স্মৃতির গন্ধ মেখে ঢাকায় ফেরা ক্লান্ত মানুষ
ঈদের ছুটির কয়েক দিন যেন ছিল জীবনের বাইরে একটা ছোট্ট স্বর্গ-মায়ের হাতের রান্না, উঠোনে শৈশবের হাঁটাহাঁটি, বিকেলের গল্পের আসর, আর ছোট ভাইবোনদের হাসিমুখ। ট্রেন যখন গ্রামের মাটি ছেড়ে আবার শহরের দিকে ছুটে আসে, তখন জানালার পাশে বসে থাকা মানুষগুলোর চোখে শুধু ছুটে চলে ফেলে আসা মুহূর্তগুলো। ঢাকায় ফিরে আসা মানে যেন নিজের এক টুকরো আবেগ ফেলে রেখে আসা। ব্যাগের ভেতর যেমন কাপড়চোপড় আর উপহার থাকে, তেমনি মনের ভেতর জমে থাকে কিছু গন্ধ-লেবু গাছের, গরম ভাতের, কিংবা মায়ের আলতো ছোঁয়ার। কিন্তু সেই গন্ধ বুকের ভেতর রেখে মানুষগুলো নেমে পড়ে কমলাপুরের প্ল্যাটফর্মে। গরমে ভেজা গায়ে, চোখেমুখে ক্লান্তি তবুও মুখে থাকে নিঃশব্দ এক সংকল্প ‘ঢাকায় ফিরতেই হবে, জীবন তো আর থেমে নেই।’ লেখা: জান্নাত শ্রাবণী; ছবি: মাহবুব আলম
-
ঈদের আনন্দের রেশ রয়ে গেলেও বাস্তবতা আবার ডাক দিচ্ছে-ঢাকার ব্যস্ততা, কাজের টান আর অফিসের সময়সূচি। তাই ব্যাগ-ব্যাগেজ গুছিয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ফিরছে রাজধানী ঢাকায়। কিন্তু এই ফেরা এবার সহজ নয়। রোদের তেজ যেন আকাশ থেকে আগুন ছুড়ে দিচ্ছে, ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করছে জনপদ।
-
এই ফিরতি যাত্রার এক বড় সাক্ষী হয়ে উঠেছে কমলাপুর রেলস্টেশন। স্টেশনের প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে, সিঁড়িতে, ছাউনির নিচে সবখানে শুধু মানুষ আর মানুষ। ঘামে ভেজা মুখ, মাথায় মালপত্র, এক হাতে শিশুর হাত ধরা, আরেক হাতে ব্যাগ-এই দৃশ্য যেন একটাই গল্প বলছে, ‘ফিরে যাচ্ছি... কারণ আর সময় নেই।’
-
কয়েকদিনের ঈদের ছুটিতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লাখ লাখ মানুষ ফিরেছিলেন নিজ বাড়িতে। মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো ছিল নিশ্চিন্ত ও আনন্দময়। কিন্তু সেই ছুটির বাঁধন ছিঁড়ে এখন আবার যাত্রা শুরু হয়েছে কাজে ফেরার।
-
কেউ পোশাক কারখানায় ফিরছেন, কেউ অফিসে, কেউ আবার হোস্টেল বা মেসে। সবাই যেন এক অদৃশ্য ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরছেন সেই চেনা শহরে, যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় জীবিকার নিশ্চয়তা, কিন্তু হারিয়ে যায় নিজের নিঃশ্বাস।
-
এই বছরের জুন মাসের শুরুতেই ঢাকায় তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তাপপ্রবাহ চলছে সারা দেশে। কিন্তু ট্রেন থামে না, ছুটি ফুরোয় না। ফলে কমলাপুর রেলস্টেশন আজ যেন এক ক্লান্ত জনস্রোতের ঘর্মাক্ত চিত্রপট।
-
কমলাপুর স্টেশনের বাইরে এসে যখন মানুষ বাস বা সিএনজির জন্য দাঁড়ায়, তখন যেন আরেক যাত্রা শুরু হয়। রোদের তেজে ফুটপাত গরম হয়ে আছে, বাতাস নেই বললেই চলে। ট্রেনের দীর্ঘ যাত্রার পর এবার শহরের ভেতরের ভোগান্তির পালা।
-
বৃষ্টির দেখা নেই, ছায়া নেই। স্টেশনের সামনের রাস্তায় কোনো ছাউনি নেই। ফলে পুরুষদের চেয়ে বেশি কষ্টে পড়ছে নারী ও শিশুরা। কিছু মানুষ ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও বেশিরভাগই গামছা বা ওড়না দিয়ে রোদ ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
-
যারা ফিরছেন, তাদের চোখেমুখে ঈদের স্মৃতি। ট্রেনের জানালা দিয়ে পেছনে ফেলে আসা গ্রামের বাড়ি, সেই উঠোনে রাতের গল্প বা ঈদের দিন সকালে বাবার সঙ্গে মসজিদে যাওয়া সবই যেন রয়ে যায় হৃদয়ের কোণে।
-
ঢাকা যেন নিজেকেই প্রস্তুত রাখে এ ফিরে আসার জন্য। ঈদের আগে যেমন শহরটা শুনশান হয়ে পড়ে, ঈদের পরে তেমনি সে আবার জেগে ওঠে। নতুন করে গতি ফিরে পায় অফিসপাড়া, বাজার, গার্মেন্টস, স্কুল-কলেজ।
-
কমলাপুর সেই ফেরার সূচনাবিন্দু। এখানে এসে নামছেন লাখো মানুষ, আবার ছড়িয়ে পড়ছেন সারা শহরে। কেউ বস্তিতে, কেউ মেসে, কেউ আবার আত্মীয়ের বাসায় উঠছেন পরদিন অফিস ধরবেন বলে। এই গরমে যখন শহরের মানুষেরা ছুটি শেষে ঘরে ফেরার প্রস্তুতিতে ধীরে ধীরে ঢাকায় প্রবেশ করছেন, তখন কমলাপুর হয়ে উঠছে তাদের প্রথম সাক্ষী। ঈদের আনন্দ ফুরালেও জীবন তো থেমে থাকে না।
-
এই ফিরে আসা শুধু কাজের টানে নয়, দায়িত্বের টানেও। কেউ সন্তানকে পড়াশোনায় ফেরাবেন, কেউ অফিস সামলাবেন, কেউ আবার শুধুই ঢাকাকে ভালোবেসে ফিরে আসেন।