বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র
পাঁচ মহাদেশজুড়ে অভিবাসীদের ‘গেইম’

বাংলাদেশে থেকে যাত্রা শুরু। তারপর দুবাই হয়ে আফ্রিকার কোনো একটি দেশ। সেখান থেকে ইউরোপ হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, তারপর সাত-আটটি দেশ পাড়ি দিয়ে চূড়ান্ত গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০ থেকে ৪০ লাখ টাকা খরচ করে এমন দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের পথ বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশিরা।
এই যাত্রায় পাঁচ মহাদেশজুড়ে রয়েছে মানবপাচাকারীদের নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কে দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি যেসব দেশে অভিবাসীদের রাখা হয়, সেখানকার স্থানীয়দের অনেকেই জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া থেকে ভুয়া পাসপোর্টে ব্রাজিল যাওয়ার সময় এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে আটক হন দুই বাংলাদেশি। এর আগে আরও কয়েকজনের আশ্রয় আবেদন বাতিল করে গাম্বিয়ায় ফেরত পাঠিয়েছে নেদারল্যান্ডস কর্তৃপক্ষ। পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ ঘানা থেকেও ইনফোমাইগ্রেন্টসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী।
মূল ট্রানজিট দুবাই
বাংলাদেশ থেকে এই পথে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের প্রথম গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাই। পর্যটন বা ট্রানজিট ভিসার ক্ষেত্রে অনেকটাই শিথিলতা দেখায় সেখানকার কর্তৃপক্ষ। বিমানের টিকিট, হোটেল বুকিং, অন্য কোনো দেশে ভর্তি হতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ভর্তির অনুমোদনপত্রসহ বিভিন্ন নথি দেখিয়ে সহজেই পাওয়া যায় আরব আমিরাতের ভিসা।
দুবাই এবং বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট থেকে কীভাবে ‘কন্ট্রাক্টের’ মাধ্যমে অভিবাসীদের নির্বিঘ্নে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় তা সাইপ্রাসে এসে আটকেপড়া অনেক বাংলাদেশি অভিবাসী এবং তাদের এজেন্টরাও ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ থেকে ২০২২ সালে দুবাইয়ে পৌঁছান লিটন ও জামান। বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে এক শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা তারা। সেখানেই তারা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের যাত্রার বিস্তারিত তুলে ধরেন।
লিটন জানান, তিনি মূলত ব্রাজিল যাওয়ার জন্য বাংলাদেশি এজেন্টকে প্রাথমিকভাবে প্রায় ১৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সেই এজেন্টই তাকে শুরুতে দুবাই আসার ব্যবস্থা করে দেন।
তিনি বলেন, ‘আমি নোয়াখালী থেকে ঢাকা এসেছি। এখানে আসার পরে আমি দালাল ধরেছি আমাকে ব্রাজিল পৌঁছে দেওয়ার জন্য। পরে আমি ওদের পাসপোর্ট দেই। কয়েকদিন পর তারা আমাকে জানিয়েছে আপনার ভিসা হয়ে গেছে, আপনাকে দুবাই পাঠানো হবে।’
কাকে কীভাবে কোন রুটে পাঠানো হবে, সেটি মূলত দুবাই থেকেই নির্ধারণ করা হয়। লিটন এবং জামানকে যেমন গাম্বিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। অনেককে ভিন্ন রুটেও পাঠানো হয়।
জামান বলেন, ‘আমি জানতাম না আমাকে কোনদিক দিয়ে পাঠানো হবে। আমার প্রসেসিংটা যেভাবে করলে ভালো হবে, সেটাই তারা (দালাল) করেছে। আমি আফ্রিকা দিয়ে এসেছি, অনেকে সরাসরি দুবাই থেকেই আসে, যখন যেদিকে সুবিধা হয়।’
আগাম ভিসা নেওয়া না থাকলে দুবাই থেকে ইউরোপের কোনো দেশে বৈধ উপায়ে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব। ফলে দালালরা বেছে নেন অন্য এক উপায়-ভুয়া পাসপোর্ট।
আফ্রিকায় অবস্থান, ভুয়া পাসপোর্টে ইউরোপে ট্রানজিট
