মঞ্চ থেকে মহাকাব্যে, হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন একাই এক মহাবিশ্ব
চোখে ছিল অদ্ভুত এক আগুন, কণ্ঠে ছিল শিহরণ জাগানো জোর আর অভিনয়ে ছিল বিপ্লবের গন্ধ। তিনি যখন মঞ্চে উঠতেন, শব্দ থেমে যেত; তিনি যখন পর্দায় আসতেন, চরিত্র হয়ে উঠত জীবন্ত। বলছি কিংবদন্তী অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির কথা। তিনি বাংলাদেশের অভিনয় জগতের এমন এক বিস্ময়, যিনি নিজেই ছিলেন এক চলমান মহাবিশ্ব। কোথাও তিনি এক মূর্তিমান দানব, আবার কোথাও গভীর মানবিকতার প্রতিচ্ছবি। নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা টেলিভিশন-সব জায়গায় নিজের উপস্থিতি এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, যেন সময়কে ছুঁয়ে থাকাই ছিল তার শিল্প। আজ বিশেষ এই মানুষটির জন্মদিন। তার জন্মদিনে আমরা শুধু একজন অভিনেতাকে নয়, অভিনয়ের এক অনন্য ধারাকে স্মরণ করি-যার শুরু মঞ্চে, বিস্তার মহাকাব্যের মতো। ছবি: সংগৃহীত
-
১৯৫২ সালের এই দিনে ঢাকার নারিন্দায় জন্ম তার। বাবা এটিএম নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। পারিবারিক প্রয়োজনে ফরীদির শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, রাজশাহী এবং পরে ঢাকায়। ঘন ঘন স্থান পরিবর্তনের ফলে ছোটবেলাতেই তার ভেতর তৈরি হয় একটি পর্যবেক্ষণশীল মন এবং বিচিত্র মানুষের চরিত্র বোঝার দুর্দান্ত ক্ষমতা-যা পরবর্তীতে তার অভিনয়ে অসাধারণ বাস্তবতা এনে দেয়।
-
কৈশোরে হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন অন্তর্মুখী ও ভাবুক প্রকৃতির। পড়াশোনায় ভালো ছিলেন, তবে জীবনের গভীরতা বুঝতে শুরু করেছিলেন খুব অল্প বয়সেই। স্কুলজীবনে বিজ্ঞান বিভাগে পড়লেও নাট্যচর্চা এবং সাহিত্যপ্রেম তার মানসিক জগৎকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
-
তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন এবং দেশের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেন। এ সময় তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, যা তার জীবনের অন্যতম গর্বের অধ্যায়।
-
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং এখানেই তার নাট্যজীবনের মোড় ঘুরে যায়।
-
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়েই তিনি পরিচিত হন নাট্যব্যক্তিত্ব সেলিম আল দীনের সঙ্গে। এখানেই নাট্যচর্চা, মঞ্চনাটক, কবিতা ও শিল্প নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটে।
-
তিনি নাট্যদল আরণ্যক নাট্যদল-এ যোগ দেন এবং বিখ্যাত মঞ্চনাটক ‘শকুন্তলা’, ‘কেরামত মঙ্গ ‘, ‘ভাঙাচোরা’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’- তে অভিনয় করেন। তার শরীরী ভাষা, কণ্ঠের গভীরতা এবং তীক্ষ্ণ চোখের এক্সপ্রেশন তাকে মঞ্চে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
-
১৯৮০-এর দশকে হুমায়ুন ফরীদি টেলিভিশনে কাজ শুরু করেন। খুব অল্প সময়েই তিনি হয়ে ওঠেন সবচেয়ে আলোচিত এবং চাহিদাসম্পন্ন অভিনেতা। তার অসাধারণ অভিনয়ের ঝলক পাওয়া যায় টিভি নাটকগুলোতে।
-
তার অভিনীত নাটকের মধ্যে অন্যতম- ‘সংসপ্তক’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘পাতালঘর’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘দূরবীন’, ‘ভাঙ্গনের শব্দ শোনা যায়’,‘বহুব্রীহি’, ‘আলতাবানু’ ইত্যাদি। তিনি যখন সংলাপ বলতেন, তখন দর্শক শুধু শুনত না-মুগ্ধ হয়ে শোনার মাঝে হারিয়ে যেত।
-
চলচ্চিত্র জগতে তার অভিষেক হয় ১৯৮৪ সালে ‘হুলিয়া’ চলচ্চিত্রে। এরপর একে একে তিনি অসংখ্য কালজয়ী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো- ‘হুলিয়া’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘ব্যাচেলর’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘মাতৃত্বসুভা’, ‘জয়যাত্রা’, ‘আনন্দ’, ‘অশ্রুপাপ’, ‘পুণ্য’ ইত্যাদি।
-
হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন স্বভাবচরিত্রে অন্তর্মুখী, গভীরচিন্তক এবং শিল্পে নিবেদিতপ্রাণ এক মানুষ। তার ব্যক্তিজীবন ছিল কিছুটা রহস্যময়। তিনি বিয়ে করেছিলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফাকে। তবে দাম্পত্য জীবন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, এবং পরবর্তীতে তারা আলাদা হয়ে যান।
-
তার জীবনে সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা ও দর্শন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময় পেলে তিনি গান শুনতেন, কবিতা লিখতেন এবং বই পড়তেন। তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গতা-প্রিয়, ভাবুক, আর শিল্পমনস্ক এক দুর্দান্ত মানুষ।
-
২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে ঢাকার ধানমণ্ডির নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হুমায়ুন ফরীদি।
-
তার মৃত্যুতে যেন থমকে গিয়েছিল পুরো দেশের শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গন। অসংখ্য ভক্ত, সহকর্মী, নাট্যজন, সাংবাদিক এবং সাধারণ দর্শকরা অনুভব করেছিলেন ‘একটা যুগের অবসান’।