কোরআনের ছন্দময় তেলাওয়াতে সম্পন্ন হবে খতম তারাবি
লাইলাতুল কদর পাওয়ার বেজোড় রাত আজ। ২৭ তারাবি। কোরআনের ছোট ছোট আয়াত সমৃদ্ধ ছন্দময় সুরাগুলো তেলাওয়াতের মাধ্যমে খতম তরাবিহ সম্পন্ন হবে। দেখতে দেখতে রমজানের ২৬ দিন শেষ হয়ে ২৭ তারাবি পড়বে রোজাদার মুসলমান। ৩০তম পারায় আজ ৩৭টি ছন্দময় সুরা পড়বেন হাফেজে কোরআনগণ। আজ হতে পারে মর্যাদার রাত 'লাইলাতুল কদর' মসজিদে মসজিদে আজ বাড়বে মানুষের ভীড়। সারারাত লাইলাতুল কদর পাওয়ার আশায় ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকবে রোজাদার।
রমজানের তারাবি শেষ না হলেও আজ তারাবিতে কোরআন পড়া সম্পন্ন হবে। লাইলাতুল কদরের রাতে ক্ষমা প্রার্থনায় বিশ্বনবির শেখানো দোয়াও পড়বে আজ মুমিন-মুসলমান। কী সেই দোয়া?
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, একবার আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম- হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি বলে দিন, আমি যদি লাইলাতুল কদর কোন রাতে হবে তা জানতে পারি, তাতে আমি কী (দোয়া) পড়বো?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি বলবে-
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
উচ্চারণ : 'আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, তিরমিজি, মিশকাত)
পুরো রমজান মাস জুড়ে যারা সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছে এবং মহান প্রভু রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত লাভে ধন্য হতে পেরেছে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের সফলতা। আর যারা রমজানকে কাজে লাগাতে পারেনি তারাই ব্যর্থ। আজ সুরা নাবা তেলাওয়াতের মাধ্যমে তারাবিহ শুরু হবে। এ সুরায় কেয়ামত সম্পর্কেই জিজ্ঞাসার মাধ্যমে নামাজ শুরু হবে।
সুরা নাবা থেকে সুরা নাস পর্যন্ত সর্বমোট ৩৭টি সুরা পড়া হবে। আজকের তারাবিতে লাইলাতুল কদর নিয়ে নাজিল হওয়া স্বতন্ত্র একটি সুরাও পড়া হবে। আজকের তারাবিহতে পঠিত সুরাগুলোর সংক্ষিপ্ত আলোচ্য সূচি তুলে ধরা হলো-
সুরা নাবা : আয়াত ০১-৪৯
মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরাটি কিয়ামতের ভয়াবহতা কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জাহান্নাম ও তার অধিবাসীদের অবস্থার বর্ণনার পাশাপাশি জান্নাতএবং তাঁর অধিবাসীদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। সর্বশেষে হাশরের ময়দানে অবিশ্বাসীদের আফসোস ও অনুশোচনার বর্ণনা ওঠে এসেছে।
এ সুরায় কেয়ামতের ভয়াবহ বর্ণনা অস্রুবিসর্জন দেবে মুমিন। আবার পরক্ষণেই জান্নাতের নেয়ামত লাভের কথায় মুমিনের হৃদয়ে আনন্দ ও খুশি বিরাজ করবে। ৩০তম পারায় কেয়ামতের আলোচনাই হয়েছে বেশি। কেয়ামতের ভয়বাহতা তুলে ধরেআল্লাহ তাআলা বলেন-
নিশ্চয় বিচার দিবস নির্ধারিত রয়েছে। যেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তখন তোমরা দলে দলে সমাগত হবে। আকাশ বিদীর্ণ হয়ে; তাতে বহু দরজা সৃষ্টি হবে।এবং পর্বতমালা চালিত হয়ে মরীচিকা হয়ে যাবে। নিশ্চয় জাহান্নাম প্রতীক্ষায় থাকবে, সীমালংঘনকারীদের আশ্রয়স্থলরূপে। তারা তথায় শতাব্দীর পর শতাব্দী অবস্থান করবে। তথায় তারা কোন শীতল এবং পানীয় আস্বাদন করবে না; কিন্তু ফুটন্ত পানি ও পূঁজ পাবে। পরিপূর্ণ প্রতিফল হিসেবে। নিশ্চয় তারা হিসাব-নিকাশ আশা করত না। 'সুরা নাবা : আয়াত ১৭-২৭)
আবার মুমিন জান্নাতেদের নেয়ামত ও সুখ-শান্তির বর্ণনায় মুমিন মুসলমানের হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বইবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
পরহেযগারদের জন্যে রয়েছে সাফল্য। উদ্যান, আঙ্গুর, সমবয়স্কা, পূর্ণযৌবনা তরুণী। এবং পূর্ণ পানপাত্র। তারা তথায় অসার ও মিথ্যা বাক্য শুনবে না। এটা আপনার পালনকর্তার তরফ থেকে যথোচিত দান।' (সুরা নাবা : আয়াত ৩১-৩৬)
সুরা নাযিআত : আয়াত ০১-৪৬
সুরা নাযিআত মক্কায় অবতীর্ণ। এ সুরায় আল্লাহ তাআলা কিয়ামত অবশ্যই আসবে। এবং তা অতি সন্নিকটে। তাই আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে কিভাবে হককে বাতিলের বিজয়ী করবেন তা বর্ণনা করেছেন। উপমা স্বরূপ হজরত মুসা আলাইহিস সালাম কিভাবে ফেরাউনের ওপর বিজয় লাভ করেছিলেন এবং ফেরাউন ধ্বংস হয়েছিল তা ওঠে এসেছে এ সুরায়।
