জাতের মেয়ে কালোও ভালো!

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ০৩:১৩ এএম, ৩১ মে ২০২২
রহমান মৃধা

নদীর পানি ঘোলাও ভালো। বহু বছর আগের কথা, আমার মেঝো মামা হঠাৎ কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করেন। কলেজপড়ুয়া ছেলে প্রেম করে সেটা কেউ জানত না। মামা কলেজের ভিপি, রাজনীতি করেন শুনেছি, তবে বিয়ে করে দিব্বি বউ নিয়ে বাড়িতে ঢুকবে এটা কেউ ভাবতে পারেনি। নানার কানে খবর পৌঁছে গেলে কী হবে এটাই সবার ভাবনা, তারপর বিয়ে করেছে কালো মেয়ে!

ভয়ে বাড়ির বিড়ালটা পর্যন্ত চুপ। কোনো না কোনোভাবে নানা বিষয়টি জেনে যান। নানা আবার সারাক্ষণই ব্যস্ত, বিশাল জমিদারি সাথে তার রাজনৈতিক ও সামাজিক দাপোট সেই যশোর, নড়াইল এবং মাগুরাজুড়ে (ব্রিটিশ তাড়িয়ে পাকিস্তান গঠন ও সেটার অবশান ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন, দেশ গঠনে সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে সুইডেনে প্রথম বিদেশি যার শতবর্ষ পালন করা হয় এবং সুইডিশ নাগরিত্ব পান তিনি।

বিজ্ঞাপন

শেষে নিজ দেশের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর। সবার মাঝে যে একটি ভয় কাজ করছিল সেটা কেন যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। আকাশে মেঘ হলে অনেক সময় মনে হয় বিশাল ঝড় বৃষ্টি হবে পরে দেখা যায় বৃষ্টিই হয় না, যাকে বলে যত গর্জে তত বর্ষে না। নানা বেশ সহজেই পুরো বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন।

মামি আমার দেখতে কালো বলে আমার মা আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন মামাকে, ‘শোনো রূপে কালো ঠিক আছে গুণে যেন সেটা না হয়।’ আমি বেশ ছোট তখন নানা বাড়ি আশা মানে মেলায় যাওয়া, লেখাপড়া করা লাগে না শুধু সারাদিন চিত্রানদীতে মনের আনন্দে ডুবানো, চারিখাদার গোচরে ফুটবল খেলা, আমগাছে আম, জাম গাছে জাম, লিচু গাছে লিচু, তেতুঁল গাছের মিষ্টি তেতুঁল, যখন যেটা হয়েছে সেটা খেয়েছি মনের আনন্দে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জীবনের এমন সময় কে কালো আর কে ফর্সা এসব দেখা বা বোঝার বয়স হয়নি তখন। মামি ফটিকের মামির মতো হতে পারতেন কিন্তু না তিনি সবার মনের মাঝে ভালো একটি জায়গা দখল করে নিয়েছেন যখনই নানাবাড়ি গিয়েছি। মামির ঘরের দেওয়ালে মামির হাতের নকশিকাঁথার অনেক চিত্রাঙ্কন ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেছি। তার মধ্যে একটি চিত্রাঙ্কনের কথা বেশ মনে পড়ে ‘জাতের মেয়ে কালো ভালো নদীর পানি ঘোলাও ভালো।’

আমার বাবার বাড়ি নহাটা (বর্তমান মাগুরা জেলাধীন)। গ্রামের দূর সম্পর্কের এক ভাই বিয়ে করেছেন, ভাবি বড্ড কালো। ভাইয়ের মা সম্পর্কে আমার চাচি হন, তিনি বেটার বউকে সহ্য করতে পারতেন না কালো বলে, এমন কি ভাইয়ের যে একমাত্র বোনটি সেও না। বোনের বাচ্চা হবে বিধায় এসেছে বাপের বাড়ি। চাচি চড়া গলায় ভাবিকে বলে দিলেন যেন ছোট বোনের ঘরে সে না যায়।

কোন একদিন ভুলবশত ছোট বোনের ঘরে ভাবি গিয়েছিলেন, তাতে ছোট বোন বিশাল কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। ভাই তখন বোনকে বলেছিলেন, তোর রুমে এসেছে বলে কি হয়েছে? তাছাড়া আমার বউয়ের চেহারার মাঝে কি এমন আছে যার জন্য তোর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো?

