স্মৃতিতে ফারুক
অভিনয় দিয়ে কখনো কাঁদিয়েছেন, কখনো আবার ভাসিয়েছেন আনন্দে। দর্শকের হাসি-কান্নার সঙ্গী হয়ে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন তিনি। সিনেমার মিয়াভাই, রাজনীতির পরিচিত মুখ, মানুষের ভালোবাসার চিত্রনায়ক-তিনি আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। আজও মনে হয়, যদি সময় একটু দয়া করত, যদি জীবন তাঁকে আরও কয়েক বছর সময় দিত, তবে হয়তো আজও পর্দায় কিংবা রাজনীতির মঞ্চে তার প্রাণবন্ত উপস্থিতি দেখা যেত। কিন্তু জীবন কখনো চাওয়া মতো চলে না। গত বছরের এই দিনে পৃথিবীকে বিদায় জানালেও স্মৃতিতে তিনি রয়ে গেছেন চিরসবুজ। ছবি: ফেসবুক থেকে
-
১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওরে তার জন্ম। বাবা আজগার হোসেন পাঠানের ছিল সাত সন্তানের পরিবার পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। শৈশবের কিছু সময় মানিকগঞ্জে কাটলেও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে। এখানেই গড়ে ওঠে তার মাটির কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিত্ব, যা পর্দার চরিত্রে বারবার ফিরে এসেছে।
-
১৯৭১ সালে এইচ আকবরের জলছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হলেও, ফারুকের প্রকৃত উত্থান ১৯৭৫ সালে সুজন সখী সিনেমায়। খান আতাউর রহমানের পরিচালনায় সুজন চরিত্রে তার অভিনয় ছিল জীবনঘনিষ্ঠ ও আবেগময়। কবরীর সঙ্গে তার অনবদ্য রসায়ন দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।
-
এরপর নয়নমনি, সারেং বৌ প্রতিটি চরিত্র যেন তিনি নিজের মতো করে বাঁচিয়ে তুলতেন। শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে সারেং বৌ-তে কদম সারেং চরিত্র তাকে ক্ল্যাসিক অভিনেতাদের কাতারে নিয়ে যায়।
-
পর্দার ‘মিয়াভাই’ হলেও তার আসল নাম ছিল আকবর হোসেন পাঠান দুলু। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর চলচ্চিত্রজগতের প্রয়োজন মিশে নতুন নামের জন্ম দেয় ‘ফারুক’। অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর এবং এক বন্ধু মিলে তাকে এই নাম দেন।
-
সিনেমার বাইরে ফারুক সক্রিয় ছিলেন রাজনীতিতেও। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পদে এবং বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি।
-
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনীতির মঞ্চেও তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
-
১৯৭৫ সালে লাঠিয়াল ছবিতে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ফারুক। ২০১৮ সালে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। তার মতো নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী খুঁজে পাওয়া কঠিন বলে মনে করেন চলচ্চিত্র বিশ্লেষকেরা।
-
সফল ক্যারিয়ারের পরও জীবনের শেষ কয়েক বছর ছিল কষ্টময়। দীর্ঘ অসুস্থতা তাকে শারীরিকভাবে কাবু করলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে দেননি। চিকিৎসার ব্যয়ভার মেটাতে বিক্রি করেছিলেন জমি-সম্পত্তি। অথচ সবার সামনে ছিলেন একই হাসিখুশি মানুষ, যিনি আনন্দে মেতে থাকতে জানতেন।
-
২০২১ সালের মার্চে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিঙ্গাপুর গেলে তার রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। পরে মস্তিষ্কেও সংক্রমণ দেখা দেয়। দীর্ঘ আট বছরের চিকিৎসার পর ২০২৩ সালের ১৫ মে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
-
ফারুকের জীবনী যেন গ্রামীণ গল্পের মতো সরল, আন্তরিক অথচ গভীর আবেগে ভরা। সিনেমার নায়ক থেকে রাজনীতির মানুষ সবখানেই তিনি ছিলেন প্রিয়মুখ। আজ তিনি নেই, কিন্তু ‘মিয়াভাই’ নামটা এখনও সিনেমা ভক্তদের মনে ঠিক একই আবেগে উচ্চারিত হয়।