গন্তব্যের যাত্রা : যত লাইন, তত লাঞ্ছনা!

মুহাম্মাদ ইছমাইল
মুহাম্মাদ ইছমাইল মুহাম্মাদ ইছমাইল , আরব আমিরাত প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮:১৩ পিএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাবা কাঁদিস না। মা একটু পরই তোর কাছে চলে আসবে। কান্নার আবেগ ভরা কথার আওয়াজ কানে আসায় মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম পাশের লাইনে দাঁড়িয়ে আমিরাত গমনেচ্ছু এক মা তার শিশুসন্তানের সঙ্গে কথা বলছে।

তার কথা বলার দৃশ্য দেখে সত্যিই নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলাম না। কারণ ঠিক একই সময়ে ভাগ্য বিড়ম্বনায় আমিও সন্তান রেখে দেশান্তরী হচ্ছি। এমন সময়ে আমাকে ডাক দিয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কর্তব্যরত ইমিগ্রেশন পুলিশ অফিসার বললেন, আপনি ৩০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

বিজ্ঞাপন

জবাবে আমি বললাম, আপনি বিরতিতে যাওয়ার আগে তো এই লাইনে দাঁড়াতে বললেন, তাই বাধ্য হয়ে এখনো সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছি। এভাবে প্রতিদিন বিদেশ গমনেচ্ছু অনকে যাত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন দেশত্যাগের আগ মুহূর্তে, এমনকি বিমানে ওঠা পর্যন্ত, যা একজন প্রবাসীর জন্য বেদনাদায়ক।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

দেশীয় অর্থনীতির অন্যতম উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। জীবন-জীবিকার সন্ধানে স্বদেশ ছেড়ে স্বপ্নের জীবন সাজাতে বিশ্বের নানা প্রান্তে বসবাস করছেন প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি।

যারা মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন, গ্রাম-শহর ছেড়ে জীবন-যৌবনের স্বাদ-আহ্লাদকে ঘামের সাথে মুছে ফেলে বিদেশ পাড়ি জমান। যাদের রক্ত-ঘামে সচল থাকছে দেশের অর্থনীতি। তাদের দেশত্যাগ কতটা কষ্টকর কেবল ভুক্তভোগী ভালো বলতে পারে।

প্রিয়জনের সান্নিধ্য বা প্রিয়জনের সঙ্গে কিছুটা ভালো সময় কাটানোর জন্য প্রবাসীরা নিজ দেশে ছুটে আসেন এক থেকে ছয় মাসের জন্য। ছয় মাস ছুটি কাটান সৌদি আরব ও ইউরোপ আমেরিকা প্রবাসীরা। আমিরাত প্রবাসীদের বেলায়ও একই পদ্ধতি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

jagonews24

যে যতদিন থাকেন না কেন বেশিসংখ্যক প্রবাসী দেশে যান দুই থেকে পাঁচ বছর পর। অনেক দিন প্রবাসে অবস্থানের ফলে দেশে এসে স্বজনদের সাথে কিছুদিন থাকার পর মন যখন ভালোবাসায় ভরপুর হয়ে ওঠে তখনই নির্ধারিত ছুটি শেষ হয়ে বিদায়ের ঘণ্টা মনে নাড়া দেয়, যার ফলে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একজন প্রবাসী দেশ ত্যাগের প্রস্তুতি নেন। কারণ একজন প্রবাসী নিজের সুখের চেয়ে পরিবারের সুখকে বেশি প্রাধান্য দেন।

স্বজনদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট প্রতিটি প্রবাসীর মনে আঘাত করে। ফলে দেশত্যাগের ২ দিন আগে থেকে প্রবাসীর মন খারাপ থাকে। মন খারাপ নিয়ে যখন দেশত্যাগের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকতার জন্য বিমানবন্দরে যায় তখন প্রবাসীদের সঙ্গে চলে নানা ধরনের নাটকীয়তা।

এমনিতে বিমানবন্দরের নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে রেখে আসা আত্মীয়স্বজনদের থেকে বিদায় দিয়ে দুঃখ ভরা মন। এই উদাসীন মন নিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশের পর কেমন আচরণ হবে সেই ভয়ে মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

jagonews24

কাগজে-কলমে সোনার সন্তানরা কীভাবে এই বিমানবন্দরের কার্যক্রম শেষ করবে? স্বজন ত্যাগের দুঃখ ভুলে গিয়ে কত তাড়াতাড়ি বিমানে উঠবে সে উৎকণ্ঠায় থাকেন প্রবাসীরা।