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ছোটবোন কিছু না বলে চুপ হয়ে আছে। অন্য রুম থেকে তখন ভাইয়ের মা এসে বললেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে অলক্ষ্মীর চেহারা দেখলে কার মেজাজ ভালো থাকে? আমার মেয়েটার কয়েকদিন পর বাচ্চা হবে। মেয়েদের বাচ্চা হওয়ার আগে যার চেহারা বেশি বেশি দেখবে বাচ্চা তার মতই হবে। আমি চাই না আমার মেয়ের সন্তান তোর বউয়ের মতো হোক। দুনিয়ার সব মানুষ তো তোর মত বোকা না যে কালো চামড়ার মেয়ে বিয়ে করবে।’

সমাজে কালো হওয়া যে কি জ্বালা তখন হয়ত বুঝিনি তবে দেখেছি যেমন যদি কেউ দেখতে কালো বাস তাকে কালা ভাই বলে ডাকা শুরু হয়ে গেলো এবং পরে সত্যি সত্যিই তার নাম কালা হয়ে গেলো। কোনো এক সময় ভেবেছি আমার চাচি না হয় স্বল্প শিক্ষিতা তাই এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করেন কিন্তু বোনটা তো ইন্টার পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। সে কিভাবে এইসব জিনিস বিশ্বাস করে?

ভাবি বিষয়টির তেমন গুরুত্ব দিলেন না বরং কিছুক্ষণ পরে ঘরে এসে ভাইকে বললেন, আজ দুপুরে কি রান্না করবো? ভাবির হাসিমাখা মুখটা দেখে আমি খুব অবাক হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ আগে যে বউকে আমার চাচি, বোন এতো অপমান করলো তারপরেও তার মুখে এখনো হাসিটা কিভাবে লেগে আছে! হয়তো অতি কষ্ট পেয়েই মিথ্যা হাসির অভিনয় করছেন!

বিজ্ঞাপন

কোনো একদিন ভাবিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- আমার চাচি এবং বোনের অত্যাচারে খুব কষ্ট পাও তাই না? ভাবি হেসে বললেন, ‘একদম না। এসব কথাতে আমি অনেক আগে থেকেই অভ্যস্ত’ আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে! আমার ভাবি তখন বলেছিলেন,
‘শোন ভাই তোরে ছোট খাটো কিছু ঘটনা বলি। একবার কলেজে পড়া অবস্থায় অন্য সবার মতো আমারও ইচ্ছে হতো সাজতে। তো পাহেলা ফাল্গুনের দিন আমিও সবার মতো শাড়ি পরলাম।

সবার মতো আমিও সাজলাম। বাইরে বের হওয়ার জন্য যখন বাসা থেকে রওনা হলাম তখন পাশের বাসার আন্টি আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলেছিলো ‘যতই মেকাপ করো না কেন কয়লা ধুলে ময়লা যায় না!’ সেদিনের পর আর কখনো সাজতে ইচ্ছে হয়নি কারণ কালো মেয়েদের সেজে কি লাভ!