সুরা আবাসা : আয়াত ১-৪২
মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায় দানের পদ্ধতি, উপদেশ গ্রহণ না করার প্রতি তিরস্কার, উপদেশ গ্রহণ থেকে বিমুখ ব্যক্তিদের পরলৌকিক শাস্তি এবং উপদেশ গ্রহণকারীদের পরকালীন জীবনের পুরস্কারের বর্ণনা করা হয়েছে।
সুরা তাকভীর : আয়াত ১-২৯
মক্কায় অবতীর্ণ সুরা তাকভীরে কিয়ামতের দৃশ্যকে চিত্রায়ন করা হয়েছে। তাইতো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে বক্তি কিয়ামতের দৃশ্য নিজ চোখে দেখতে চায়, সে যেন সুরা তাকভীর এবং সুরা ইনশিকাক পাঠ করে।
সুরা ইনফিতার : আয়াত ১-১৯
এ সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এ সুরার মূল বিষয়বস্তু হলো পরকাল। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিনকে দেখতে চায়, সে যেন সুরা তাকভীর, ইনফিতার ও ইনশিকাক পাঠ করে।
সুরা মুতাফফিফিন : আয়াত ১-৩৬
মক্কায় নাজিল হওয়া সুরা মুতাফফিফিনে আল্লাহ তাআলা পরকালের বিষয় তুলে ধরেছেন। এ সুরায় ব্যবসার ক্ষেত্রে ক্রয়ের সময় বেশি গ্রহণ করে বিক্রয়ের সময় কম দেয়ার অনৈতিকতা তুলে ধরা হয়েছে। এ সুরার শেষে সৎ ও ভালো লোকদের সুখ-শান্তি আলোচনা করা হয়েছে। কাফেরদের ঠাট্টা-বিদ্রুপের জন্য তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে কাফেরদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।
সুরা ইনশিক্বাক্ব : আয়াত ১-২৫
মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায়ও কিয়ামতের চিত্রায়ন করা হয়েছে।
সুরা বুরুজ : আয়াত ১-২২
মক্কায় অবতীর্ণ সুরা বুরুজে কাফেররা ঈমানদারের ওপর যে অত্যাচার নির্যাতন করেছিল তার নির্মম পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে এবং সে সঙ্গে মুসলমানদেরকে উত্তম প্রতিফলের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
সুরা ত্বারেক : আয়াত ১-১৭
সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায় তাওহিদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং সর্বশেষ কাফেরদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা জ্ঞাত, যাতে তারা সফলতা লাভ করতে পারবে না, তার বিবরণ ওঠে এসেছে।
সুরা আলা : আয়াত ১-১৯
মক্কা অবতীর্ণ এ সুরায় তাওহিদের আলাচনা করার পাশাপাশি বিশ্বনবিকে উপদেশ প্রদান এবং পাপিষ্ঠ ও কাফেরদের অশুভ পরিণতি এবং ঈমানদারের পরকালীন সাফল্যের কথা ওঠে এসেছে।
সুরা গাশিয়া : আয়াত ১-২৬
২৬ আয়াত বিশিষ্ট মক্কী সুরায় তাওহিদ ও পরকালের আলোচনা করা হয়েছে।
সুরা ফজর : আয়াত ১-৩০
মক্কী সুরা আল ফজরে পরকালের শাস্তি এবং পুরস্কারের আলোচনা করা হয়েছে। কারণ মক্কার অবিশ্বাসীরা পরকালকে বিশ্বাসই করতো না।
সুরা বালাদ : আয়াত ১-২০
এ সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ প্রাথমিক প্রত্যাদেশ সমূহের অন্যতম। এ সুরায় মক্কা বিজয়ের সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী ও সৎকর্মের আলোচনা করা হয়েছে।
সুরা শামস : আয়াত ১-১৫
মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায় নেকি ও বদ, পাপ ও পূণ্যের পার্থক্য বুঝানোর জন্য নাজিল করা হয়েছে। যারা নেকি ও বদ, পাপ এবং পূণ্যকে অবিশ্বাস করে তাদের শাস্তির বিষয়টিও ওঠে এসেছে এ সুরায়।
সুরা লাইল : আয়াত ১-২১
মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায় আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমাণ আনা; তাঁর সন্তুষ্টিতে দান-খয়রাত করা; উদারতা ও মহানুভবতার গুণ অর্জন করার ইঙ্গিত প্রদান। পাশাপাশি কুফর ও শিরকে লিপ্ত হওয়া, অহংকার ও কার্পণ্য করা, মানুষের হক বিনষ্ট করায় রয়েছে পরকালীন জীবনের অবাধারিত শাস্তি।
সুরা দোহা : আয়াত ১-১১
মক্কায় অবতীর্ণ সুরা দোহায় আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবকে সান্ত্বনার জন্য নাজিল করেছেন।
সুরা আলাম-নাশরাহ : আয়াত ১-৮
