তিতাস থেকে বহ্নিশিখা, ববিতার রঙিন ক্যারিয়ারের গল্প
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন কিছু নাম চিরকাল জ্বলজ্বল করবে, যাদের অবদান শুধু রূপালি পর্দায় সীমাবদ্ধ নয়, যারা হয়ে উঠেছেন সময়ের সাক্ষী, সংস্কৃতির প্রতিনিধি। তেমনই একজন কিংবদন্তি অভিনেত্রী ববিতা। তিতাস একটি নদীর নাম–এ ‘গৌরী’ চরিত্রে তার আবির্ভাব ছিল বিশ্বদরবারে বাংলা সিনেমার এক গৌরবময় মুহূর্ত। আর সেখান থেকে বহ্নিশিখা, নটী বিনোদিনী, রূপালি সৈকত, অশনি সংকেত হয়ে ববিতা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক অসাধারণ অভিনয়শিল্পী হিসেবে। তার রঙিন ক্যারিয়ারের প্রতিটি বাঁকে ছিল সাহস, সংবেদনশীলতা আর শিল্পের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা। আজ তার জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক সেই দীর্ঘ, গৌরবময় পথচলার গল্প-যেখানে প্রতিটি চরিত্রেই তিনি রেখে গেছেন এক অনন্য ছাপ। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া
-
১৯৫৩ সালের এই দিনে, বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায় তার জন্ম। ববিতার পুরো নাম ফরিদা আক্তার ববিতা। তবে শৈশবের একটি বড় সময় কেটেছে চট্টগ্রামে ও ঢাকায়। তার বাবা কাজ করতেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সে, ফলে পারিবারিকভাবে ছিল একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক পরিবেশ। তার মা ছিলেন সংগীতপিপাসু, আর বড় বোন সুচন্দা তখন অভিনয় জগতে প্রবেশ করছেন-এতে ববিতার মনের ভেতরও সিনেমার প্রতি এক অদৃশ্য টান তৈরি হতে থাকে।
-
ববিতার অভিনয় জীবনের সূচনা হয় খুব অল্প বয়সে। প্রথমদিকে শিশু শিল্পী হিসেবে কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্র ও সিনেমায় দেখা গেলেও, নায়িকা হিসেবে বড় পর্দায় তার অভিষেক ঘটে জহির রায়হানের চলচ্চিত্র সংসার (১৯৬৯)-এর মাধ্যমে। এরপর তার ক্যারিয়ারে একের পর এক চলচ্চিত্র এসেছে, আর প্রতিটি ছবিতেই তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন নতুনরূপে।
-
ববিতার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় মৃণাল সেন পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৭৩) ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে ‘গৌরী’ চরিত্রে ববিতার আবেগপ্রবণ অভিনয় জয় করে নেয় আন্তর্জাতিক দর্শকদের মন। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি প্রশংসিত হয় এবং ববিতা নিজেও আন্তর্জাতিক ফিল্ম সার্কেলে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
-
সত্তর ও আশির দশকে ববিতা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় মুখ। তার উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে-‘অশনি সংকেত (সত্যজিৎ রায় পরিচালিত, ১৯৭৩)’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘সারেং বউ’, ‘রূপালী সৈকত’, ‘দুই জীবন’, ‘দহন’, ‘সঙ্গী’, ‘অধিকার’।
-
বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত-এ তার অসাধারণ অভিনয় বাংলা সিনেমাকে পৌঁছে দেয় বিশ্ব দরবারে। এমনকি এই ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে।
-
ববিতা যে কেবল রোমান্টিক নায়িকাই ছিলেন না-তা প্রমাণ করেছেন নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। কখনো প্রতিবাদী নারী, কখনো নিঃস্ব মায়ের চরিত্রে তিনি দর্শকের মনে গভীর ছাপ রেখেছেন। তার অভিনয় শুধু মুখভঙ্গিমা বা সংলাপে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল শরীরী ভাষা ও গভীর মানসিক উপলব্ধিতে পরিপূর্ণ।
-
আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন এই অভিনেত্রী, যার মধ্যে রয়েছে সেরা অভিনেত্রী বিভাগে একাধিকবার জয়।
-
ববিতা ব্যক্তিগত জীবনকে সবসময়ই মিডিয়ার আলোচনার বাইরে রেখেছেন। তার একমাত্র ছেলে অনিক বর্তমানে কানাডায় বসবাস করছেন। ছেলের শিক্ষাজীবন এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই একসময় ধীরে ধীরে সিনেমা থেকে দূরে সরে যান এই অভিনেত্রী।
-
তবে মাঝে মাঝে তাকে দেখা গেছে সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে, নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে। তিনি ইউনিসেফসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
-
ববিতার সিনেমাগুলো যেন শুধু বিনোদন নয়, ছিল সময়ের প্রতিচ্ছবিও। তিতাস থেকে বহ্নিশিখা, তার প্রতিটি চরিত্রে ছিল সাহস, মমতা, সংগ্রাম আর শিল্পবোধের নিপুণ ছোঁয়া। চলচ্চিত্রে তিনি যে বৈচিত্র্য এনেছেন, তা আজও অনুকরণীয়।