দেখতে কালো বলে একের পর এক পাত্রপক্ষ যখন বিয়ের জন্য না করে দিচ্ছিলো তখন আমার নিজের মা বলেছিলো, ‘এই অলক্ষ্মী মেয়েকে জন্ম দিয়ে আমি ভুল করেছি। এই অলক্ষ্মী মেয়ে মরেও না।’ নিজের বাবা বলেছিলো, ‘এই কপালপুড়ি আমার চোখের সামনে যেন না আসে।’

বিজ্ঞাপন

যেখানে আমার নিজের জন্মধাত্রী মা আমায় অলক্ষ্মী বলতে পারে সেখানে পরের মা আমায় অলক্ষ্মী বললে কষ্ট লাগবে কেন? যেখানে আমার জন্মদাতা পিতা আমার মুখ দেখতে চায় না সেখানে তোমার বোন আমার মুখ দেখতে না চাইলে আমার তো তাতে কষ্ট পাওয়ার কথা না। ভাবির মুখে কথাগুলো শোনার পর মামির দেওয়ালের নকশিকাঁথার কথা বেশ মনে পড়েছিল সেদিন, জানি না কেন তিনি দেওয়ালে সেটা ঝুলিয়ে ছিলেন! তার জীবনেও কি এমনটি ঘটেছিল কখনও!

যাইহোক কিছুদিন পর বোনের বাচ্চা হবে, জটিলতার কারণে ঢাকাতে সিজার করে বাচ্চা বের করা লাগে। প্রচন্ড রক্ত ঝরার কারণে বোনের রক্ত সংকট দেখা দেয়। তাকে বাঁচাতে রক্তের দরকার, এদিকে রক্তের যে গ্রুপ সেটা হাসপাতালে মিলছে না, কি করা। ভাবির রক্তের সঙ্গে বোনের রক্তের গ্রুপের মিল পাওয়া গেছে।

ভাই তার মাকে বললো, মা, রক্ত দেওয়ার মানুষ পাওয়া গেছে কিন্তু সমস্যা হলো মানুষটা কালো। কালো মানুষের শরীর থেকে রক্ত নেওয়া কি উচিত হবে? মা রাগী চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, রক্তের মধ্যে কালো মানুষ আর ফর্সা মানুষের ভেদাভেদ কি? ফর্সা মানুষের রক্ত যেমন লাল হয় তেমনি কালো মানুষের রক্তও লাল হয়। তাছাড়া কালো মানুষের শরীর থেকে রক্ত নিলে সমস্যা কোথায়?

বিজ্ঞাপন

আচ্ছা, রক্তে যদি ফর্সা কালোর কোনো ভেদাভেদ না থাকে তাহলে চামড়াই কেন এতো ভেদাভেদ? কালো মানুষের রক্ত শরীরে নিতে সমস্যা নেই অথচ কালো মানুষের চেহারা দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় কেন? সেই পঞ্চাশ বছর আগের কথা যা ঘটেছিল বাংলাদেশে। এমনটি ঘটে চলছে আজও পাশ্চাত্যে এমনকি গোটা বিশ্বে! এখনও বর্ণবৈষম্যের জালে আটকে অনেকে ঝটপট করে ধুকে ধুকে যন্ত্রণায় ভুগছি। এ যন্ত্রণার ওষুধ তৈরি হয়নি আজও!

বহুদিন পর মনে পড়ে গেলো আজ মামির হাতের সেই চিত্রাঙ্কনের কথা। কী কঠিন সময় পার হয়েছে নারীদের জীবনে বর্ণ বর্ণবৈষম্যতার কারণে? নারী জাতির জীবনে কত বাঁধা! প্রথমত পরের ঘরে এসে নিজেকে মানিয়ে নেয়া থেকে শুরু, পরে নারী থেকে রমণী হতে কত রকম সংকট কাটিয়ে উঠে শেষে রমণী হন।

একে একে গৃহিণী, মা, দাদি/নানি— নারী তো নয় যেন স্বর্গের এক জননী। যাইহোক আমার মামীর গায়ের রং কালো তবে তিনি এক চমৎকার রমনী, তিনি আজও আমাদের আদরের মামী।

বিজ্ঞাপন

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com

এমআরএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com