দিনাজপুর-১
সব দলে নির্বাচনী আমেজ, মনোনয়নপ্রত্যাশী এক ডজন
দিনাজপুর-১। জাতীয় সংসদের ৬ নম্বর আসন। নানান কারণে উত্তরের গুরুত্বপূর্ণ এ আসনে সব দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী আমেজ। বেড়েছে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় বেশি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নের জন্য মাঠে আছেন বর্তমান এমপিসহ চারজন। নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে না গিয়ে দলীয় মনোনয়ন পেতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন অন্তত বিএনপির তিনজন প্রথম সারির নেতা। জাতীয় পার্টি, জামায়াত (স্বতন্ত্র হিসেবে) ও ইসলামী আন্দোলনও আলাদা প্রার্থী দিতে প্রস্তুত।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও কাহারোল উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনের চিত্রটা একটু আলাদা। এ আসনে ৪২ শতাংশ ভোটার সনাতন ধর্মাবলম্বী। আসনটিতে ময়মনসিংহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ গাইবান্ধা, রংপুর, নোয়াখালী, ঢাকা ও বগুড়া জেলার মানুষের বসবাস রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। তাদের জেলার সঙ্গে মিলিয়ে রয়েছে পাড়ার নামও।
১৯৭৭ সালে হ্যাঁ/না ভোটে দেশের সব জায়গায় হ্যাঁ নির্বাচিত হলেও কাহারোল উপজেলায় না জয়লাভ করে। তাই এ আসনে প্রার্থী নির্বাচনে সব দল বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করে। তবে আশার কথা হলো, আসনটিতে কোনো টেন্ডারবাজি, দলবাজি, দখলবাজি বা গডফাদার নেই।
আরও পড়ুন>> ঢাকা-৮/অভিভাবক খুঁজছে আওয়ামী লীগ, মনোনয়নে এগিয়ে মেনন
বরাবরই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবেই পরিচিত এ আসন। এখান থেকে টানা চারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের মনোরঞ্জন শীল গোপাল। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়গুলোতে এ আসনটি বেশিরভাগ সময়ই দখলে ছিল আওয়ামী লীগের। তবে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোন্দলের কারণে জামায়াতের প্রার্থী জয়ী হন।
জনশ্রুতি রয়েছে, ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলের কারণেই জামায়াত নেতা আব্দুল্লাহেল কাফী জয়লাভ করেন এবং প্রয়াত আব্দুর রৌফ চৌধুরী (বর্তমান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা) পরাজিত হন। এবারও আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল কাজে লাগিয়ে আসনটি নিজেদের দখলে নিতে চায় বিএনপি।
১৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ আসনটিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বর্তমান সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালসহ প্রার্থী হতে চান আরও তিনজন। বিএনপির টিকিট নিয়েও প্রার্থী হওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন তিনজন। এছাড়া জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একজন করে প্রার্থী আছেন।
আরও পড়ুন>> ঢাকা-৩/সমস্যা গ্যাস-দূষণ, মনোনয়নে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নসরুল হামিদ
এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল, বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকারিয়া জাকা, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও বর্তমান বীরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির কৃষিবিষয়ক সম্পাদক আবু হুসাইন বিপু।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন বীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি শিল্পপতি মনজুরুল ইসলাম মনজু, বীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ধলু ও বিএনপি নেতা রেজওয়ানুল ইসলাম রিজু।
এছাড়া এ আসন থেকে প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান বীরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহিনুর ইসলাম, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির আব্দুল হক সরকার ও বীরগঞ্জ উপজেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি খোদা বক্স এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আশরাফুল আলম।
মজার বিষয়, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল কাহারোল উপজেলার বাসিন্দা, বাকি সবাই বীরগঞ্জ উপজেলার অধিবাসী।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী যারা
জামায়াতের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহহেল কাফী মারা গেলে ২০০৫ সালের উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মনোরঞ্জন শীল গোপাল। এক সময় তিনি জাতীয় পার্টির নেতা থাকলেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর থেকে বর্তমান মেয়াদ পর্যন্ত টানা সংসদ সদস্য তিনি।
প্রায় ২২ বছর সংসদ সদস্য থাকার সুবাদে মনোরঞ্জন শীল গোপাল এলাকায় রাস্তাঘাট পাকাকরণ, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ, বিদ্যুতায়ন, নতুন স্কুল-কলেজ-মাদরাসা নির্মাণ এবং ভবনের উন্নয়ন, শিল্পকলা একাডেমির নতুন ভবন, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, উপজেলা কমপ্লেক্স নির্মাণ, ফায়ার স্টেশন, গুচ্ছগ্রামসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। বৃদ্ধাশ্রম ও গরিব-দুস্থদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে হাসপাতাল নির্মাণ করে ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন।
কয়েকবারের বন্যায় ও করোনাকালীন মনোরঞ্জন শীল গোপাল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজ হাতে ত্রাণ ও সহায়তা পৌঁছে দেন। আগামী নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে দলের বিজয়ের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে তিনি কাজ করছেন। তার ব্যক্তিগত ইমেজ এবং উন্নয়নের কারণে এলাকায় শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে।
