বাবা নেই তাই যখনই মন চায় ছুটে আসি মায়ের কাছে

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ০৪:৫৯ পিএম, ১৯ জুন ২০২২

আমার বাবা-মা জীবনের শেষ সময়ের বেশিরভাগ সময় সুইডেনে একসঙ্গে থাকতেন। হঠাৎ মা স্ট্রোক করেন। পরে মা চলাফেরায় অচল হয়ে পড়েন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাকে রিলিজ করে দেয়। পরে, বাসায়ই সবরকম নার্সিং সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়। বাবা মূলত মায়ের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টায় থেকেছেন। আমার মায়ের যত্ন করা, বিভিন্ন বিষয় খেয়াল রাখা, কোনো প্রয়োজন হলে সেই প্রয়োজন মেটানো বাবা এগুলোকেই তখন তার জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বানিয়ে নিয়েছিলেন।

সারাজীবন শুনেছি স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা, স্বামীরও যে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্য থাকতে পারে বা আছে সেটা দেখেছি আমার বাবাকে দেখে। আমার অনেক ভাই বোন, বাবা চাকরি করেছেন, মা মূলত আমাদের সংসারের হাল ধরেছেন জীবনের শুরুতেই। বাবা-মা সমন্বয়ে কাজ করেছেন, বিপদে আপদে পরস্পর পরস্পরের পাশে থেকে নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছেন।

বিজ্ঞাপন

তাদের জীবন নামক সফর দেখেছি, তারা ছিলেন একে ওপরের সফরসঙ্গী, শিখেছি অনেক সেই দৈনিক শিক্ষা থেকে। ২০০৬ সালে মায়ের মৃত্যুর পর বাবার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেলো, এখন কী হবে এই চিন্তায়। কোথায়, কখন, কীভাবে মায়ের মাটি হবে? মাকে বাংলাদেশে মাটি দিতে হবে ইত্যাদি। পরিবারের মধ্যে দুটো গ্রুপ হলো একটি গ্রুপের আশা মাকে দেশে মাটি দিতে হবে এবং সেভাবে তারা বাবাকে টেলিফোন করে মানসিকভাবে ভেঙে দিতে উঠেপড়ে লেগে গেলো।

পরিবারের কেউ কেউ বলেছে তখন, অর্থের কারণে আমরা মাকে দেশে পাঠাতে রাজি হচ্ছি না ইত্যাদি। উস্কানি দেওয়ার মতো মানুষের অভাব নেই, বিপদের সময়ে এটা নতুন কিছু নয়। যদিও পরিবারের সবারই কম-বেশি সামর্থ রয়েছে সত্ত্বেও দায়িত্ব নেয়ার মতো লোকের অভাব সব সময়ই ছিল। যাইহোক, শেষে মাকে লিনসোপিংএ কবর দেওয়া হলো মূলত, আমার ছোটভাই সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে সেটা ছিল প্রধান কারণ।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বাবা মার পুরো দাফন থেকে শুরু করে কবর দেওয়া, জানাজা পড়ানো সমস্ত কাজগুলো দেখে বাবা খুবই সন্তুষ্ট হলেন, মনে হলো স্বস্তি ফিরে পেলেন, আলহামদুলিল্লাহ! পরেরদিন বাবা আমাদের সঙ্গে স্টকহোমে রওনা দিলেন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে, কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান করবেন দেশে গিয়ে।

লিনসোপিং ( সুইডেনের একটি শহর) থেকে বিদায় নেওয়ার আগে মায়ের কবরে বাবাকে নিয়ে আবারও গেলাম। বাবা ধর্মীয়ভাবে মায়ের থেকে বিদায় নিলেন তবে কে জানতো সেদিন বাবা আর ফিরে আসবেন না?! এ দেখাই যে শেষ দেখা এবং আর যে দেখা হবে না!
মারিয়া আমার স্ত্রী গাড়ি চালাচ্ছে, আমি বাবা এবং আমার ছেলে-মেয়ে গাড়িতে। মনটা খারাপ সবাই বেশ চুপচাপ।

বাবা বেশ স্মৃতিচারণ করতে শুরু করলেন... তোমার মা চলে গেলেন। আমরা একসাথে গত ৬০ বছর ধরে সংসার করছি। একটা ছোট সরকারি চাকরি দিয়ে আমি সংসার জীবন শুরু করেছিলাম। সারাজীবন চেষ্টা করেছি সৎ থাকার জন্য। কসম খেয়ে বলতে পারি জীবনে কোনোদিন এক টাকা অসৎভাবে আয় করিনি। গ্রামের বাড়িতে বাবা-মাকেও কিছু টাকা পাঠাতে হতো। কখনো কখনো মাস শেষ হওয়ার আগে আমার বেতনের টাকা ফুরিয়ে যেত।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