নবুয়তের পূর্বে বিশ্বনবি মক্কায় ব্যাপক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন; ইসলামের দাওয়াত দেয়ায় যে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সে জন্য মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায় তাঁকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে।
সুরা ত্বীন : আয়াত ১-৮
এ সুরাটিও মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এ সুরায় মানুষের উৎপত্তি ও পরিণতির বিষয় আলোচিত হয়েছে।
সুরা আলাক্ব : আয়াত ১-১৯
মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায় রয়েছে বিশ্বনবির প্রতি নাজিলকৃত প্রথম প্রত্যাদেশ। লাইলাতুল কদরের মর্যাদার রাতেই মহান আল্লাহ তাআলা নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এ সুরাটি নাজিল করেন। এ সুরার প্রথম ৫ আয়াত নাজিলের মাধ্যমে নবুয়তের সূচনা হয়েছিল। তাছাড়া এ সুরায় বিশ্বনবির বাইতুল্লায় নামাজ আদায়কালীন সময়ে আবু জেহেলের ধমকের বিষয়ও ওঠে এসেছে।
সুরা ক্বদর : আয়াত ১-৫
এ সুরার অবতীর্ণের স্থান নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এ সুরায় কোরআন মাজিদের মর্যাদা, মূল্য ও গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। লাইলাতুল কদরের মর্যাদার বিষয়টিও এ সুরায় বর্ণনা করা হয়েছে।
হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রাত 'লাইলাতুল কদর'
লাইলাতুল কদর। সম্মানিত ও মর্যাদার একটি রাত। যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ রাতের এতবেশি মর্যাদার কথা কোনো মানুষ বলেনি। এটি কোরআনুল কারিমের ঘোষণা। মহান আল্লাহ এই রাতকে হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রাত হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন। রমজানের শেষ দশকে আল্লাহ তাআলা রোজাদার বান্দাকে এ রাতটি দান করেন। এ রাতে দয়াময় প্রভু অসংখ্য ফেরেশতা ও জিবরিল আলাইহিস সালামকে জমিনে পাঠান। এই রাতের ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত বিরাজ করে শান্তি আর শান্তি।
কদর শব্দটি আরবি। ইহার অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। এই রাতের অধিক মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণে এটাকে মহিমান্বিত রজনী বলা হয়। আবার ভাগ্য অর্থেও শব্দটি প্রয়োগ হয়। তখন অর্থ হবে, এই রাতে মানুষের পরবর্তী এক বছরের ভাগ্য ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যার মধ্যে মানুষের বয়স, মৃত্যু ও রিজিকসহ সব কিছু রয়েছে।
এই রাতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসেও বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। এই মাসের শেষ দশকে যেকোন দিন ‘লাইলাতুল কদর’ হতে পারে, তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ দশককে এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে, তিনি ইবাদতের জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন এবং পুরো রাত জাগ্রত থেকে নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া ও জিকিরের মাধ্যমে অতিবাহিত করতেন। এমনকি তিনি তার পরিবারের সদস্যদেরও ইবাদত করার জন্য ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন।
শবে কদরের মর্যাদা
মর্যাদার এ রাত সম্পর্কে কোরআনে একাধিক আয়াতসহ ও একটি স্বতন্ত্র সুরা নাজিল করে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের বিষয়টি এভাবে জানিয়ে দিয়েছেন-
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰهُ فِیۡ لَیۡلَۃِ الۡقَدۡرِ
‘নিশ্চয়ই আমরা কোরআন নাজিল করেছি লাইলাতুল কদরে; (সুরা কদর : আয়াত ১)
আল্লাহ তাআলা এ রাতে কোরআন নাজিল করেছেন। আর তা রমজান মাসে সীমাবদ্ধ। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেছেন-
شَهۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡهِ الۡقُرۡاٰنُ
'রমজান মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে।' (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হেরা গুহায় যে রাতে আল্লাহর ফেরেশতা অহি নিয়ে এসেছিলেন সেটি ছিল রামজান মাসের একটি রাত। এ রাতটিই ছিল লাইলাতুল কদর। সুরা দুখানে আল্লাহ এ রাতকে বরকতময় বলে ঘোষণা দিয়েছেন-
