নববর্ষের অঙ্গীকার : করোনামুক্ত দেশ হোক সবার
ফারাবী বিন জহির
বাংলা নববর্ষ বাঙালির জীবনে এক অবিস্মরণীয় আনন্দের উৎসব। এই উৎসবের দিনে বাঙালি জাতির প্রতিটি মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়। বাংলা নববর্ষের এই অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটি এই উৎসবকে অন্যান্য উৎসব থেকে করেছে পৃথক। বাঙালির জীবনের অন্য উৎসবগুলো কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম-বর্ণ বা জাতির জন্য হলেও এই বাংলা নববর্ষের উৎসবের কোনো পরিসীমা নেই। যেকোনো স্তরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারে। উৎসবের এই সার্বজনীনতা উৎসবের আনন্দকে বহুগুণ বাড়িয়ে একে করেছে বাঙালির প্রাণের উৎসব।
সেই কারণে হয়তো বাঙালির জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে এই উৎসবের রঙ। বাঙালির জীবনের কোথায় নেই নববর্ষের ছোঁয়া? নববর্ষ আছে আমাদের সাহিত্যে, নববর্ষ আছে আমাদের কবিতায়, নববর্ষ আছে আমাদের গানে, নববর্ষ আছে আমাদের জীবনে। বাঙালির পরম আরাধ্য নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথেও আছে নববর্ষের ছোঁয়া। সেই নববর্ষের ছোঁয়া থেকেই বাঙালির গায়ক মন মেতে ওঠে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো... গানের সুর মূর্ছনায় কিংবা ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর... গানের সুর ঝংকারে।
তবে বাংলা নববর্ষের এই অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলা নববর্ষকে কম ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়নি, হয়নি বাংলা নববর্ষকে ঘিরে কম চক্রান্ত। কোনো চক্রান্তই সফল হতে পারেনি। বাঙালি সব প্রতিকূলতা ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে। ম্লান হতে দেয়নি তার পরম আকাঙ্ক্ষার উৎসব বাংলা নববর্ষের সৌন্দর্যকে।
এই বাংলা নববর্ষকে ঘিরে হয়েছে বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র। কখনো সাম্প্রদায়িক কালিমা লেপনের চেষ্টা হয়েছে, বলা হয়েছে বাংলা নববর্ষ হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি। অথচ বাংলা সালের প্রবর্তন করার উদ্যেগ নেন সম্রাট আকবর, বাংলা সালের নিয়ম প্রণয়ন করেন তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী, বাংলা সন প্রণয়ন হয় সৌরসাল এবং আরবি হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে, বাংলা সন গণনা শুরু হয় ১ থেকে নয়, তৎকালীন হিজরি সন ৯৬৩ থেকে, আধুনিক বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রস্তাবক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এমন ধ্রুব শাশ্বত ইতিহাস থাকার কারণেই কুচক্রীদের নববর্ষকে ঘিরে কালিমা লেপনের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি।
কখনো বা এই উৎসবকে পড়তে হয়েছে জঙ্গিবাদের রোষানলে। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন; বাংলা ১৪০৮ সনের পহেলা বৈশাখ। প্রতি বছরের মতো সেবারও রমনার বটমূলে ছায়ানট কর্তৃক ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এখানে গানের অনুষ্ঠান চলাকালীন বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে ৯ জন সাংস্কৃতিককর্মী ও দর্শক প্রাণ হারানোর পাশাপাশি আহত হন আরও অগণিত মানুষ; পরবর্তীতে আরও একজন মারা যান। জঙ্গিদের এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল বোমা হামলা ও মানুষ হত্যার মাধ্যমে চিরতরে এই উৎসবকে বন্ধ করে দেয়া। কিন্তু বাঙালি বীরের জাতি জঙ্গিবাদের সেই রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পরের বছর দ্বিগুণ লোকের জমায়েত গড়ে তোলে।
