কলি/শিরোনাম এবং রচনা স্থান ও তারিখ হচ্ছে নিম্নরূপ-  কবিতা- ১. সুন্দর তুমি, নয়ন তোমার মানস-নীলোৎপল।/ ২. আমার ধেয়ান-কমলে আলতো রাখিয়া চরণখানি।/ ৩. সুন্দর তনু, সুন্দর মন, হৃদয় পাষাণ কেন?/ ৪. আমার অশ্রু-বর্ষার শেষে ইন্দ্রধনু মায়া।/ ৫. ওপার হইতে আসিয়াছে ভেলা, বাজিছে বিদায়-বাঁশি।/ ৬. এপারেতে একলা আমি মধ্যে আমার বাণীর ধারা।/ ৭. তুমি বুঝিবে না মোরে।/ ৮. রৌদ্রোজ্জ্বল দিবসে তোমার আসিনি সজল মেঘের ছায়া।/ গান- ১. এলে কি স্বপন-মায়া আবার আমায় গান গাওয়াতে।/ ২. আমি অগ্নিশিখা, মোরে বাসিয়া ভালো।/ ৩. আজ গানে গানে ঢাকব আমার গভীর অভিমান।/ ৪. থাক সুন্দর মিথ্যা আমার।/ ৫. সাগরে যে জোয়ার জাগে জানে না তা চাঁদ।/ ৭. প্রিয় তুমি কোথায় আজি।/

এ কবিতা-গানগুলোর প্রত্যাশিত সঙ্কলনটি গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে। কবির জন্মশতবর্ষে আব্দুল মান্নান সৈয়দের সম্পাদনায় নজরুল ইনস্টিটিউট এটি প্রকাশ করেছে। গ্রন্থের ভূমিকাংশে জাহানারা বেগম চৌধুরী উল্লেখ করেন, ‘কাজী নজরুল ইসলামের এই অপ্রকাশিত কবিতাগুলো তার স্নেহের দান স্বরূপ তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। এতোদিন একান্ত ব্যক্তিগত অমূল্য সম্পদের মতোই এগুলো কৃপণের মতো নিজের কাছে বন্ধ করে রেখে ছিলাম। এতোদিন এগুলো অজ্ঞাত ছিল, আজ তাদের আলোর মাঝে মুক্ত করে দিয়ে প্রকাশ করার সময় এসেছে।’

গান শেখাতে গিয়ে অন্যান্যের মতো শিল্পী কানন দেবীর সঙ্গেও নজরুল ইসলামের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ নিয়ে সমকালে নানা কথা রটে শিল্পী মহলে। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই রটনাকারীদের অগ্রজের ভূমিকা পালন করেন সজনীকান্ত দাশ গং এবং ‘শনিবারের চিঠি’ পক্ষ। ঔৎসুক্য সৃষ্টিকারী এসব মুখরোচক রটনা অবশ্য বেশি দিন বাজার মাত করে রাখতে পারেনি। খুব অল্পকালের মধ্যেই কবির সজ্জনরা বাস্তব উপলব্ধি করে ফেলতেন। ফলে নতুন রটনায় মেতে উঠতো ‘শনিবারের চিঠি’। এই পত্রিকাটির একমাত্র কাজই ছিলো নজরুলের বিরোধিতা করা এবং বিরোধিতার নামে কুৎসা রটানো। ঢাকার বনগ্রামে রানুকে গান শেখাতে গিয়ে সজনীকান্তের কুকর্মে কবি কী বিব্রতকর অবস্থার মধ্যেই না পড়ে ছিলেন। সে যাত্রায় দস্তুরমতো দৈহিকভাবে আক্রান্ত হয়ে ছিলেন কবি হিন্দু যুবকদের দ্বারা।