প্রথমে গেটে ঢুকতে লাইন, লাইনে দাঁড় করিয়ে পাসপোর্ট আর টিকিট চেক করেন কর্তাবাবুরা, এরপর স্ক্যানিং মেশিনে একদিকে মানুষ অন্যদিকে পণ্যসামগ্রী স্ক্যান চলে। পণ্যসামগ্রী স্ক্যান করার পর কেন দেশ থেকে মাংস নিয়ে যান, এত মাংস কেন! মিষ্টি নিতে হয় নাকি! ওইখানে কি মিষ্টি নাই ইত্যাদি বলে অবশেষে ব্যাগেজে সিকিউরিটি চেক স্টিকার লাগিয়ে দেন।

বিজ্ঞাপন

তৃতীয় দফায় বোর্ডিং পাস সংগ্রহের লাইন, ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করেছিলাম। বোর্ডিং পাস সংগ্রহে পর ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের জন্য চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নিচতলা থেকে দ্বিতীয় তলায় উঠে আবার যথারীতি লাইনে দাঁড়াতে হয়।

jagonews24

লাইনে দাঁড়ানোর আগে লিফটের মাথায় কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার বোর্ডিং পাস আর পাসপোর্ট চেক করে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের লাইনে দাঁড়াতে বলেন। এখানেও কম করে হলে ৩০-৪০ মিনিট লাইনে দাঁড়াতে হবে।

বিজ্ঞাপন

ভাগ্য খারাপ হলে বাপ-দাদার আমলের মতো, হাতে লেখা Departure card, কার্ড না থাকলে কার্ড লেখার জন্য ইমিগ্রেশন অফিসার আবারো লাইনের বাইরে পাঠিয়ে কার্ড লিখে নিয়ে আসতে বলেন।

এক্ষেত্রে বিমানবন্দরের ভেতরে কাজ করা কিছু দালালের পকেট ভারী হয়, কলমের জন্য টাকা, ফরম লেখার জন্য টাকা! এক দালাল রসিকতায় বলেছিল ‘অন্যের তোন ১ হাজার টিয়া নিমুনি ৩-৪শ টেয়া দিলে চলইবো।’

দেশ ডিজিটাল হয়েছে অথচ হাতের লেখা ফরমের কি কাজ তা বুঝে আসে না। পাঁচ বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দরের তালিকায় শীর্ষে থাকা দুবাই বিমানবন্দরে কোনো সময়ে হাতে লেখা এমন কার্ডের কার্যক্রম চোখে পড়েনি।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে আরব আমিরাতে বাংলাদেশিদের ভিজিট ভিসা চালু থাকায় আসতে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের যারা ‘এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক’ করেন না তাদের বোর্ডিং পাস দেয়ার পরও কৌশলে আটকে দেয়া হয় তৃতীয় ধাফে। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে অনেকে।

jagonews24

ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের শেষ হলে আবারো লাইন। দ্বিতীয়বারের মতো স্ক্যানারে চেক। একদিকে যাত্রী, অন্যদিকে যাত্রীর সঙ্গে থাকা পণ্য, হ্যান্ড ব্যাগেজ স্ক্যান করা হয়। স্ক্যানারের গ্রিন সিগনালে যাত্রী অতিক্রম করলেও চেকিংয়ের দায়িত্বে থাকা অফিসাররা যাত্রীদের উপর নিচে কোনো কিছু বাদ দেন না।

বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের পাশাপাশি অনেক সহজ সরল প্রবাসীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতেও দেখা যায়। কিছু অফিসার বলেন, এত টাকা নিয়ে বিদেশ কেন যাচ্ছেন, এত টাকা নিতে পারবেন না। পরে স্যার নামীয় অন্য লোকের মধ্যস্থতায় কিছু টাকা দিয়ে প্রবাসী পার পায়। অবশেষে বোর্ডিং পাসের পেছনে সিকিউরিটি চেক সিল লাগিয়ে রেস্ট রুমের পথ দেখিয়ে দেন দেশান্তরী হওয়া এসব মানুষকে।

দ্বিতীয়বার চেকিং বা স্ক্যান করার যৌক্তিকতা কি? বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা অফিসার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবেন। কারণ সেক্ষেত্রে বিমানবন্দরে প্রবেশের সময় স্ক্যান ও চেক করে সিকিউরিটি স্টিকার লাগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করানো হয়, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার স্ক্যান করার মানে কি প্রথম বারের স্ক্যান ভুল!

