‘১৯৭১ সেই সব দিন’ যেন মুক্তিযুদ্ধের সারমর্ম

পত্রিকার পাতা স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ছবির পোস্টার। ছবির নাম ‘১৯৭১ সেই সব দিন’। ছবির পোস্টারটা দেখে কেমন আবেগতাড়িত হয়ে গেলাম। ছবির হারিয়ে যাওয়া সেই হাতে আঁকা পোস্টার। একসময় সিনেমা হলগুলোর বাইরে ঢাউশ আকারের এইসব পোস্টার চোখে পড়তো। সেগুলো আঁকা থাকতো বড় বড় কাপড়ের পর্দায়। আমরা সেখানে দেখে দেখে চেনার চেষ্টা করতাম সেই ছবিতে কে কে অভিনয় করেছেন।
এছাড়াও ছবির প্রচারের জন্য রিকশার সামনে এবং পেছনেও ঝোলানো থাকতো হাতে আঁকা পোস্টারের প্রিন্ট কপি। এই ছবিটার হাতে আঁকা পোস্টার যেন বাংলা ছবির একসময়ের স্বর্ণযুগকেই মনেকরিয়ে দিলো। আবহমান বাংলায় চলচ্চিত্রকে একসময় ‘ছবি’ বলেই সম্বোধন করা হতো। তাই এই লেখায় আমি ছবি শব্দটাই বেশি ব্যবহার করেছি।
এরপর থেকে ইউটিউব এবং পত্রিকার পাতায় নজর রাখছিলাম কবে ছবিটার ট্রেইলার আসে সেটা দেখার জন্য। এরপর একসময় আসলো সেই কাঙ্খিত ট্রেইলার। ট্রেইলারের কথাগুলো যেন মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো- ‘সময়টা আশ্চর্য আবেগের। সময়টা সবুজ ঘাসের ওপর লাল রক্ত জবার। সময়টা মিছিলের, স্লোগানের, দেয়ালে দেয়ালে বিদ্রোহের। সময়টা আদরের, খুনসুঁটির, সবুজের ওপর একটু করে হলুদের। সময়টা ভালোবাসার, ভীষণ করে ভালোবাসার। সময়টা ছেড়ে না যাবার আকাঙ্খায় ছেড়ে যাবার। সময়টা নিষ্ঠুরতার, কী ভীষণ নিষ্ঠুরতার। সময়টা নিদারুণ, নির্দয়। সময়টা পুড়িয়ে দেয়ার, উড়িয়ে দেওয়ার। সময়টা কেঁদে বুক ভাসাবার। সময়টা দখলের, নিজেকে জানবার। সময়টা যুদ্ধের, হার না মানার। সময়টা উঠে দাঁড়াবার। সময়টা বাংলার, বাঙালির। সময়টা ১৯৭১। সেই সব দিন।’
চলচ্চিত্রটির একটি দৃশ্য
এরপর মূল ছবিটার জন্য আবেগ এবং আগ্রহের পারদ বেড়েই চলছিল। একই অবস্থা ছিল অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য দর্শকদেরও। তাই এই ছবিটার অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশক ‘বঙ্গজ ফিল্মস’র ওয়েবসাইটে যেয়ে দেখি অস্ট্রেলিয়ার সবগুলো শোয়ের টিকেট শেষ। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। এরপর তারা আরো কিছু শো যোগ করলে টিকিট করতে আর দেরি করিনি। সে শোয়ের টিকিটও মুহূর্তেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এই ছবিটা আমি সিডনির ব্যাংকসটাউন সিনেমা হলে দেখেছিলাম হলভর্তি দর্শকের সারিতে বসে।
বাংলা ছবির হলভর্তি দর্শক দেখলে মনের মধ্যে এক ধরনের আলাদা ভালো লাগা কাজ করে। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে ছবি শুরু হলো। এরপর বিরতির পাঁচ মিনিট ছাড়া পুরো সময়টা মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করেছি ছবির প্রত্যেকটা দৃশ্য। বুঝতেই পারেনি প্রায় তিনঘণ্টা দৈর্ঘ্যের একটা ছবি দেখে ফেলেছি।
ছবিটার চিত্রনাট্য এক কথায় অসাধারণ। মনে হচ্ছিল যেন মুক্তিযুদ্ধের ধারা বিবরণী শুনছি। আর প্রত্যেকটা ঘটনার তারিখ বাংলা এবং ইংরেজি দুভাবে দেওয়াতে নতুন প্রজন্ম যেমন সহজেই নিজেদের রিলেট করতে পারবে। আর মুক্তিযুদ্ধের সমসাময়িক প্রজন্ম নিজেদের স্মৃতিতে হারিয়ে ফেলবেন। এই উদ্যোগটা আমার কাছে অনুকরণীয় মনে হয়েছে। আমরা সবাই জানি বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের খুব কম মানুষই জানে সেদিন ছিল ৮ই ফাল্গুন। যে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার বীজ বপন করা হয়েছিল। আজ এত বছর পরে এসেও সেই ভাষা স্বাধীন বাংলাদেশে তার যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি। তাই ঘটনার বাংলা দিন তারিখগুলোর প্ৰদৰ্শণ আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে।
চলচ্চিত্রটির অফিসিয়াল পোস্টার
