মাটির ব্যাংক

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৪:৪৪ পিএম, ০৪ নভেম্বর ২০২১

গ্রামের মানুষের স্বল্প আয়ের জীবনযাত্রায় দৈনন্দিন ব্যয় করে খুব কম অর্থই বাচে জমানোর জন্য। নদীভাঙনের পর আমাদের জীবনযাত্রা অনেকটা ‘দিন আনি দিন খাই’ এর মতো অবস্থায় চলে গিয়েছিল। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর পর তেমন কোনো টাকা-পয়সা থাকতো না।

তবুও আমার মা পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, চার আনা, আট আনা করে জমাতেন। এখন তো আর সেই মুদ্রাগুলো নেই, হয়তো জাদুঘরে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু তখনকার দিনে ওই মুদ্রাগুলো দিয়ে অনেক কিছুই কেনা যেতো।

এখন এই খুচরা পয়সাগুলো রাখা হবে কোথায়? মাটি, ছন, বাঁশের তৈরি ঘরে খুঁটি হিসেবে বাঁশ ব্যবহার করা হতো। এই খুঁটিগুলার মধ্যে যে খুঁটিটা একটু হৃষ্টপুষ্ট তার কোনো এক অংশকে নির্বাচন করা হতো ব্যাংক হিসেবে। তারপর দুই গিরার মাঝের অংশের উপরের দিকের অংশে যাতে শুধু পয়সা ঢুকে এমন আকারের উপবৃত্তাকার ছিদ্র করা হতো।

বিজ্ঞাপন

jagonews24

তারপর সেই ছিদ্র দিয়ে ভেতরে পয়সা ফেলা হতো। এভাবে ফেলতে ফেলতে একটা সময় সেটা ভরে যেতো। আর সেটা বোঝা যেত পয়সা ফেলার পর তার শব্দের মাত্রা শুনে। কারণ উপর থেকে পয়সা পড়লে জোরে শব্দ হবে আর যদি কাছাকাছি পড়ে তাহলে কম শব্দ হবে।

তবে ওই বয়সে তো আর আমরা সেটা বুঝতাম না, তাই মা’র এই দক্ষতাটাকে আমার জাদুকরি শক্তি মনে হতো। এরপর সেই ব্যাংকের একেবারে তলার দিকে আবার ঠিক একই সাইজের একটা ছিদ্র করা হতো এবং কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পয়সা বের করে আনা হতো। কখনই ছিদ্র দুটি বড় করে তৈরি করা হতো না, কারণ তাতে আবার খুঁটির শক্তি কমে যাবে। এভাবে জমানো টাকা দিয়ে আমাদের মা সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেন।

এর বাইরে ছিল মাটির তৈরি বেলুন আকৃতির পাত্র, যেটাকে গ্রামের ভাষায় ব্যাংক বলা হতো। কখনও মেলা বা কোনো হাটে গেলে আব্বা, মায়ের জন্য একটা মাটির ব্যাংক কিনে আনতেন। কুষ্টিয়ায় সবচেয়ে বড় মেলা হতো দুই রথ মেলা। একটাকে আমরা বলতাম রথের মেলা, অন্যটা ছিল উল্টো রথ মেলা।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

jagonews24

এসব মেলা থেকেই সাধারণত মাটির ব্যাংক কেনা হতো। সোজা রথ মেলায় আব্বা ভুলে গেলেও মা উল্টো রথের মেলায় বারবার মনে করিয়ে দিতেন। আর আমরা সঙ্গে গেলে আমাদেরও বলে দিতেন আব্বাকে মনে করিয়ে দিতে।

এরপর মা বাঁশের খুঁটির ব্যাংকের মতো মাটির ব্যাংকেও ঠিক একইভাবে পয়সা জমাতেন। মায়ের জমানো পয়সা আমরা তিন ভাই পালা করে সেই ব্যাংকে ফেলতাম। ব্যাংকে পয়সা ফেলাটা ছিলো একটা মহা আনন্দের কাজ। কে আগে পয়সা ফেলবে এটা নিয়ে মাঝে মধ্যে মারামারি পর্যন্ত লেগে যেতো আমাদের ভাইদের মধ্যে। তাই মা ছোট থেকে শুরু করে সবাইকে সুযোগ দিতেন।

