মাকে ছেড়ে প্রবাস জীবন

প্রবাসে আসার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার আহ্বান করা হয়েছে। সে কথা শুনে পুরনো দিনের কাহিনি মনে পড়ে গেল। সিঙ্গাপুর থেকে যখন কেউ দেশে ফিরত তাদের মুখে শুনতাম দেশটি না কি খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। প্রতিদিন রাস্তাঘাট ধোয়া-মুছা হয়, খোলামেলা মদপান করা যায়, শটকার্টে বড়লোক হবার জন্য ক্যাসিনো আছে, ভিনদেশি মেয়েদের সাথে খুব সহজে বন্ধুত্ব করা যায়। তখনই সিদ্ধান্ত নেই জীবনে যদি কখনো প্রবাসে যাই তাহলে সিঙ্গাপুরেই যাব।
আর যদি প্রবাসে না যাওয়া হয়, তাহলে বেড়ানোর জন্য হলেও সিঙ্গাপুর যাব। আমার প্রথম ইচ্ছেই পূরণ হলো। তবে এমনভাবে পূরণ হোক আমি তা চাইনি। আমার অনার্স শেষ বর্ষের পরীক্ষা চলাকালীন মা হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোক করেন। শুধু একবার নয় পরপর দু’বার ব্রেন স্ট্রোক করে কোমায় চলে যান।
তখন আমার বড় ভাই মিজানুর রহমান (রিপন) সিঙ্গাপুর প্রবাসী। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে জরুরি ছুটি নিয়ে দেশে এসে মাকে কোমা অবস্থায় দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। বড় ভাই সবসময় ডাক্তার, নার্সের পেছনে ঘুরতে থাকেন। সব ডাক্তারই ভাইকে আশার বাণী শুনিয়ে বলল, উনি সুস্থ হবেন তবে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা চালিয়া যেতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী বলতে কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। ভাগ্য ভালো হলে দুই মাসেই মা সুস্থ হবেন আর খারাপ হলে, দুই বছরেও সুস্থ হবেন না। তবে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে প্রচুর টাকার প্রয়োজন।
ভাই আমাকে ডেকে বললেন, মা প্রায় বলত তোর নাকি সিঙ্গাপুর যাবার খুব ইচ্ছে। আমি মাথা নেড়ে সাই দিয়ে বললাম হুম। তাহলে সিঙ্গাপুর থেকে ডিমান্ড আসছে ইন্টারভিউ দিয়ে আয়।
অসুস্থ মাকে হাসপাতালে রেখেই তারপরের দিন ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য মিরপুর আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানির ওয়ার্কশপে গেলাম। আমি কোনো কাজ জানি না, আমি ইন্টারভিউ কি দেব, ভাবতেই কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ছে।
ইন্টারভিউ ভালোই হলো, খুশি মনে হাসপাতালে ফিরে আসি। মায়ের দিকে তাকিয়ে আমার কান্না চলে আসে। আমাকে যেভাবেই হোক বিদেশ যেতে হবে। বিদেশ না গেলে মায়ের চিকিৎসার ব্যয়ভার, ভাইয়ের পক্ষে একা বহন করা সম্ভব নয়।
দুইদিন পর আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি থেকে আমার মোবাইলে কল আসে, তারা আমাকে জানায় আমি সিঙ্গাপুর যাবার জন্য বাছাই হয়েছি।আমাকে আগামী সাত দিনের মধ্যে পাসপোর্ট আর মেডিকেল রিপোর্ট জমা দিতে হবে। এই খবর শোনার পর আনন্দে আমি কেঁদে ফেলি। যাক আল্লাহ এই দু:সময় আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন।
বাড়ির সবাইকে এই খবরটি জানালে সবাই আনন্দের সহিত চিন্তায় পড়ে যায়। আমার মেডিকেল, পাসপোর্ট, এজেন্সি ফি কোথায় থেকে সংগ্রহ করব। শ্বশুর বাড়ি, নুরু কাকা, বড় ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি আর মিজান ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সিঙ্গাপুরে যাবার সমস্ত বন্দোবস্ত করে ফেলি।