وَ الۡکِتٰبِ الۡمُبِیۡنِ - اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنٰهُ فِیۡ لَیۡلَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ اِنَّا کُنَّا مُنۡذِرِیۡنَ
'শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের! নিশ্চয়ই আমরা এটা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমরা সতর্ককারী।' (সুরা দুখান : আয়াত ২-৩)
এক হাদিসে নবিজী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা নবি-রাসুলদের প্রতি যত কিতাব নাজিল করেছেন, তা সবই রমজান মাসেরই বিভিন্ন তারিখে নাযিল হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-এর সহিফাসমূহ রমজানের প্রথম তারিখে নাজিল করেছেন। তাওরাত রমজানের ৬ তারিখে নাজিল করেছেন। যাবুর রমজানের ১২ তারিখে নাজিল করেছেন। ইঞ্জিল রমজানের ১৮ তারিখে এবং কোরআন রমজানের চব্বিশ তারিখ অতিবাহিত হওয়ার পর (পঁচিশের রাতে) নাজিল করেছেন।' (মুসনাদে আহমাদ)
কোরআন নাজিলের কারণেই লাইলাতুল কদর অনেক মর্যাদার রাত। আল্লাহ তাআলা সুরা কদরে এ রাত সম্পর্কে প্রশ্ন করেন-
وَ مَاۤ اَدۡرٰىکَ مَا لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ
'তোমাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল ক্বাদর’ কী?'
এখানে প্রশ্ন করে এই রাতের মর্যাদা ও গুরুত্ব ব্যক্ত করা হয়েছে। যেন সৃষ্টি এর সুগভীর রহস্য পূর্ণরূপে জানতে সক্ষম নয়। একমাত্র আল্লাহই এ ব্যাপারে পূর্ণরূপ অবগত। এ কারণেই লাইলাতুল কদর তালাশে নবিজী নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে-
১. নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 'রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর।' (বুখারি)
২. নবিজী আরও বলেছেন, 'তোমরা তা শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে তালাশ কর।' (বুখারি,মুসলিম, তিরমিজি)
৩. যদি লাইলাতুল কদরকে রামাদানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে ঘূর্ণায়মান এবং প্রতি রমজানে পরিবর্তনশীল মেনে নেয়া যায়, তবে লাইলাতুল কদরের দিন-তারিখ সম্পর্কিত হাদিসসমূহের মধ্যে কোনো বিরোধ অবশিষ্ট থাকে না। এটিই প্রাধান্য পাওয়া মত।' (ফাতহুল বারি)
لَیۡلَۃُ الۡقَدۡرِ ۬ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَهۡرٍ
'লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।' (সুরা কদর : আয়াত ৩)
এই রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। আর হাজার মাসে ৮৩ বছর ৪ মাস হয়। উম্মতে মুহাম্মাদির উপর কত বড় আল্লাহর অনুগ্রহ যে, তিনি তাকে তার সংক্ষিপ্ত জীবনকালে বেশি সওয়াব অর্জন করার সহজ পন্থা দান করেছেন। মুফাস্সিরগণ এর অর্থ করেছেন, এ রাতের সৎকাজ হাজার মাসের সৎকাজের চেয়ে ভালো।' (মুয়াসসার) এ শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিসে বিস্তারিত বলা হয়েছে-
১. রমজান আগমনকালে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, 'তোমাদের কাছে রমজান আসন্ন। বরকতময় মাস। আল্লাহ এর রোজা ফরজ করেছেন। এতে জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয়ে থাকে এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। শয়তানগুলোকে বেঁধে রাখা হয়। এতে এমন এক রাত রয়েছে যা হাজার মাস থেকেও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সে তো যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো।' (নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ)
২. নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যে কেউ ঈমান ও সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরের রাতে নামাজ আদায় করতে দাঁড়াবে তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।' (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ)
লাইলাতুল কদরে বরকত নাজিল
تَنَزَّلُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ الرُّوۡحُ فِیۡهَا بِاِذۡنِ رَبِّهِمۡ ۚ مِنۡ کُلِّ اَمۡرٍ