সর্বশেষ এই উৎসবকে ঘিরে যে নোংরামি হয়েছে তা হচ্ছে এই উৎসবের দিনে কিছু নরপশু কর্তৃক নারীদের লাঞ্ছিত করার চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে সমাজের নারীদের কাছে এক ভীতিপূর্ণ বার্তা প্রদানের যে এই উৎসব নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। কিন্তু চক্রান্তকারীদের সেই চেষ্টাও ভেস্তে গেছে। সকল মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অপরাধীদের আইনের মুখোমুখি করা হয়েছে।
শুধু এই নববর্ষ নয়, নববর্ষের মূল আকর্ষণ মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়েও করা হয়েছে চক্রান্ত। এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিতে চেষ্টা করা হয়েছে, বলা হয়েছে এই শোভাযাত্রা হিন্দুধর্ম থেকে অনুপ্রাণিত। অথচ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশে দুটি শোভাযাত্রা হয় যা ধর্মভিত্তিক, একটি হচ্ছে মহররমের সময়কার শোভাযাত্রা, অপরটি জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা। বরং মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে কোনো ধর্মীয় বিষয়ের সম্পর্ক নেই এবং যেকোনো ধর্মের উৎসবের বাইরে বাঙালি হিসেবে সার্বজনীন একটি উৎসব হিসেবেই সূচনা হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার।
চারুকলা থেকে এই শোভাযাত্রার শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। যদিও সেটা তখন এতটা বর্ণাঢ্য ছিল না। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিজ-নিজ জায়গা থেকে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছিলেন অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক। মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যায়, কোনো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির উদ্ভব হয়নি বরং উদ্ভব হয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে এবং যা আজও অব্যাহত আছে। ২০১৬ সালে বাংলা নববর্ষ বরণ করে নেয়ার এই উৎসবটি ইউনেস্কোর অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় যে বাঙালিকে কোনো বিভ্রান্তির বেড়াজালেই আবদ্ধ করা যায়নি। বাঙালি সমস্ত বেড়াজাল ছিন্ন করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সকল প্রতিকূলতা এবং বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে লড়াই করে স্ব মহিমায় উজ্জ্বল রেখেছে প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষকে। এবার নববর্ষেও বাঙালিকে লড়াই করতে হবে। তবে এবারের লড়াইটা ভিন্ন আঙ্গিকে, জোটবদ্ধ নয় বরং লড়াইটা হবে একা এবং নিজ অবস্থান থেকে। লড়াইটা করতে হবে করোনাভাইরাস নামক এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। যে শত্রু পৃথিবীব্যাপী লাখো প্রাণের স্পন্দনকে থামিয়ে দিচ্ছে। যে শত্রু বিশ্ব মানবতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবারের মতো এইবার হয়তো আমরা বাঙালিরা মঙ্গল শোভাযাত্রা করব না, তবে বুকে থাকবে করোনা নামক অমঙ্গল বিনাশের দৃপ্ত শপথ। এইবার হয়তো আমরা মৌলবাদী শক্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জোটবদ্ধভাবে উৎসবে মেতে উঠব না বরং এইবার ঘরে থেকে করোনাভাইরাসকে বাংলাদেশকে বিদায়ের লড়াইয়ে মেতে উঠব। এবারের নববর্ষে আমরা করোনামুক্ত দেশ গড়ার এক দৃপ্ত শপথ নিয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হব।
সর্বোপরি বলা যায়, মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,. অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা... গানটি গেয়ে আমরা হয়তো এইবারও আমাদের নববর্ষ উদযাপন শুরু করব তবে ভিন্ন আঙ্গিকে, জোটবদ্ধভাবে নয় বরং যার যার বাসগৃহে অবস্থান করে গাইব এবং আমাদের ধরাকে শুচি করার জন্য সত্যিকারের এক জরার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।
লেখক : গবেষক
এইচআর/বিএ/পিআর