অথবা এ কাজে জড়িত থাকা ব্যক্তিরা কোনো দুর্নীতিতে জড়িত! নাকি তারা এ কাজের অযোগ্য! একই কাজ দুবার করে সরকারি খরচ বাড়ানোর মানে কি!

বিশ্রাম কক্ষে গিয়ে আর বিশ্রাম নেয়ার সময় কই, বিশ্রাম কক্ষে ঢুকে শেষ বারের মতো স্বজনদের থেকে বিদায় নিতে মোবাইলে কল দিয়ে শেষবারের আলাপ সেরে নেন প্রবাসীরা। কিছুক্ষণ পর আবারো সিরিয়ালের ডাক দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার বলেন, আপনারা যারা বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করেছেন তারা আবার রুমের বাইরে গিয়ে লাইনে দাঁড়ান।

পুরো একটি ফ্লাইটের যাত্রীদের বিশ্রাম কক্ষ থেকে বাইরে নিয়ে আবারো দাঁড় করে রাখা হয় ২০ থেকে ৩০ মিনিট। বোর্ডিং পাস চেক করে ২ অংশের ১ অংশ যাত্রীকে দিয়ে আরেক অংশ নিজদের কাছে রেখে অনবোর্ডের যাত্রী নিশ্চিত করেন।

অনবোর্ডে যাত্রী নিশ্চিত হওয়ার পর এবার বিমানে ওঠার পালা। কার আগে কে উঠবে এ নিয়ে চলে তুমুল প্রতিযোগিতা। কিন্তু এখানেও অভাগা প্রবাসীর কপালের দুর্ভোগ লেগে থাকে। দেশ ত্যাগের সর্বশেষ মুহূর্তে বিমানে ওঠার জন্য এয়ারপোর্টের রানওয়েতে দিনের বেলায় প্রখর রৌদ্রের মধ্যে যাত্রীদের দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।

লাইনে দাঁড়ানো ছাড়াও অনেকভাবে হয়রানির স্বীকার হতে হয় মধ্যপ্রাচ্য আগত নির্মাণ শ্রমিকদের। কারণ এদের বেশির ভাগই কম শিক্ষিত বা নিজের অধিকার সম্পর্কে কিছু জানেন না। সবকিছু ঠিক থাকার পরও সন্দেহ আছে বলে আটকে দেয়া হয়, ডাকাতের চাইতেও ভয়ঙ্কর হন আইনের পোশাকে থাকা এসব অফিসাররা।

লজ্জা না লাগলেও তাদের আচরণের যাত্রীরা লজ্জিত হয়। অবশেষে নিজের পকেটে থাকা বাংলাদেশি টাকা আর চোখের পানির বিনিময়ে হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত হন প্রবাসীরা।

বিশ্বায়নের এ যুগে দেশ এগিয়ে গেলেও বিমানবন্দরের কার্যক্রম এখনো আগের মতোই, ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল যেভাবে বিমানবন্দর অতিক্রম করেছিলাম ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে এর ব্যতিক্রম দেখিনি।

দেশের সবক্ষেত্রে উন্নয়ন আর আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও দেশের অর্থনীতির অন্যতম উৎস, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশ চলে সেসব প্রবাসীর দেশত্যাগের সময় বিমানবন্দরে কতটা কষ্টকর সময় অতিবাহিত করেন, কেবল ভুক্তোভোগীরা ভালো বলতে পারবেন।

আমি একজন প্রবাসী, দেশত্যাগের কষ্ট আমি বুঝি। স্বজনদের ত্যাগ বিচ্ছেদে আমাদের অন্তরাত্মা কাঁদলেও দেশত্যাগের সময় বিমানবন্দরের হয়রানির কারণে সব ভুলে যাই।

প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিমানবন্দরের সিস্টেম আরও উন্নত করার পাশাপাশি অসাধু আর দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। বিমানবন্দরে আইনি সহায়তা দিতে কার্যকরী প্রবাসীকল্যাণ ডেক্স চালু করা জরুরি।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

স্বজনদের ভালোবাসা ছেড়ে প্রবাসী হওয়া মানুষগুলো যেন শান্তিতে দেশত্যাগ করতে পারে সে পরিবেশ তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সঠিক ব্যবস্থা নেবেন একজন সাধারণ প্রবাসী হিসেবে এটাই প্রত্যাশা।

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com