জামায়াতের সঙ্গে জোট, একে একে সরে যাচ্ছেন এনসিপি নেত্রীরা
এখনও চোখে ভাসছে ২০২৪ সালে কোটা আন্দোলনের সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের আন্দোলনকারীদের তুলে নিয়ে পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার ছবি। সেই ছবিতে দেখা যায় এখনকার জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুমকে। এরপর বহু রক্তপাতের ঘটনা। কোটা আন্দোলনের জেরে হাসিনা সরকারের পতন, ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পথে হাঁটা, আবার নতুন করে দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়েছিলেন তাবাসসুমের মতো জুলাই যোদ্ধারা। অথচ দেশের কাঙ্ক্ষিত ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একে একে দলের কাছ থেকে সরছেন তারা।
জামায়াত-এনসিপির জোট
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দলের সঙ্গে জোট বেঁধেছে এনসিপি ও কর্নেল (অব.) অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির নির্বাচনি সমঝোতা হয়েছে, যদিও আসন চূড়ান্ত হয়নি। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য ও বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে জামায়াতসহ সমমনা আট দলের সঙ্গে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন।
নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, নতুন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার চক্রান্ত চলছে। এই জুলাই প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তারা চক্রান্ত করছে। সেদিন ওসমান হাদির গায়ে গুলি লেগেছে। কালকে আপনার গায়ে লাগবে, পরশুদিন আমার গায়ে লাগবে। কারণ প্রথম এবং প্রধান টার্গেট করা হচ্ছে এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা অংশগ্রহণ করেছে। এই মুহূর্তে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য, প্রতিযোগিতাপূর্ণ করার জন্য এবং আধিপত্যবাদী কোনো শক্তি আমাদের এই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অগ্রযাত্রাকে যাতে ঠেকাতে না পারে সেজন্য আমাদের বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন। সেই তাগিদ থেকেই আমরা জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের যে সমমনা আট দল রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের নির্বাচনি সমঝোতায় জাতীয় নাগরিক পার্টি সম্মত হয়েছে।
এদিকে, এনসিপির এই সিদ্ধান্তে দলের অনেকের মধ্যে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অনেকে নির্বাচনি কার্যক্রম থেকে নিজেকে নিষ্ক্রিয় রাখার কথা বলেছেন, অনেকে ছাড়ছেন দল।
আরও পড়ুন:
বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে জামায়াতসহ ৮ দলের সঙ্গে নির্বাচন করবো
এনসিপির নির্বাচনকালীন কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়ালেন নুসরাত
নুসরাত তাবাসসুম
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোটের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দলের সব নির্বাচনি কার্যক্রম থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম। রোববার (২৮ ডিসেম্বর) রাতে নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে নুসরাত তাবাসসুম অভিযোগ করে লেখেন, ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন জোটবদ্ধ হওয়া তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একধরনের ‘প্রবঞ্চনা’।
নুসরাত তাবাসসুম আরও লেখেন, ‘আমি খুব সংক্ষেপে কিছু বিষয় জানাতে চাই। এনসিপি তার জন্মলগ্নে আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছে। গণতন্ত্রের সুষম চর্চা, নয়া বন্দোবস্ত, মধ্যপন্থা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা, সভ্যতাকেন্দ্রিক সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ এবং সর্বোপরি বাংলাদেশপন্থা নিয়ে। এই প্রতিটা শব্দ আমি আমার মননে, মগজে এবং যাপনে ধারণ করি, এই শব্দগুলো আমার রাজনৈতিক স্বপ্ন। এনসিপির ঘোষণাপত্র থেকে শুরু করে এর সবগুলো লিটারেচার এই বক্তব্য ধারণ করে৷ এনসিপি গঠনের সময় এটি ঠিক তাই ছিল যা আমি চেয়েছিলাম।’