সে রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ নাজিল হয়; তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব (কাজের) সিদ্ধান্ত নিয়ে।' (সুরা কদর : আয়াত ৪)
আয়াতে ‘রূহ’ বলে জিবরিল আলাইহিস সালামকে বোঝানো হয়েছে। জিবরিল আলাইহিস সালামসহ ফেরেশতাগণ এই রাতে ঐ সব কাজ আঞ্জাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে অবতরণ করেন, যা আল্লাহ এক বছরের জন্য ফায়সালা করে থাকেন। হাদিসে এসেছে-
১. উম্মুল মুমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'যখন রমজানের শেষ দশক আসত তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার চাদর কষে নিতেন (অর্থাৎ বেশি বেশি ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাতে জেগে থাকতেন ও পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।' (বুখারি, মুসলিম)
২. নবিজী দীর্ঘ এক ভাষণ প্রদান করেন এবং উক্ত ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘এই মাসে এমন এক মহিমান্বিত রাত রয়েছে যে রাতের মাহাত্ম্য হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “রমজান মাসে এমন এক রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো।‘ (নাসাঈ ও মুসনাদে আহমাদ)
৩. 'লাইলাতুল কদরের রাতে পৃথিবীতে ফেরেশতারা এত বেশি অবতরণ করেন যে, তাদের সংখ্যা পাথরকুচির চেয়েও বেশি।' (মুসনাদে আহমাদ)
পবিত্র কোরআনুল কারিমে এই রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ মহিমান্বিত বা ভাগ্য রজনী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই মাসে সিয়াম সাধনাসহ যতপ্রকারের ইবাদত করার চেষ্টা আমরা করেছি, তার ভুল-ত্রুটি থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে মহান আল্লাহর দরবারে কবুল করানোর আরজি পেশ করার এটিই একমাত্র নির্ধারিত রাত।
سَلٰمٌ ۟ هِیَ حَتّٰی مَطۡلَعِ الۡفَجۡرِ
'শান্তিময় সে রাত, ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত।' (সুরা কদর : আয়াত ৫)
'সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সারা রাত শুধু শান্তিই শান্তি, মঙ্গলই মঙ্গল তথা কল্যাণে পরিপূর্ণ। সে রাত সর্বপ্রকার অনিষ্ট থেকে মুক্ত।' (তাবারি)
এ রাতে কোনো প্রকার অমঙ্গল নেই। শুধু ‘শান্তিময়’। মুমিন এই রাতে শয়তানের অনিষ্ট থেকে নিরাপদে থাকে। এ রাতে ফেরেশতাগণ ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে সালাম পেশ করেন। কিংবা ফেরেশতাগণ আপোসে একে অপরকে সালাম দিয়ে থাকেন।
শবে কদরের ইবাদত
এই রাতে বিভিন্ন প্রকারের ইবাদত রয়েছে। বিখ্যাত আলেমগণ এই রাতে ইবাদতের আগে গোসল করে নতুন পোশাক পরতেন। সুগন্ধি লাগানোকে মুস্তাহাব বলেছেন। বর্ণিত আছে-
১. হজরত আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু রমজানের ২৪ তারিখ রাতে গোসল করে নতুন কাপড় পরতেন। শরীরে সুগন্ধি লাগাতেন।
২. প্রখ্যাত তাবেয়ি ইবরাহিম লাইলাতুল কদর উপলক্ষে রমজানের শেষ ১০ রাতের সম্ভাব্য রাতগুলোতে গোসল করে সুগন্ধী ব্যবহার করতেন।
৩. কুফার প্রসিদ্ধ তাবেয়ি আবু মারইয়াম ইবনে হুবাইশকে ২৬ তারিখ দিনগত ২৭ তারিখ রাতে গোসল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
৪. তাছাড়া প্রসিদ্ধ তাবেয়ি আইয়ুব সাখতিয়ানী রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ অনেক তাবেয়িগণ রমজানের শেষ দশরাতের যেকোন একরাত লাইলাতুল কদর হবে মনে করে শেষ দশ রাতের অধিকাংশ রাতে গোসল করে নতুন পোশাক পরতেন করতেন এবং সুগন্ধি ব্যবহার করতেন।
সুতারং ইহা থেকে বোঝা গেল, জুমআ এবং ঈদের মত এই রাতে গোসল করে নতুন পোশাক পরে সুগন্ধি মেখে আল্লাহর ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা উত্তম।
এই রাতের আমলের মধ্য উল্লেখযোগ্য হলো-
১. নফল নামাজ
ফরজ নামাজের পর যত বেশি সম্ভব নফল নামাজ পড়া। কেননা, এই রাতের নফল নামাজের উসিলায় করুণাময় ক্ষমাশীল আল্লাহ বান্দার পূর্ববর্তী অপরাধগুলো মাফ করে দেন। হাদিসে এসেছে-
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় নামাজের মাধ্যমে কদরের রাত কাটাবেন, তার আগের গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।‘ (বুখারি)