এসব বিষয়ে মনোরঞ্জন শীল গোপাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ এলাকায় যে ধরনের উন্নয়ন হয়েছে, তা বিগত কোনো সরকারের আমলে হয়নি। তাছাড়া এলাকার তৃণমূল মানুষের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। উন্নয়নের এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে নৌকা মার্কার কোনো বিকল্প নেই। এই মার্কার মনোনয়ন আমি পাবো বলে আশা রাখছি। জয়ের সম্ভাবনা শতভাগ।’
আরও পড়ুন>> বিএনপিকে মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন, দুই বিবেচনায় গুরুত্ব
দলের কোন্দল বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার কোনো কোন্দল নেই। তবে বড় দল হিসেবে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজেদের তুলে ধরতে গিয়ে নিজের অজান্তেই অনেক সময় দলের বিপক্ষে চলে যাচ্ছেন। আমরা যে যে দল থেকেই নির্বাচন করি না কেন, প্রার্থী হিসেবে অবশ্যই আচরণ হতে হবে রাজনৈতিক।’
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকারিয়া জাকা বলেন, ‘এ আসনে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো কোন্দল নেই। যেটা ছিল, সেটা ভুল বোঝাবুঝি। আগামী সংসদ নির্বাচনে দলে মনোনয়ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো। না হলে দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই কাজ করবো।’
সাবেক সংসদ সদস্য ও বীরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৯৯১ সালে আমি এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম, তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এলাকার মানুষ ভালোবাসে, তাই দলীয় মনোনয়ন পেলে এ আসন থেকে নির্বাচন করবো। যদি মনোনয়ন না দেয়, তাহলে কেন্দ্র থেকে যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে তার পক্ষ হয়েই কাজ করবো।’
সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন বিপু। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নেত্রীর নির্দেশে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তাই দলীয় প্রার্থী যিনিই হোক, তাকে বিজয়ী করতে সবাইকে নিয়ে কাজ করবো।’
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী তিনজন
বিএনপির তিন প্রার্থী মনোনয়ন পাওয়ার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে বীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি মনজুরুল ইসলাম মনজুর অবস্থান অনেক ভালো। আগামী নির্বাচন ঘিরে বিএনপির যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে রয়েছেন তিনি। কেউ তার কাছে সহযোগিতা চাইলে খালি হাতে ফেরান না, তার এমন সুনামও রয়েছে এলাকায়।
এ আসনে বিএনপির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী বীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ধলু। এলাকার মাঠপর্যায়ে রয়েছে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তার ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে বীরগঞ্জ। বিএনপির মাঠ পর্যায়ের অন্য নেতা রেজওয়ানুল ইসলাম রিজু ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা হিসেবে এলাকায় পরিচিত। এই তিন প্রার্থীই চান আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে আসনটি নিজেদের ঘরে তুলতে।
বিএনপি নেতা মনজুরুল ইসলাম মনজু বলেন, ‘এ আসনে আওয়ামী লীগের অবস্থান আগের মতো নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমি এ এলাকার মানুষের সুখে-দুখে পাশে থেকে কাজ করছি। যদি দল থেকে মনোনয়ন পাই, তাহলে জয়ের সম্ভাবনা শতভাগ। নির্বাচিত হয়ে আমার প্রথম কাজ হবে দুর্নীতি দূর করা। একই সঙ্গে নির্বাচিত হয়েই এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করবো।’
বিএনপির অন্য নেতা জাকির হোসেন ধলু জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেলে তিনি এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। বীরগঞ্জ-কাহারোলে বিএনপিকে টিকিয়ে রাখার পূর্বশর্ত তাকে ধানের শীষের মনোনয়ন দেওয়া।
বিএনপি নেতা রেজওয়ানুল ইসলাম রিজু জানান, দল তাকে মনোনয়ন দিলে জয় সুনিশ্চিত। তবে দল যাকেই মনোনয়ন দেবে, সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েই তিনি কাজ করবেন।
এ আসন থেকে বীরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহিনুর ইসলাম আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। দল সুসংগঠিত করার পাশাপাশি দলীয় প্রার্থী হিসেবে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন তিনি।
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে আমি এ আসন থেকে নির্বাচন করবো। এখানে জাতীয় পার্টির সিংহভাগ ভোট ছিল এবং এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে দুটি স্কুল জাতীয়করণসহ ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আমি নির্বাচিত হলে সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। এখানে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন্দল রয়েছে, সেই দুর্বলতায় আমার বিজয় আসার সম্ভাবনা রয়েছে।’
জামায়াত থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বীরগঞ্জ উপজেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি মো. খোদা বক্সের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আশরাফুল আলমও নির্বাচন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে।
দিনাজপুর-১ আসনে এবার মোট ভোটার তিন লাখ ৪৪ হাজার ৫২। এর মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৭২ হাজার ৫৪০ এবং নারী ভোটার এক লাখ ৭১ হাজার ৫১২ জন।
এমদাদুল হক মিলন/এএসএ/জিকেএস