জলের নিচে জাল, কোলের মধ্যে ভালোবাসা
ঘড়িতে তখন সকাল ১০টা। কেবল রোদ উঠছে। জোয়ার বাড়ছে। বুড়াগৌরাঙ্গ নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলাম। এই নদীর পাড়ে পটুয়াখালী জেলাধীন অনেক গ্রামের অবস্থান। আমি ছিলাম চরমোন্তাজে। হঠাৎ চোখ আটকে গেল এক নারীর দিকে। ছবি: খায়রুল বাশার আশিক
-
হাঁটু সমান পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি। হাতে লাল নাইলন রশি। পাশে ভাসছিল দুইটি নৌকা। দেখে বোঝা যায়, জলের তলে জাল। চলছে, মাছ ধরার কর্মযজ্ঞ।
-
দেখতে দেখতে কোথা থেকে যেন সেই নারীর পাশে ভিড়ল একটি শিশু। ওর বয়স হবে ৮-১০। সে সাঁতার জানে। পানি মাড়িয়ে শিশুটি নারীর কাছে যেতেই হাত লাগাল জাল-রসিতে। বুঝলাম, শিশুটি তার মায়ের কাজে সাহায্য করতেই সেখানে গেছে। তখনও নদীর তীরে অপেক্ষা করছিলাম। বিষয়টি দেখতেই দাঁড়িয়েছি।
-
ঐ নারীর খানিকটা দূরে একজন পুরুষ ছিলেন। লুঙ্গি কাছা দেওয়া লোকটির কোলে আরেকটি শিশু। বয়স আনুমানিক ১ বছর। কেবল দাঁড়াতে শিখেছে। বোঝা যাচ্ছিল, তারা বাবা-সন্তান। শিশুটিকে নিয়ে আস্তে আস্তে তিনি পানিতে থাকা নারীর কাছে এলেন।
-
কাছাকাছি সবাই। বোঝা সহজ তারা একই পরিবারের। স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে দুই ছেলে। পানি যেখানে খুব কম, সেখানে দাঁড়ানোর পর কোলের শিশুটিকে রাখলেন বাবা। মায়ের কাছে থাকা বড় ছেলেটি দৌড়ে এলো। তারা খুনসুটিতে মাতল। ছোট ভাইকে কাছে পেয়ে বড় ভাই খুব উচ্ছ্বসিত। বড় ছেলের দায়িত্বে ছোট ছেলেকে দিয়ে নারীর সঙ্গে কাজে জুড়লেন পুরুষ।
-
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো দায়িত্ব বুঝে নিলেন পুরুষ লোকটি। পেঁচিয়ে যাওয়া জাল ঠিক করতে করতে এগিয়ে চললেন। বড় ছেলেটাও গেল বাবার পিছু পিছু। নারীর কাছে রয়ে গেল ছোট শিশুটি। কখনো ঐ নারীর নজর নদী-নৌকা-রশির দিকে। এর মধ্যেই দৃষ্টি ফেরাচ্ছিলেন শিশুটির দিকে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, কেমন যেন উদাস উদাস তিনি। কী এক চিন্তা নিয়ে কাজে জড়িয়েছেন ঐ নারী। এরই মধ্যে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট শিশুটিও ক্ষুধার্ত। খুনসুটি ছেড়ে কাঁদছে। তার পেট যে ভরাতে হবে। এদিকে জালের সুতাও যে ছাড়া যাবে না।
-
গল্পটা এখানেই! সেই কোমর পানিতে দাঁড়িয়েই সন্তানের মুখে তুলে দিলেন মাতৃদুগ্ধ। এই দৃশ্য প্রমাণ করে সন্তানের চাহিদা মেটাতে শত প্রতিবন্ধকতাও মাকে থামাতে পারে না। সন্তানের ক্ষুধা মেটাতে, রোদের তীব্রতা, নোনা জলের যন্ত্রণাসহ শত কষ্ট মা মেনে নিতে পারেন। কোনো মা দিবসে নয়, মা মানে মা, প্রতিদিন প্রতিক্ষণে, যেকোনো পরিস্থিতিতে।
-
একসময় মায়ের কোলে শিশুটি ঘুমিয়ে গেল। এরপর মা তার পায়ে জালের সুতা পেঁচিয়ে সন্তানকে জড়িয়ে নিলেন। কোলেই ঘুম পড়ালেন। মা যখন কোমর পানিতে সন্তান তখন নিশ্চিন্ত ঘুমে।