নুসরাত তাবাসসুম লেখেন, ‘এ সমস্ত ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে আমি নুসরাত তাবাসসুম, (যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি) নিজেকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচনকালীন সময়ে পার্টির সকল কার্যক্রম থেকে নিষ্ক্রিয় করছি। এবং অবস্থা পুনর্বিবেচনাক্রমে যে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘোষণা করছি।’
ডা. তাসনিম জারার পদত্যাগ
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা ঢাকা-৯ আসন থেকে নির্বাচন করার লক্ষ্যে এনসিপির মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু এনসিপি জামায়াতের সঙ্গে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) তিনি ও তার স্বামী এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ দল থেকে পদত্যাগ করেন।
শনিবার সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক আবেগঘন পোস্টে তাসনিম জারা জানান, কোনো দল বা জোটের হয়ে নয়, বরং ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবেই ঢাকা-৯ আসনের জনগণের মুখোমুখি হতে চান তিনি।
খিলগাঁও, সবুজবাগ ও মুগদাবাসীর উদ্দেশে ডা. জারা লেখেন, ‘আমি আপনাদের ঘরের মেয়ে। খিলগাঁওয়েই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আমার স্বপ্ন ছিল একটি দলের প্ল্যাটফর্ম থেকে এলাকার মানুষের সেবা করা। তবে বাস্তবিক প্রেক্ষাপটের কারণে আমি কোনো নির্দিষ্ট দল বা জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
ডা. তাজনূভা জাবীন
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাজনূভা জাবীনও দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। রোববার (২৮ ডিসেম্বর) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। তিনি লেখেন, ‘আপনারা অনেকে ভাবছেন, হয়তো জামায়াতের সাথে জোটে ঐতিহাসিক কারণ বা নারী বিষয়ের কারণে আমার আপত্তি। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর যে কারণ, সেটা হল যে প্রক্রিয়ায় এটা হয়েছে। এটাকে রাজনৈতিক কৌশল, নির্বাচনী জোট ইত্যাদি লেভেল দেয়া হচ্ছে। আমি বলব এটা পরিকল্পিত। এটাকে সাজিয়ে এ পর্যন্ত আনা হয়েছে। এটা আদর্শের চেয়েও অনেক বড়, সেটা হল বিশ্বাস। মাত্র কিছুদিন আগে সমারোহে সারাদেশ থেকে মনোনয়ন সংগ্রহের ডাক দিয়ে ১২৫ জনকে মনোনয়ন দিয়ে ৩০ জনের জন্য সীট সমঝোতা করে বাকিদের নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তে সীল মোহর বসানো হয়েছে। বিষয়টা ঠেলতে ঠেলতে একদম শেষ অবধি এনেছে যাতে কেউ স্বতন্ত্র নির্বাচনও করতে না পারে। আমার অবশ্য এই মুহূর্তে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ইচ্ছা নাই। পুরো আগোছালো করে চোখের পলকে ডিসওউন করে দিয়েছে।’
আরও পড়ুন:
এবার এনসিপি থেকে পদত্যাগ করলেন তাজনূভা জাবীন
তাজনূভা লেখেন ‘নিজেরও ভাল লাগছে না, এভাবে ছেড়ে যেতে। কিন্ত যারা এই দেশ, এই সংসদই চায় নাই তাদের সমঝোতায় একদম শুরুতেই এমপি হতে চাওয়া, বা যারা এদের কল্যাণে এমপি হওয়ার জন্য হাভাইত্তার মতো করছে তাদের নেতৃত্ব মানা আমার পক্ষে ঠিক গণঅভ্যুত্থানের পরের বছর অসম্ভব। এই জিনিস হজম করে মরতেও পারব না আমি। আমার নেতা হবে মাজাওয়ালা, জুলাই রাজনীতির ধারক। কিন্তু পুরো জুলাইকে নিয়ে রাজনৈতিক কৌশলের নাম করে তুলে দিচ্ছে জামায়াতের হাতে। আবার নাকি বাউন্স ব্যাক করবে। হাস্যকর। বিএনপি, এই জামাতের সাথে জোট করে ১৭ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে ছিল। আর বিএনপির অধীনে জামায়াতের সাথে জোট হয়েছিল। জামায়াতের অধীনে না। যেখানে এনসিপিকে বলাই হয় জামায়াতের আরেকটা দোকান, তাহলে কেন এনসিপি আগে নিজের স্বকীয়তা, নিজের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জামায়াতকে বেছে নিতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছে? তিনজন মন্ত্রী ছিল না ক্ষমতায়? পারে নাই তো।’