দুবাইয়ে ২২-২৩ দিন রাখার পর ই-ভিসা করে লিটনকে নিয়ে আসা হয় গাম্বিয়া। প্রায় এক বছর তিনি পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতেই অবস্থান করেন। সেখানেই পাকিস্তানের এক নাগরিকের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার জাল পাসপোর্ট তৈরি করানো হয়। ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকদের জন্য ব্রাজিলে রয়েছে ভিসামুক্ত প্রবেশের অনুমতি। আর সে সুযোগকেই কাজে লাগাতে চান অভিবাসীরা।
কিন্তু এই প্রচেষ্টা অনেকক্ষেত্রেই সফল হয় না। হয়নি লিটন আর জামানের ক্ষেত্রেও। ১৯ এপ্রিল নেদারল্যান্ডসে এসে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তারা। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার স্বপ্নে যাত্রা করা এই অভিবাসীদের আশ্রয় এখন আমস্টারডামের একটি শরণার্থী শিবিরে।
ভুয়া পাসপোর্ট দিয়ে ব্রাজিল যাওয়ার সময় নেদারল্যান্ডসে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে আটক হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। দেশটির ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে এ বিষয়ে ইনফোমাইগ্রেন্টসের পক্ষ থেকে পরিসংখ্যান জানতে চাইলেও তার উত্তর এখনও মেলেনি। তবে অভিবাসীদের সূত্রে অন্তত আরও দুই বাংলাদেশির আটক হওয়ার তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে একজনের আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়ার পর তাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে গাম্বিয়ায়, অন্যজনকেও দ্রুত ফেরত পাঠানো হতে পারে।
আন্তর্জাতিক আইন এবং ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন অনুসারে পাসপোর্ট না থাকলে বা ভুয়া পাসপোর্ট ও পরিচয়পত্র নিয়ে কেউ কোনো দেশে প্রবেশ করলেও তার আশ্রয় আবেদনের সুযোগ থাকে। ফলে আবেদনের নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আশ্রয় দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর।
লিটন জানান, বিমানবন্দরে তাদের ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করার অপরাধে দুই মাসের কারাদণ্ড হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা। পরে তাকে এবং জামানকে প্রায় দুই সপ্তাহ নেদারল্যান্ডসের একটি আটককেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। সেখানে বেশ কয়েকবার তাদের পরিচয় এবং সে দেশে আসার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। পরে লিটন এবং জামান নেদারল্যান্ডসেই রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদনের সুযোগ চাইলে তাদের পাঠানো হয় উন্মুক্ত আশ্রয় কেন্দ্রে। এখন তারা চাইলেই কেন্দ্রের বাইরে বিনা বাধায় চলাফেরাও করতে পারেন।
একই রুটে আসার অপেক্ষায় পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ ঘানায় রয়েছেন অর্ধশতাধিক বাংলাদেশি। একাধিক বাংলাদেশি অভিবাসী দেশটির রাজধানী আক্রা থেকে যোগাযোগ করেছেন ইনফোমাইগ্রেন্টসের সঙ্গে। তেমনই একজন রিমন।
তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের এক ভাই এর মাধ্যমে আমি দুবাই থেকে এই ঘানাতে আসি। আমি যেখানে থাকি সেখানে সে আরও কিছু লোক বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছে এবং আমাদের সবার কাছ থেকে ইউরোপ আমেরিকা ভিসা করে দেবে বলে ১৫-১৮ লাখ করে টাকা নিয়েছে। সে বর্তমানে সবার টাকা ফেরত না দিয়ে ঘানা ছেড়ে ইউরোপ পালিয়ে গেছে।
তার পরিচিত অন্তত ৫৫ জন বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার উদ্দেশ্যে আক্রায় অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন রিমন।
শাহেদ নামে আরেক অভিবাসী জানিয়েছেন, আমি বর্তমানে ঘানাতে আছি ভাই। আমিও আমেরিকায় যাওয়ার জন্য এসেছি। দালালে আমাকে নিয়ে এসেছে। এখানে এসেছি চার পাঁচ মাস হয়েছে এখনও কিছুই করতে পারিনি।