এরপর আসে সেট নির্মাণ। ছবির প্রত্যেকটা দৃশ্য যেন বাংলদেশের ১৯৭১ সালের আর্থ সামাজিক অবস্থানের যথাযথ চিত্রায়ন। বাড়িঘর, দেয়াল, জানালা, জানালার গ্রিল, দরজা, দরজার শেকল, সিঁড়ি, বাড়ির গেট, গেটের বাইরের ডাকবাক্স, গাড়ি, ট্রেন প্রত্যেকটা জিনিসই আমার কাছে একদম নিখুঁত মনেহয়েছে। বাড়ির, রেডিও, টেলিফোন, দেয়ালের লিখন, মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ আলাদাভাবে আসলে কোনটার কথা বলবো।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম, রাজপথের মিছিল, স্লোগান সবই যেন যুদ্ধদিনের বাস্তব চিত্র। শরণার্থীদের পালিয়ে যাওয়া। মায়ের হাত থেকে মেয়ে হারিয়ে যাওয়া, সাঁতার না জানা মেয়ের নদীতে ঝাঁপ দেওয়া, মানুষের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া, ট্রেনিং নেওয়া সবই যেন একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর প্রতিচ্ছবি। এছাড়াও ছিল একাত্তরের প্রেক্ষাপটে প্রেম এবং ভালোবাসা। মুক্তিযুদ্ধের কোন অংশই বাদ পড়েনি চিত্রায়ণ থেকে।
ছবির মানুষদের কথাগুলোও ছিল বাহুল্যবর্জিত। আর এই ছবির গানগুলোতো এক কথায় শ্রুতিমধুর। গানগুলো এসেছে দৃশ্যায়নের চাহিদা অনুযায়ী। আর সেই দৃশ্যের সাথে মিল রেখেই ছিল গানের কথাগুলো। প্রত্যকটা গানই দর্শক শ্রোতার প্রাণে জায়গা করে নেওয়ার মতো। ছবিটা দেখা শেষ করে আমি ইউটিউবে আলাদাভাবে গানগুলোর খোঁজ করতে গিয়ে দেখলাম এখনো সবগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। আছে শুধু ‘যাচ্ছো কোথায়’ এবং ‘ইয়ে শামে’ গানটা। ‘যাচ্ছো কোথায়’ গানটা হালকা চালের রোমান্টিক গান। ‘ইয়ে শামে’ গানটা আবার সমসাময়িক উর্দু গানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
চলচ্চিত্রটির অস্ট্রেলিয়ায় পরিবেশক বঙ্গজ ফিল্মস
এছাড়াও মমতাজের দরাজ গলায় গাওয়া ‘যাওরে পংখী উইড়া যাওরে’ যেমন লোকজ ধাঁচের আবার একইসাথে মৌসুমি হামিদের ঠোঁটের ইংরেজি গানটাও দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করেছে।
এই ছবিটার আরেকটা বড় আকর্ষণ হচ্ছে এই ছবির চরিত্র নির্মাণ। এই ছবির শিল্পী তালিকা দীর্ঘ যেখানে আছেন ফেরদৌস আহমেদ, সজল নূর, লিটু আনাম, সানজিদা প্রীতি, হৃদি হক, মামুনুর রশীদ, আবুল হায়াত, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মুনমুন আহমেদ, শিল্পী সরকার অপু, তারিন জাহান, সাজু খাদেম, নাজিয়া হক অর্ষা, আনিসুর রহমান মিলন, জুয়েল জহুর, মৌসুমী হামিদ, গীতশ্রী চৌধুরীর মতো নামীদামী শিল্পীবৃন্দ। কিছু চরিত্র ছবিতে এসেছে মাত্র একটা বা দুইটা দৃশ্যের জন্য কিন্তু দর্শকমনে ছাপ রেখে গেছে।
আসলে মুক্তিযুদ্ধতো ছিল সত্যিকার অর্থেই একটা গণযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের ইমারতটি নির্মাণ করেছিলেন বাংলাদেশের প্রত্যেকটা শ্রেণি পেশার মানুষ। আবার হাতেগোনা কিছু মানুষ এটার বিরোধিতাও করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের আবেগের, ত্যাগ-তিতিক্ষার কাছে একটা প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী হার মানতে বাধ্য হয় এবং আমরা অর্জন করি কাঙ্খিত স্বাধীনতা।
সিডনির ব্যাংকসটাউন সিনেমা হলের পোস্টার
আমি সবসময়ই একটা কথা বলি সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সত্যিকার অর্থেই একটা বহুমাত্রিক সংগ্রাম।
সেখানে যেমন আছে সম্মুখ সমরের লড়াই আবার তার চেয়ে বেশি করে আছে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। একদিকে যেমন আছে বীভৎসতম জিঘাংসার গল্প আবার পাশাপাশিই আছে চরম মায়া এবং মমতার আখ্যান। একদিকে যেমন আছে স্বার্থপরতার গল্প অন্যদিকে আছে সর্বোচ্চ ত্যাগ তিতিক্ষার গল্প। তাই মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আরও বেশি বেশি গবেষণা হওয়া দরকার।
চিত্রায়িত হওয়া দরকার আরও বহু চলচ্চিত্র। কারণ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ, ইউটিউবের যুগ, ওটিটির যুগ এবং চলচ্চিত্রের যুগ। মুক্তিযুদ্ধের ওপর যতবেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে নতুন প্রজন্ম ততবেশি আগ্রহী হবে এই বিষয়ে জানতে। আশার কথা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি প্রজন্ম সেটা অনুভব করছে এবং নিজ গরজে এগিয়ে আসছে। হৃদি হক নির্মিত ‘১৯৭১ সেই সব দিন’ নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণায় এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে পথ দেখাবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এমআরএম/এএসএম