নির্বাচনে অংশ নেবেন না মনজিলা সুলতানা ঝুমা
খাগড়াছড়ি থেকে মনোনয়ন পেয়েও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এনসিপির আরেক নেত্রী অ্যাডভোকেট মনজিলা সুলতানা ঝুমা। রোববার দিবাগত রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ ঘোষণা দেন। তিনি লেখেন, এনসিপি প্রাথমিকভাবে যেই ১২৫ আসনে মনোনয়ন দিয়েছিলো তার মধ্যে খাগড়াছড়ি ২৯৮নং আসনে শাপলা কলি মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতে আমাকে মনোনীত করেছিল। ২৪ তারিখে আমার পক্ষে আমার দলের খাগড়াছড়ি জেলার আহ্বায়ক মনোনয়ন উত্তোলন করেছে। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি না।
আরও পড়ুন
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন এনসিপি নেত্রী ঝুমা
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন এনসিপি নেত্রী মনিরা শারমিন
মনিরা শারমিন
জামায়াতের সঙ্গে জোট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এনসিপির হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন নওগাঁ-৫ আসনে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ও দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন। রোববার সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে তিনি এ ঘোষণা দেন।
মনিরা শারমিন লেখেন, আসসালামু আলাইকুম। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষায় গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী একমাত্র মধ্যপন্থি রাজনীতির ভরসাস্থল ছিল। এই দল থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে নওগাঁ-৫ থেকে আমি মনোনীত প্রার্থী। তবে মনোনয়ন পাওয়ার আগে আমি জানতাম না, এই দল জামায়াতের সঙ্গে ৩০ সিটের আসন সমঝোতা করবে। আমি জানতাম, ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে একক নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ছিল।
তিনি লেখেন, যেহেতু এখন দলের পজিশন পরিবর্তন হয়েছে, তাই আমি নিজেকে নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করছি। নির্বাচনে আমি অংশগ্রহণ করছি না। আমি এনসিপির স্বতন্ত্র শক্তিতে বিশ্বাসী। দলের প্রতি আমার কমিটমেন্ট আমি ভাঙিনি। কিন্তু এই মুহূর্তে দলের প্রতি কমিটমেন্ট এর চেয়ে আমার গণ-অভ্যুত্থানের প্রতি কমিটমেন্ট ও দেশের মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও লেখেন, আমি কিছুদিন আগে ক্রাউড ফান্ডিং করে নির্বাচনের অনুদান নিয়েছি। আমাকে যারা অনুদান দিয়েছেন, তারা এনসিপির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান দেখে ডোনেট করেছেন। যারা নিজেদের ডোনেশন ফেরত চান, তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা। সেই সংখ্যাটা ১ জন হলেও আমার দায়বদ্ধতা হলো অনুদানের অর্থ ফেরত দেওয়া। আমি দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনুদানের অর্থ ফেরত দেব বিকাশের মাধ্যমে। যারা আমাকে অনুদান দিয়েছেন, আমার কঠিন পথে সাহস যুগিয়েছেন, অনেক আশার কথা লিখেছেন, তাদের এই মুহূর্তের জন্য হতাশ করায় আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তবে জানবেন, আমি ক্ষমতার রাজনীতি করতে আসিনি। রাজনীতি পরিবর্তনের বয়ান দিয়ে সিট ভাগাভাগি করে ক্ষমতায় যেয়ে নিজেদের দলের প্রতি, মানুষের প্রতি বেইনসাফি করব না। জনতার কথা ও নতুন রাজনীতির কথা আপনাদের হয়ে বলতে থাকবো ইনশা আল্লাহ।
মনিরা শারমিন লেখেন, আমি দল থেকে পদত্যাগ করার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। এনসিপি কারো একার সম্পত্তি না। এনসিপি যতখানি শীর্ষ নেতৃত্বের, তার থেকে অনেক বেশি আমার। আজ পর্যন্ত এমন কিছু বলিনি বা করিনি যাতে আমার দল বিতর্কিত হয়। তবে নিজের নৈতিকতা বিক্রি করে রাজনীতি করতে চাই না, ক্ষমতায় যেতে চাই না। দোয়া করবেন।
এসএনআর/এমএমএআর/জেআইএম