২. কোরআন তেলাওয়াত
মহিমান্বিত রাতের অন্যতম আমল হলো কোরআন তেলাওয়াত করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশ রাতে এমনভাবে তারতিল সহকারে কোরআন তেলাওয়াত করতেন যে, রহমত বা দয়া সংক্রান্ত কোনো আয়াত এলে তিনি আল্লাহর কাছে (তা) চাওয়া ছাড়া পরের আয়াতে যেতেন না। আর আজাব বা শাস্তি সংক্রান্ত আয়াত এলে তিনি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা ছাড়া পরের আয়াত তেলাওয়াত করতেন না এবং প্রত্যেক আয়াত তেলাওয়াতের সময় গভীরভাবে চিন্তা করতেন।
হজরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'তোমাদের মধ্য কেউ একরাতে কোরআনুল কারিমের এক-তৃতীয়াংশ পড়তে কী অক্ষম? প্রতি-উত্তরে বলা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কে এ কাজ করতে সক্ষম হবে? এই উত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরা ইখলাছ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।' (মুসনাদ তায়ালাসি)
৩. দোয়া
দোয়া এই রাতের গুরুত্বপূর্ণ আমলসমূহের মধ্য অন্যতম।হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু আনহা লাইলাতুল কদরের আমল সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে জানতে চাইলে তিনি আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।' (নাসাঈ)
জিকির এই মহিমান্বিত রজনীর অন্যতম একটি আমল। কারণ, জিকির হলো বান্দা কর্তৃক আল্লাহর মহত্বের ঘোষণার অন্যতম মাধ্যম। মহান আল্লাহর বিশেষ ফেরেশতাগণ যমিনের মধ্য জিকিরের মজলিস তালাশে মগ্ন থাকেন এবং কোথাও জিকিরের মজলিস পেলে সেখানে শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেষ্টনী দিয়ে রাখেন; মজলিস শেষান্তে আসমানে আরোহন করে মহান আল্লাহর নিকট জিকিরকারী বান্দাদের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
তাই জিকিরের মাধ্যমে শবে কদরে বান্দা এই সুযোগটি গ্রহণ করতে পারেন। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-
‘আল্লাহর ভ্রাম্যমাণ বিশেষ (রিজার্ভ) কিছু ফেরেশতা রয়েছে। তারা শুধু বান্দার জিকিরের মজলিসসমূহ অনুসন্ধান করে বেড়ায়। তাঁরা যখন জিকিরের কোন মজলিস পায় তখন সেখানে জিকিরকারী বান্দাদের সাথে বসে যায়। তারা একে অপরকে পাখা দিয়ে বিস্তার করে এমনভাবে বেষ্টন করে রাখে যাতে তাদের ও আসমানের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানও পূর্ণ হয়ে যায়। জিকিরের মজলিস যখন শেষ হয়, তখন তারা আসমানে আরোহণ করে। আল্লাহ তাদের কোথায় থেকে ফিরেছে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা জমিনে অবস্থানকারী আপনার এমন একদল বান্দাদের নিকট থেকে এসেছি যারা আপনার জিকির করে এবং আপনার কাছে তাদের কাঙ্ক্ষি বস্তুর প্রার্থনা করে । তখন আল্লাহ বলেন: আমার বান্দারা আমার কাছে কি চায়? ফেরেশতারা উত্তর দিয়ে বলেন, তারা আপনার কাছে আপনার বেহেশত প্রার্থনা করে। আল্লাহ বলেন, তারা কি বেহেশত দেখেছে? ফেরেশতারা বলেন, না; তারা দেখেননি। আল্লাহ বলেন, তারা যদি আমার বেহেশত দেখত তাহলে কী করত? তারা বলেন, তাহলে তারা আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করত। তিনি বলেন, কিসের থেকে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করত? তারা বলেন, হে আমাদের প্রভু! জাহান্নাম থেকে। তিনি বলেন, আমার বান্দারা কী জাহান্নাম দেখেছে? তারা বলেন, না; তারা দেখেননি। তিনি বলেন, যদি তারা জাহান্নাম দেখত তাহলে কী করত? তারা বলেন, তাহলে তারা আপনার কাছে মাগফেরাত কামনা করত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তখন আল্লাহ বলবেন, আমি আমার ঐ জিকিরকারী বান্দাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং তারা যা আমার কাছে চেয়েছিল আমি তা তাদের দান করলাম।' (মুসলিম)
সুতারং মুসলিম উম্মাহর জীবনে রমজানের শেষ দশকের গুরুত্বপূর্ণ রাত লাইলাতুল কদর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার। এই রাতেই মহান আল্লাহ তাআলা তার বান্দার পরবর্তী বছরের ভাগ্য ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করেন। বান্দাকে ক্ষমা করেন। বান্দার যে কোনো ইবাদত ও ভালো কাজের প্রতিদান হাজার মাসের সমান দান করেন।
