ভাঙা হৃদয়ের নায়িকা, অমর ভালোবাসার নাম মীনা কুমারী
যাদের হৃদয় কাঁদতে জানে, তাদের পক্ষে মীনা কুমারীকে ভোলা কখনোই সম্ভব নয়। রুপালি পর্দার ট্র্যাজেডি কুইন, যিনি ছিলেন শুধু একজন অভিনেত্রী নন, একজন কবি, প্রেমিকা, ব্যথিত আত্মা। যার চোখে ছিল দীর্ঘশ্বাস, হাসিতে ছিল বিষাদ, আর অভিনয়ে ছিল জীবনের রক্ত-মাংস ছোঁয়া বাস্তবতা। মীনা কুমারী ছিলেন এমন এক নাম, যার ব্যক্তিগত জীবন যেন হুবহু মিল খুঁজে পায় তার সিনেমার চরিত্রগুলোর সঙ্গে। ভাঙা হৃদয়ের এক নিঃসঙ্গ রমণী, যার ভালোবাসা অপূর্ণ কিন্তু তার ভালোবাসার শক্তিই তাকে অমর করে রেখেছে। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া থেকে
-
১৯৩৩ সালের এই দিনে বোম্বে শহরে মেহজাবিন বানুর জন্ম। ভাগ্য এমনভাবে তাকে গড়ে তুলেছিল যে, অভিনয় ছিল তার অনিবার্য নিয়তি। মাত্র চার বছর বয়সে শিশুশিল্পী হিসেবে সিনেমায় অভিষেক, তারপর একে একে ‘বাইজু বাওরা’, ‘সাহিব বিবি অউর গুলাম’, ‘পাকিজা’, ‘মেরে আপনে’ প্রতিটি ছবিই যেন তাকে গড়ে তুলেছে একজন শিল্পীর মূর্ত প্রতীক হিসেবে।
-
১৯৩৯ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে ‘ফারজানদ-এ-ওয়াতন’ চলচ্চিত্রে বেবি মীনা নাম নিয়ে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। কামাল আমরোহী পরিচালিত পাকিজা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র। ছবিটি তার মৃত্যুর তিন সপ্তাহ আগে মুক্তি পায়।
-
তার অভিনয়ে ছিল না কোনো সাজানো ছাঁচ, ছিল কেবল অনুভবের নিখাদ সত্যতা। যে নারী ‘পাকিজা’য় বলে, ‘আপ কা নাম শুনা, কঁহি দেখা নেহি...!’ সে আসলে নিজের জীবনেই খুঁজছিল কাউকে, যে তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসবে। কিন্তু সে ভালোবাসা কি কখনো মীনা কুমারীর জীবনে এসেছিল?
-
মীনা কুমারীর জীবনের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় তার বৈবাহিক সম্পর্ক, পরিচালক কামাল আমরোহীর সঙ্গে। শুরুটা ছিল কাব্যের মতো, কিন্তু শেষটা হয়ে ওঠে এক বিষণ্ণ উপাখ্যান। প্রেম, অভিমান, অবহেলা, বিচ্ছেদ-সব মিলিয়ে এই সম্পর্ক তার ভেতরে এক গভীর শূন্যতা রেখে যায়। এই শূন্যতা তিনি পূরণ করতেন কবিতা লিখে, ডায়েরির পাতায় নিজের কষ্ট ঢেলে দিয়ে কিংবা রাতে একাকী মদে ডুবে থেকে।
-
অনেকেই জানেন না, মীনা কুমারী ছিলেন এক অসাধারণ কবি। তিনি উর্দুতে লিখতেন, ছদ্মনাম ছিল ‘নাজ’। তার কবিতায় বারবার ফিরে আসে বিষাদ, বিচ্ছেদ, ভালোবাসার হাহাকার।
-
একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘তোমার নাম বললে আমার ঠোঁটে বিষ জমে, তবুও প্রতিদিন সেই বিষ আমি পান করি ভালোবেসে!’-এটাই ছিল তার প্রেম। আত্মবিসর্জনের প্রেম, নিঃশর্ত প্রেম।
-
‘পাকিজা’ শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, মীনা কুমারীর জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই সিনেমা তিনি শেষ করেছিলেন মৃত্যুর কিছুদিন আগেই, শরীর আর মন তখন প্রায় বিধ্বস্ত। তবুও ‘পাকিজা’ দেখলে বোঝা যায়, একজন শিল্পী কিভাবে নিজের ক্ষত থেকে সৌন্দর্য তৈরি করতে পারেন। চোখে কাজল, ঠোঁটে নীরব অভিমান, আর দৃষ্টিতে এক আদি প্রেমের উন্মাদনা-এই মীনা কুমারী আজও দর্শকদের হৃদয়ে গেঁথে আছেন।
-
মীনা কুমারীর জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে নিঃসঙ্গতা আর অসুস্থতায়। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন ১৯৭২ সালের ৩১ মার্চ। তার অন্তিম জীবন ছিল এক করুণ প্রহসন, যেখানে মানুষের ভালোবাসার অভাব, নিজের জীবনের বোঝা আর অন্ধকার একাকীত্ব মিলে তৈরি করেছিল এক নিস্তব্ধ মৃত্যু।
-
মীনা কুমারীর মৃত্যু হয়েছে বহু বছর আগেই, কিন্তু তিনি রয়ে গেছেন আমাদের হৃদয়ে। তার চোখের ভাষা, কবিতা, চরিত্রের গভীরতা আজও কাঁদায়, ভাবায়, ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়। তিনি যেন ভালোবাসার সেই প্রতীক, যে ভালোবাসা পূর্ণ না হলেও অমর হয়।