‘সৎ থাকার কারণে আয়ত্ত ছিল খুব সামান্য। আমাদের সাত ছেলে এবং চার মেয়ে ছিল। তোমার একভাই এবং একবোন মারা যায়।
আমার সহকর্মীদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে গরিব ছিলাম। কিন্তু তোমার মায়ের কারণে আমি এটা কখনোই উপলব্ধি করতে পারিনি। সে যে কিভাবে সবকিছু ম্যানেজ করতেন একমাত্র সেই জানেন।’

‘আমার সাধ্যের বাইরে জীবনে কখনো কোনোদিন উনি কিছু দাবি করেননি। জীবনে কখনো আমাকে এটা বলেন নি যে, তুমি আমাকে এটা দিলে না, ওটা দিলে না। কখনো আমাকে আমার সামর্থ্য নিয়ে কষ্ট দিয়ে উনি কোনো কথা বলেননি। আজীবন ওনাকে শুধু সন্তুষ্টই দেখেছি।’

‘সত্যি বলতে কি আমি তাকে তেমন কিছুই দিতে পারিনি। তারপরও উনি কোনোদিন আমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলেননি। তোমার মা একজন নেককার মানুষ ছিলেন। উনি উত্তম আচরণের অধিকারী ছিলেন। আত্মীয়তার হক রক্ষা করেছেন। পরোপকারী ছিলেন, স্বামী-সন্তানদের হক আদায় করেছেন। উনাকে আমি কখনো কোন নামাজ কাযা করতে দেখিনি, আজীবন পর্দা রক্ষা করে চলেছেন। উনি ধৈর্যশীল ছিলেন এবং অল্পে সন্তুষ্ট থাকতেন।’

বিজ্ঞাপন

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে বাবা একটু দম নেওয়ার জন্য থামলেন। এরপর আবার বলতে শুরু করলেন, ৭১ এর যুদ্ধে তোমার মা যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তা তোমার থেকে আর কেউ ভালো জানে বলে মনে হয় না। একটা দেশ স্বাধীন করতে, গ্রামের সাধারণ মানুষের পাশে থেকে তাদের অনুপ্রেরণা দেওয়া, নিজের ছেলেদের এবং স্বামীকে যুদ্ধে পাঠিয়ে তোমাদের নিয়ে নিজ দেশে পরাধীন এবং সরনার্থি হয়ে দীর্ঘ নয়টি মাস সংগ্রাম করেছেন।

সোনার বাংলা দেখার স্বপ্ন দেখেছেন। তোমাদের সবাইকে সেভাবে গড়ে তুলেছেন। আমি আসলে তোমার মায়ের হয়ে তোমাকে কিছু বলার জন্য কথা বলছি না। যে নারী ৬০ বছর ধরে তার স্বামী-সন্তান এবং আত্মীয়দের হক রক্ষা করে চলেছেন তিনি অন্য কারো হক নষ্ট করতে পারেন না।

একজন জান্নাতী নারীর মধ্যে যা যা বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন তার সবই তোমার মায়ের মাঝে ছিল। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করবেন। আমি নিজে জান্নাতে যেতে পারবো কি না জানি না। তোমরা শুধু এই দোয়া করো আমি যেন তোমার মায়ের সাথে জান্নাতে একত্রিত হতে পারি।

বিজ্ঞাপন

আর তুমি সাক্ষী থাকো আমি তোমার মায়ের উপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট। আল্লাহ যেন উনাকে মাফ করে দেন। আমি বাবার কথাগুলো অনুবাদ করছি একই সাথে এসময় মারিয়া (আমার স্ত্রী) আমার সঙ্গে বলে উঠল আমিন,আমিন, আমিন। গাড়ি চলছে আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো একজন স্বামীর মুখে তার জান্নাতী নারীর কথা শুনছি।

হাদিসে এসেছে, একজন মুমিন-মুমিনার জীবনে তার রবের তরফ থেকে সর্বোত্তম রিজিক হচ্ছে একজন নেককার স্বামী এবং স্ত্রী। বাবার কথা থেকে যেন সরাসরি এই হাদীসের প্রমাণ পেলাম। বাবাকে নিয়ে স্টকহোমে ফিরে এলাম একটা অপূর্ব ভালো লাগা নিয়ে।

সুখী মানুষদের কথা শোনার মধ্যেও একটা সুখ আছে। বাবা আর মা অত্যন্ত সুখী মানুষ ছিলেন। এই সুখ স্রষ্টা সরাসরি তাদের অন্তরে ঢেলে দিয়েছিলেন। বাবা দেশে যাওয়ার পর মারা জান, মা আমার এখানে আছেন। যখন মন চায় ছুটে যাই মায়ের কবরে। এসেছিলাম লিনসোরিংএ মার কাছে।

বিজ্ঞাপন

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট) ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com