সুরা বায়্যিনাহ : আয়াত ১-৮
এ সুরায় রাসুল প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা আলোচিত হয়েছে।
সুরা যিলযাল : আয়াত ১-৮
মক্কায় অবতীর্ণ সুরায় কিয়ামত ও মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্ক আলোচনা করা হয়েছে।
সুরা আদিয়াত : আয়াত ১-১১
মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরাটিতে পরকালের প্রতি অবিশ্বাসের ভয়াবহ পরিণাম দুঃসংবাদের পাশাপাশি পরকালের বিচারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণের দিক-নির্দেশনা আলোচিত হয়েছে।
সুরা ক্বারিয়াহ : আয়াত ১-১১
মক্কী সুরা ক্বারিয়া। এ সুরায় কিয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়া; পরকালের পুনরায় জীবিত হওয়া, দুনিয়ার জীবনের কৃতকর্মের হিসাব প্রদান এবং প্রতিদান গ্রহণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
সুরা তাকাছুর : আয়াত ১-৮
এ সুরাটিও মক্কায় অবতীর্ণ। এতে দুনিয়ার পুজা এবং বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে মানুষকে আখিরাতপন্থী এবং পরকালমুখী করাই এ সুরার উদ্দেশ্য।
সুরা আসর : আয়াত ১-৩
অতিশয় ক্ষুদ্র সুরা অথচ ব্যাপক অর্থবোধক। এ সুরায় মানুষের জীবনের নীতি-আদর্শ ও কর্ম কেমন হওয়া উচিত তা তুলে ধরেছেন।
সুরা হুমাযাহ : আয়াত ১-৯
এ সুরায় ইসলাম পূর্ব জাহেলী সমাজের অর্থ পুজারি ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে কতগুলো মারাত্মক ধরনের নৈতিক ত্রুটি ও দোষ বিদ্যমান ছিল তা তুলে ধরা হয়েছে।
সুরা ফিল : আয়াত ১-৫
মক্কায় অবর্তীণ এ ঐতিহাসকি সুরা। যেখানে বাইতুল্লাহকে ধ্বংসে আবরাহার বিশাল হস্তি বাহিনীর আলোচনা হয়েছে। আবার হস্তিবাহিনীকে ধ্বংসে আল্লাহর সিদ্ধান্ত আলোচিত হয়েছে এ সুরায়।
সুরা কুরাইশ : আয়াত ১-৪
এ সুরায় শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলা ইবাদতের দাওয়াত দেয়ার জন্য নাজিল হয়েছে।
সুরা মাউন : আয়াত ১-৭
পরকালে অবিশ্বাসীদের চরিত্র কতটা নিচু সে চরিত্র চিত্রায়ন করা হয়েছে এ সুরায়।
সুরা কাউসার : আয়াত ১-৩
বিশ্বনরি প্রতি অজস্র নিয়ামতের বর্ণনা লুকায়িত আছে এ সুরায়।
সুরা কাফিরুন : আয়াত ১-৬
এ সুরায় তাওহিদের শিক্ষা এবং মুশরিকদের বিরুদ্ধাচরণের ঘোষণা হয়েছে। প্রত্যেকের ধর্মমত আলোচিত হয়েছে এ সুরায়।
সুরা নছর : আয়াত ১-৩
আরবের বুকে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুসংবাদ এবং পৌত্তলিকতাকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠানোর শুভ সংকেত হলো এ সুরা।
সুরা লাহাব : আয়াত ১-৫
ইসলামের দুশমনদের কারো নাম উচ্চারণ করে কোনো সুরা অবতীর্ণ হয়নি। ব্যতিক্রম শুধু আবু লাহাব ও তার স্ত্রী। এ সুরায় তার এবং তার স্ত্রীকে লক্ষ্য করে নাজিল করা হয়েছে। তারা বিশ্বনবির দাওয়াতি মিশনের বিরোধিতায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছিল।
সুরা ইখলাস : আয়াত ১-৪
এ সুরাটিতে আল্লাহর একত্ববাদ এবং তাঁর পরিচয়ের বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর পরিচয়ের বিষয়টি সুরা ইখলাসে সুস্পষ্ট তুলে ধরেছেন এভাবে-
قُلۡ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌ
'বলুন, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়।' (সুরা ইখলাস : আয়াত ১)
হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তাআলার বংশ-পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল, যার জওয়াবে এই সুরা নাজিল হয়।' (তিরমিজি, মুসনাদে আহমাদ, মুস্তাদরাকে হাকেম)
কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, মুশরিকরা আরও প্রশ্ন করেছিল- 'আল্লাহ তাআলা কিসের তৈরি, সোনা-রূপা অথবা অন্য কিছুর? এর জওয়াবে সুরাটি অবতীর্ণ হয়েছে।' (নাসাঈ, তাবরানি, মুসনাদে আবু ইয়ালা)
তাই এখানে ‘বলুন’ শব্দটির মাধ্যমে প্রথমত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ আল্লাহ সম্পর্কে তাকেই প্রশ্ন করা হয়েছিল। আপনার রব কে? তিনি কেমন?