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য তার খাটের পাশে এসে দাঁড়ালাম। মা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছেন না। হাত পা তো অনেক আগেই নিস্তেজ। নল দিয়ে খাওয়া দাওয়া করানো হয়। মায়ের চাহনিতে আমি হাজার হাজার শব্দ দেখতে পাচ্ছি। ইতোমধ্যে মা হয়ত জেনে গেছে আমি প্রবাসে চলে যাচ্ছি। তার পুরো শরীর অবশ কিন্তু মস্তিস্ক এখনো সচল আছে। বাইরের জগতে কি ঘটছে তা তিনি দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। এ যেন জীবিত থেকেও মৃত্যুর সমতুল্য।
তবুও আমরা ভাই-বোনেরা মায়ের সুস্থতার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী। আমাদের মন বলছে, মাকে সঠিক চিকিৎসা আর সেবাই পারে সুস্থ করে তুলতে। তাই তো মাকে বাড়িতে না নিয়ে, বোনের বাড়িতে এনে তুলেছি। কারণ একজন মেয়ে তার মাকে যতটা সেবা করবে, পৃথিবীর সমস্ত পুত্রবধূরাও তা পারবে না।
তবে আমি অভিভূত হয়েছি মায়ের প্রতি ভগ্নিপতির ভালোবাসা আর সেবা শুশ্রূষা দেখে। আমরা ভাইয়েরা যা পারি না, দুলাভাই তাই করে দেখাচ্ছেন।
মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে দু’ফোটা চোখের পানি ফেলতে দেখে আমার বোন এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ভাই জানিস তোকে মা খুব ভালোবাসত, সবসময় বলত তুই জীবনে বড় কিছু হবি। আইনজীবী হয়ে অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দিবি। আমি চোখের পানি আড়াল করে বললাম, ‘সবার সব আশা পূর্ণ হয় নারে বোন। কিছু কিছু আশা ধরাছোঁয়ার বাহিরেই রয়ে যায়। আমি তো মায়ের চিকিৎসা করার জন্য বিদেশ যাচ্ছি।
বোন আর কোনো কথা বাড়ালেন না, মায়ের বিছানায় মাথার কাছে বসে আস্তে আস্তে বলল, ‘মা দেখ তোমার ছেলে বিদেশ যাচ্ছে, তোমার চিকিৎসার টাকা যোগাড় করার জন্য। মিজান ভাইয়ের পক্ষে একাকী তোমার চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।’ বোনের কথা শুনে মা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে মায়ের চোখের দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘মা আমি শিপন। তোমার আদরের ছেলে। এই হয়ত তোমার সাথে আমার শেষ দেখা। যদি তুমি সুস্থ হও তাহলে এসে দেখতে পাব। আর যদি আল্লাহ নিয়ে যায় তাহলে আর দেখা হবে না।’
আমার কথা শুনে মায়ের চোখ বেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়তে লাগল। মায়ের চোখে পানি দেখে, উপস্থিত সবার চোখে পানি এসে গেল। কিন্তু আমার চোখে কোনো পানি নেই। আমি পাষণ্ড হয়ে গেছি। মাকে এই অবস্থায় রেখে প্রবাসে যাচ্ছি, তাই সেই মুহূর্তে নিজেকে পাষণ্ড মনে হয়েছিল। আমি মায়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ মায়ের শরীরের ঘ্রাণ নিলাম। তারপর মায়ের কপালে শেষবারের মত চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সেখানে আর দাঁড়ালাম না, দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।
আমাকে কাঁদতে না দেখে, সবাই বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাদের কী করে বোঝাব আমার ভেতরটার কি অবস্থা। আমার মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষ। চিৎকার করে আল্লাহকে বলি হে আল্লাহ! আমার জীবনটা এমন হলো কেন? কিন্তু কিছুই না বলে চোখের পানি আড়াল করে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
ওমর ফারুকী শিপন/সিঙ্গাপুর থেকে/এমআরএম/জেআইএম