কানন দেবীকে ঘিরে কবিকে নিয়েও এমন একটি সংবাদ রটানো হয়েছিল যে, কবিকে কলকাতায় কোথাও না পেলে কানন দেবীর বাড়িতে অবশ্যই পাওয়া যাবে। অথচ কানন দেবীর সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিলো গুরু-শিষ্যার। গান শেখার জরুরি প্রয়োজনে কানন দেবীর আকুলতার কাছে পরাভূত হয়েই কবি তার বাড়ি যেতেন। নিত্য নতুন গানের সুর তুলে দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতো শিষ্যার বাড়িতে। গ্রামোফোন রেকর্ডের রিহার্সাল রোম বা আর দশটা গানের তালিমের ক্ষেত্রে কবির যে বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে, কানন দেবীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি অথবা সুর ভাজতে ভাজতে গভীর রাত হয়ে যাওয়ায় শিষ্যার গৃহে অবস্থানের ঘটনাকেই নিন্দুকেরা কুৎসিত রটনার উপকরণ হিসেবে বেছে নিয়েছে।

মেগাফোন কোম্পানির স্বত্বাধিকারী জিতেন্দ্রনাথ ঘোষের মাধ্যমে কবির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় কানন দেবীর। এরপর গুরুকে শিষ্যা তার কণ্ঠ দিয়ে মুগ্ধ করে তোলেন এবং কবির অনেক বিখ্যাত গানেই কণ্ঠ দিয়েছেন কানন দেবী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৩৯ সালের মে মাসে চিত্রায়িত ‘সাপুড়ে’ চলচ্চিত্রের গানগুলো। মেগাফোনে রেকর্ডকৃত এ চলচ্চিত্রের একটি বিখ্যাত গান হচ্ছে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ/ঐ পাহাড়ের ঝর্ণা আমি। ঘরে নাহি রই গো....।’

‘কবি প্রণাম’ প্রবন্ধে ১৯৩০ এর দশকের এসব নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ করে কানন দেবী জানাচ্ছেন, ‘এক দিন জে.এন. ঘোষ মেগাফোনের রিহার্সাল রুমে কবির (নজরুল ইসলাম) সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে চেয়ে দেখি পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্র লোক হার্মোনিয়ামের সামনে বসে আস্তে আস্তে বাজাতে বাজাতে গুন গুন করে সুর ভাঁজছেন চোখ বুঁজে। কখনো এ ধার ও ধার তাকাচ্ছেন, কিন্তু কোনো কিছুর ওপরই ঠিক যেন মন নেই। এক সময় হার্মোনিয়াম থামিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। দীপ্ত দুটি চোখের উজ্জ্বলতার মধ্যেই যেন তার ব্যক্তিত্ব কথা বলে উঠলো। ওই চোখ দুটিই যেন তাকে দেখিয়ে দেয়।....

আমাকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘ডাগর চোখে দেখছ কি? আমি হলাম ঘটক, জানো? এক দেশ থেকে সুর, অন্য দেশের কথা। এই দুই দেশের এই বর-কনেকে এক করতে হবে। কিন্তু দু’টির জাত আলাদা হলে চলবে না, তা হলেই বে-বন্তি। বুঝলে কিছু? ....

ছবির গান ও সুর বাঁধার সময়ও দেখেছি কতো প্রচণ্ড আনন্দের মধ্যে কী প্রবলভাবেই না কবি বেঁচে উঠতেন, যখন একটা গানের কথা ও সুর ঠিক তার মনের মতো হয়ে উঠতো। মানুষ কোনো প্রিয় খাদ্য যেমন রসিয়ে রসিয়ে আস্বাদ করে, কাজী সাহেব যেন তেমনি করেই নিজের গানকে আস্বাদ করতেন।’

‘বিদ্যাপতি’ চরিত্রের কিছু গানও কানন দেবী নজরুলের কাছে দীক্ষা নেন। এ ধরনের একটি উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে ‘সখি কে বলে পীরিতি ভালো’ (জে. এন. জি. ৫২২৭)।’ ‘কথা কইবেনা বউ’ কানন দেবীর কণ্ঠে কবির আর একটি উল্লেখযোগ্য গান (জে.এন.জি. ৫৩৮০)।