শাহেদও অন্যদের মতোই প্রথমে দুবাই আসেন। সেখানে ২০ দিন থেকে ই-ভিসা নিয়ে চলে আসেন ঘানা। তিনি বলেন, এখানে অনেক বাঙালিকে এনে রেখেছে দালাল, দালালে এক একজনের কাছ থেকে ২০-২৫ লাখ টাকা নিয়েছে ফ্লাইট করাবে বলে, এখানে অনেকেই এসেছে দেড় বছর হয়ে গেছে। যাদের ফ্লাইট করানো হয় নাই ওদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে। তাদের পাসপোর্ট দালালের হাতে। দালাল বলছে, এখন এই রোড বন্ধ হয়ে আছে চালু হলে তোমাদের ফ্লাইট করানো হবে।
ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি এবং ফ্লাইট বুক করার জন্য সময় লাগে অনেক। কাউকে কাউকে অপেক্ষা করতে হয় এক বছরেরও বেশি। এই সময়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে ব্যবসার কথা বলে দালালরাই অভিবাসীদের বসবাসের অনুমতি জোগাড় করে দেন। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই আফ্রিকার থাকার পুরোটা সময় খাওয়া এবং থাকার খরচ অভিবাসীদের আনতে হয় দেশ থেকেই।
অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অনেকেই এরই মধ্যে হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন দেশে। কিন্তু তাদের কাউকেই আর টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি।
শাহেদ জানিয়েছেন, থাকা খাওয়ার খরচ বাড়ি থেকে এনে চলতে হয়। আমরা বাসা থেকে খুব কম বের হই। এখানে বাসা ভাড়া করে থাকি। আমরা নয় জনের মতো আছি, আরও ছিল প্রায় ৩০ জনের মতো। ওরা দেশে চলে গেছে। তাদের দালাল এক টাকাও ফেরত দেয়নি।
বৈধ অভিবাসনে বাধা
আফ্রিকা ও ল্যাটিন অ্যামেরিকা হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার জন্য নানা ধাপে বাংলাদেশি অভিবাসীদের অন্তত ২০ থেকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কেউ সংগ্রহ করেন ভিটেমাটি বন্ধক বা বিক্রি করে, কেউ নানা জনের কাছ থেকে ধার করে।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, এই পরিমাণ অর্থ খরচ করে দেশেও কিছু করা সম্ভব ছিল কিনা। অনেকে মনে করেন এই টাকা থাকলে সহজে ইউরোপ-আমেরিকার নানা দেশের ভিসা বৈধভাবেই জোগাড় করাও সম্ভব।
কিন্তু অনিয়মিত পথে রওনা হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীরা তা মানতে নারাজ। তাদের অনেকেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি করেছেন। নিজেকে বিএনপির কর্মী দাবি করে জামান বলেন, তার নামেও দেশে ভুয়া মামলা রয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্নভাবে পুলিশি হয়রানি তো রয়েছেই।
অন্যদিকে, দুবাইয়ে ভ্রমণের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও যেভাবে সহজে ভিসা পাওয়া যায়, ইউরোপ বা আমেরিকার ক্ষেত্রে তা প্রায় অসম্ভব। আর সে সুযোগই নানাভাবে দালালেরা কাজে লাগান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কিছু জানে না বাংলাদেশ দূতাবাস
অভিবাসনের জন্য ব্রাজিলকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে অভিবাসীরা জানিয়েছেন, দেশটিতে এরই মধ্যে অনেক বাংলাদেশি বসবাস করছেন। লিটন বলেন, ব্রাজিলে আমাদের সহজেই থাকতে দেয়। সেখানো ঢোকাটাও সহজ। আমাদের আশপাশের অনেক মানুষই এভাবে ওখানে থাকছে।
অনিয়মিত অভিবাসন বিষয়ে জানতে চেয়ে ব্রাজিলে বাংলাদেশি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত। ইনফোমাইগ্রেন্টসকে পাঠানো একটি ফিরতি ইমেইলে দূতাবাস জানিয়েছে, ‘আপনার ইমেইলে পাঠানো বিষয়বস্তু (বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিলে অনিয়মিত অভিবাসন) সম্পর্কে কোনো তথ্য দূতাবাসের কাছে নেই।’
ব্যক্তিগত গোপনীয়তার স্বার্থে অভিবাসীদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস
এমআরএম/এমএস