আত্মজার প্রতি


প্রকাশিত: ০৫:০১ এএম, ১৩ মার্চ ২০১৬

আমি একজন খুব সহজ সাধারণ পাঠক। সহজ সাধারণ লেখাগুলো আমাকে খুব সহজে স্পর্শ করে। অনেক সহজ লেখার মাঝে আমি মাঝে মধ্যে পেয়ে যাই জীবনের কঠিন সত্য। আমার প্রিয় কবি বা লেখক যখন আমার মনের কথাগুলো হুবহু লিখে ফেলেন, মনে হয় আমরা যেন কতদিনের চেনা।

আর তাই রফিক আজাদ আমার একজন প্রিয় কবি। স্কুল থেকেই তাঁর লেখা পড়েছি, এখনো পড়ছি। সর্বাংশে আধুনিক হয়েও আবহমান বাংলার মৃত্তিকায় গভীরভাবে প্রোথিত তাঁর আবেগ। আর তাই আহত হয়ে, আঘাত প্রাপ্ত হয়ে অসম্ভব কঠিন হয়ে যায় তাঁর উচ্চারণ।

"গ্রাম- গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত,
চলাচলকারি পথচারী, নিতম্ব- প্রধান নারী,
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্য মন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি--
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।
ভাত দে হারামজাদা, তা- না হ`লে মানচিত্র খাবো।"

মাটির নৈকট্যে থেকে মাটির সোঁদা গন্ধ বুকে নিয়ে বেড়ে ওঠা রফিক আজাদের বিনীত জীবন। যে জীবন দেখেছেন জীবনানন্দ, যে জীবনের কথা বলেন শঙ্খ ঘোষ, সুনীল কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কত সহজে আমার কবি রফিক আজাদ সে জীবনের সমুদ্রায়ন, চুনিয়া আর গভির অরন্যে হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।

মানুষের ভিতরকার গহীন আলো অন্ধকার নিয়ে তাঁর লেখাগুলো আমাকে বিচলিত করেছে বারবার। তাঁর শব্দগুলো ছিল বড় অসহায়। মর্ষকামী। তারি মাঝে তিনি তুলে এনেছেন ডাহুকের ডাক, টুনটুনি আর মাকড়শার জলের রুপমা।

"বসন্তের কোকিলের মতো কণ্ঠে তো ফোটাতে চাই
অমৃত সঙ্গীত...
পরিনামে কেন যে সকর্নে শুনতে পাই অবিরাম
কাকের কঠোর রব! "

রফিক আজাদ কি পরাবাস্তবতাতে বিশ্বাস করতেন? তিনি তো প্রায়ই দেখেছেন নদী তীরে প্রশস্থ রাস্তার পাশে স্বপ্নের বাড়ি। যে বাড়ির পাশ ঘেঁষে বয়ে যায় ঘৃণার মিছিল, দুঃখের মিছিল। যেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা!

একজন মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদের স্বাধীনতার কবিতা আমার প্রিয় কবিতাগুলোর কয়েকটি। যখনই প্রথম পড়েছিলাম  ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ’ সেদিন থেকেই তিনি আমার প্রিয় কবিদের একজন হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর `নেবে স্বাধীনতা` তে আমি আমাকে দেখি। বারবার দেখি।

" নেবে স্বাধীনতা? -- নাও, তোমাকে দিলাম
সবুজ সংকেতময় নীল পাসপোর্ট--- সুনিশ্চিত স্বাধীনতা,
`গুডবাই বাংলাদেশ" - বলে তুমি খুব অনায়াসে
চলে যেতে পারো যে কোন আকাশে; তবে
তোমাকে ছাড়তে হবে একুশের মায়া,
দ্বাদশ মাসের ষোল, মার্চের ছাব্বিশ---
সারি সারি গাছপালা, স্বদেশের হাওয়া..."

জীবনে দুঃখ থাকে, থাকে দীর্ঘশ্বাস।তাদেরকে গান হতে বলেন রফিক আজাদ। গান হতে বলেন তিনি সঙ্কীর্ণতাকে, বিপন্ন মানুষের জীবনকে, আবেগের উত্থান পতনকে। সে গানের সুরে থাকে আমদের ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া কিংবা বাউলের সুর।

‘‘গান হ`তে বলি আজ দীর্ঘশ্বাস গুলিকে আমার
সম্পূর্ণ লোকজ গীতি---ভাওয়াইয়া  কিংবা ভাটিয়ালি--
দেশজ, ঐতিহ্যময় , লোকায়ত গীতিকার  মতো।’’

আমাদের  নগরকেন্দ্রিক জীবনের দীর্ঘশ্বাস, হাহাকারগুলোকে কবি পদে পদে অনুভব করতেন। অতিব্যস্ত  এই নগরসত্তায় বৃষ্টি চাইতেন আমার কবি। তিনি চাইতেন নাগরিকদের মননে মননে বৃষ্টি। তিনি মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন সে বৃষ্টির জলে নবজন্ম পাবে আমাদের পঙ্কিল জীবন। অবিরল ধারাপাত চেয়েছিলেন তিনি।

‘‘অবিরল ধারাপাত নগরের নিরেট হৃদয়
পালটে দিতে পারে; এখন তো মনে হয়
বৃষ্টি আর বৃষ্টি শুধু একমাত্র আরাধ্য সবার।"

টাঙ্গাইলের `গুণী` গ্রামে জন্ম হয়েছিল গুনী কবি রফিক আজাদের। মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকির সহযোগী ছিলেন তিনি। আজীবন মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন তিনি, মনন আর লেখাতে। সারাজীবন লড়তে বলেছিলেন তাঁর লেখাতে। নিজেও লড়েছেন। দীর্ঘ দু মাস মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করলেন তিনি। আমরন অনশন কারী আই,আর, এ সদস্য ববি স্যান্ডার্স যখন মারা যান, তখন চমৎকার একটি কবিতা লিখেছিলেন তিনি।

‘‘আমার হারিয়ে- যাওয়া, সারা বিশ্বময় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত
ছড়িয়ে- ছিটিয়ে থাকা কবিতাগুলোকে
আমি ফিরে পেতে চাই--
ফিরে পাওয়া বড় জরুরি;
ঐসব কবিতা ফিরে পেলে তবেই আমার
`কবিতা সমগ্র" প্রকাশ করতে পারি..."

আমার কবি রফিক আজাদ চলে গেলেন। পরজন্মে দেখা হলে আবার ‘কবিতা সমগ্রের’ কথা হবে কবির সাথে। চির শান্তিতে থাকুন আমাদের কবি।

লেখক : ডা. বিএম আতিকুজ্জামান, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি।

জেএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।