শুধু কানন দেবীই নন, কবির কাছে গান শিখেছেন আরো অনেক ভারত বিখ্যাত বাংলা সঙ্গীতের রানীকুল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন ইন্দুবালা দেবী, আঙ্গুর বালা দেবী, বিজনবালা ঘোষ দস্তিদার, সুপ্রভা সরকার ও ফিরোজা বেগম প্রমুখ। সঙ্গীতের আধুনিক যুগে পৌঁছেও নতুনদের কাছে এরা অনুকরণীয় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নজরুলের গানকে এরা আজো চির আবেদনময়ী করে রেখেছেন, এ বিরল কৃতিত্বের প্রধান কারণ মনে হয় কবি নিজের হাতে এদের গান শিখিয়েছেন।

যে অর্থে রানু সোম, উমা মৈত্র বা জাহানারা বেগম চৌধুরীকে গান শেখাতে গিয়ে কবি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তাদের নিয়ে গান লিখেছেন, এমনকি বইও উৎসর্গ করেছেন, কানন দেবী, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, বিজনবালা, সুপ্রভা সরকার বা ফিরোজা বেগমের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি। এর কারণ রানু, উমা, জাহানাদের কবি গান শিখিয়েছেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। ওটি ছিলো তার উঠতি সময়। নিজের গানকে মিষ্টি কণ্ঠে জনপ্রিয় করতে কবির ভেতর সে সময় প্রবল তাগিদও কাজ করেছে। পক্ষান্তরে বাংলা সঙ্গীত জগতে নজরুল যখন প্রতিষ্ঠিত এবং গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানিতে পেশাদার কম্পোজার হিসেবে কাজ করছেন, সে সময় পেশাগত প্রয়োজনেই কানন দেবী, ইন্দুবালা, আঙ্গুর বালা, বিজনবালা, সুপ্রভা সরকার বা ফিরোজা বেগমরা গ্রামোফোন কোম্পানিতে কবির কাছে গান শিখতে গেছেন। কবিও পেশাগত দায়িত্ব হিসেবেই এদের গান শিখিয়েছেন। এ কারণেই রানু, উমা বা জাহানারাদের সঙ্গে এদের অবস্থান বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে পার্থক্য গোচর হয়।

লক্ষণীয় দ্রষ্টব্য হচ্ছে, জীবনের নানা স্তরে কবির সঙ্গে বিভিন্ন নারীর বিচিত্রসব সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। তার মধ্যে কেউ হয়েছেন জননী স্বরূপা, কেউবা প্রেয়সী অথবা ভগিনী। এর মধ্যে যখন যে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন কবি, তখনই তার আরাধনার চূড়ান্ত করেছেন। মাতৃভক্তির ক্ষেত্রে কবিকে যেমন আকুল হতে দেখা যায়, প্রেয়সীকে কাছে পাবার জন্যেও তেমনি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন কবি। তবে তার মাতৃভক্তি সকল ক্ষেত্রে অক্ষুন্ন থাকলেও নিজের জন্মদাত্রী জননী এই পুত্রভক্তির অঞ্জলি থেকে বঞ্চিত ছিলেন। একইভাবে প্রিয়তমা প্রেয়সীর জন্য হৃদয় তার হাহাকার করে উঠলেও এ সম্পর্কে বিরূপ অনুভূতিও কখনো কখনো তার কবি মনকে তাড়িত করেছে। নারী সম্পর্কে কবির মনোভাবের এই পার্থক্যের কারণ নিঃসন্দেহে তার রক্তে-মাংসে গড়া দেহ-মন এবং দয়িতার ছলচাতুরীও বটে।

নারীকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কবি বেশ কিছু কবিতা রচনা করেন। তারমধ্যে ‘নারী’ নামেই তার একাধিক কবিতা রয়েছে। এর একটি ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে, অপরটি ‘শেষ সওগাত’ এ সঙ্কলিত হয়েছে। এছাড়াও অজস্র প্রেমের কবিতা-গানে নারী সম্পর্কে কবি তার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। যার অধিকাংশই অনুকূল মনোভাবের প্রকাশে অলংকৃত, কিছু কিছু অবশ্য ব্যতিক্রম, বীতশ্রদ্ধ উপলব্ধির প্রকাশও রয়েছে।


কবির ১১৬ তম জন্মজয়ন্তীতে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। (সমাপ্ত)
[email protected]

এইচআর/বিএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।