পয়সা ফেলার পর প্রতি বার আমরা মাটির ব্যাংকটা ঝাকিয়ে শব্দ শুনতাম। মাটির ব্যাংকে কাঁচা পয়সার শব্দ মনের মধ্যে এক ধরনের শিহরণ জাগাতো। এরপর সেই মাটির ব্যাংকও কোনো এক বিপদের দিনে সেটা ভেঙে ফেলা হতো।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

jagonews24

আমাদের ভাইদের অবশ্য অন্য রকমের একটা ব্যাংক ছিলো যেটার কথা শুধু আমরাই জানতাম। সেটা ছিলো আমাদের ছনের ঘরের চালের ভেতর। ঘরের চালের ছন ফাঁকা করে তার ভেতরে আমরা টাকা বা পয়সা লুকিয়ে রাখতাম। আর পাশে কোনো একটা চিহ্ন ঠিক করে রাখতাম যেন পরের বার খুঁজে পাওয়া যায়।

তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওই লুকানো টাকাগুলা আমরা আর খুঁজে পেতাম না কারণ ছনের চালা নিচ থেকে দেখতে সব জায়গা একই রকম লাগতো। বিশেষ করে তখন নতুন নতুন এক টাকা বা দুই টাকার নোট জমানোর প্রতি আমার আমাদের আগ্রহ বেশি ছিল। এভাবে আমরা অনেক টাকা হারিয়েছিলাম।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

এরপর একটা সময় নিজে সন্তানের পিতা হলাম। ভাবলাম আমাদের শৈশবের সেই অনাড়ম্বর আনন্দগুলো ওদের মধ্যে ফিরিয়ে আনি। আমাদের মেয়ে তাহিয়া প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পর ওর নানার কাছ থেকে একটা করে দুই টাকার নোট নিতো। ওর নানা অফিস থেকে আসার পর মানিব্যাগটা পকেট থেকে বের করে রাখার সঙ্গে সঙ্গে সে ওখান থেকে একটা দুই টাকার নোট সরিয়ে রাখতো। তারপর সেই দুই টাকার নোট সে তার নিজস্ব ছোট্ট একটা পার্সে নিয়ে রাখতো। এভাবে বেশ অনেকগুলো টাকা জমাও হয়ে গেলো।

এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয় ছিলো সে কখনই আমার কাছ থেকে টাকা নিতো না। একবার ওর নানা ওকে জিজ্ঞেস করেছিল তুমি তোমার বাবার কাছ থেকে টাকা নেও না কেন? সে বলেছিল, তাহলে বাবার টাকা কমে যাবে না? কি লক্ষ্মী মেয়ে আমার! এরপর ঈদে বেশ কিছু টাকা সালামিও পেল, তখন বায়না ধরলো, বাবা একটা মাটির ব্যাংক কিনে দাও।

jagonews24

আমি প্রায় প্রতিদিনই ভাবি অফিস থেকে ফেরার পথে ওর জন্য একটা মাটির ব্যাংক নিয়ে যাবো ভাবতাম এবং প্রতিদিনই ভুলে যেতাম আর ওর কাছে বকা খেতাম।

বিজ্ঞাপন

এরপর একদিন উত্তরখান মাজারের মেলা থেকে ওর জন্য মাটির ব্যাংক কিনে আনলাম। উত্তরখান মাজারে প্রতিবছর একবার করে ওরশ হয়। তখন আশপাশের এলাকায় সাজসাজ রব পড়ে যায়। সপ্তাহব্যাপী চলা এই মেলা এলাকার মানুষদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সঞ্চার করে। আমি প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরেই তাহিয়াকে কাঁধে নিয়ে সেই মেলায় হাজির হতাম।

jagonews24

আমরা তেমন কিছুই কিনতাম না কিন্তু ঘুরে ঘুরে দোকান, আয়োজন সব দেখতাম। মানুষের মুখরিত কোলাহল আমাদের খুব ভালো লাগতো। এরপর সে তার দুই টাকার নোটগুলো সেই ব্যাংকের মধ্যে রাখা শুরু করলো। এরপর একদিন বেশ কিছু টাকা জমা হয়েও গেলো। তখন ঠিক আমার মায়ের মতো তাহিয়ার মাও সেটা ভেঙে ওর জন্য একটা কাজে লাগিয়েছিলো।

বিজ্ঞাপন

এভাবেই আমরা চাইলেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একটা চমৎকার শিক্ষা দিতে পারি। যেটা একইসাথে আনন্দময়। খুচরা পয়সা দিয়ে এমনিতে কোন কিছু কেনা যায় না কিন্তু সেগুলো একত্র করলে অনেক বড় কিছু করা সম্ভব।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

এরপর প্রবাস জীবনে এসেও আমরা এই অভ্যাসটা ধরে রেখেছি। অবশ্য এখন মাটির ব্যাংকের জায়গা নিয়েছে টিনের কয়েন বক্স আর খুচরা পয়সার জায়গা নিয়েছে ডলার আর সেন্টের কয়েন।

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com