আবার এ সুরায় তাকেই হুকুম দেওয়া হয়েছিল, প্রশ্নের জবাবে আপনি একথা বলুন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর এ সম্বোধনটি প্রত্যেক মুমিনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে কথা বলার হুকুম দেওয়া হয়েছিল এখন সে কথা প্রত্যেক মুমিনকেই বলতে হবে।
এ বাক্যটির অর্থ হচ্ছে, তিনি (যার সম্পর্কে তোমরা প্রশ্ন করছে) আল্লাহ, একক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো সমকক্ষ, সদৃশ, স্ত্রী, সন্তান, অংশীদার কিছুই নেই। একত্ব তাঁরই মাঝে নিহিত। তাই তিনি পূর্ণতার অধিকারী, অদ্বিতীয়-এক। সুন্দর নামসমূহ, পূর্ণ শ্রেষ্ঠ গুণাবলী এককভাবে শুধু তারই।' (কুরতুবি)
আর أَحَد শব্দটি শুধু আল্লাহ ছাড়া আর কারও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কেননা তিনিই গুণাবলী ও কার্যাবলীতে একমাত্র পরিপূর্ণ সত্তা।
মোটকথা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর সত্তা ও গুণাবলীতে একক, তার কোনো সমকক্ষ, শরিক নেই। এ সুরার শেষ আয়াত 'আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই' দ্বারা তিনি এর ব্যাখ্যা করেছেন।
মূলত পুরো কোরআন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাত; এমনকি সব নবি-রাসুলদের রেসালাতের আগমন হয়েছিলো এ একত্ব ঘোষণা ও প্রতিষ্ঠার জন্যই। আল্লাহ ছাড়া কোনো হক মাবুদ বা ইলাহ নেই। পুরো সৃষ্টিজগতেই রয়েছে এর পরিচয়, আল্লাহর একত্ববাদের পরিচয়। কোরআনে অগণিত আয়াতে এ কথাটির প্রমাণ ও যুক্তি রয়েছে।
اَللّٰهُ الصَّمَدُ
'আল্লাহ হচ্ছেন সামাদ : তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। (সুরা ইখলাস : আয়াত ২)
এখানে صمد শব্দের অর্থ সম্পর্কে তাফসীরবিদদের অনেক উক্তি আছে। হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু, ইকরামা বলেছেন, 'সামাদ হচ্ছেন এমন এক সত্তা, যার কাছে সবাই তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য (দাবি/চাহিদা) পেশ করে থাকে।'
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আবু ওয়ায়েল শাকিক ইবনে সালামাহ বলেছেন, তিনি এমন সরদার, নেতা, যার নেতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করেছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে।
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যে সরদার তার নেতৃত্ব, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, ধৈর্য, সংযম, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা তথা শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার সমস্ত গুণাবলিতে সম্পূর্ণ পূর্ণতার অধিকারী তিনি সামাদ।
হজরত যায়েদ ইবন আসলাম বলেন, এর অর্থ, নেতা।
হজরত হাসান ও কাতাদা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এর অর্থ- 'যিনি তার সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে গেলেও অবশিষ্ট থাকবেন।'
হজরত হাসান থেকে অন্য বর্ণনায় বলেন, 'তিনি ওই সত্বা, যিনি চিরঞ্জীব ও সবকিছুর ধারক, যার কোনো পতন নেই।'
অন্য বর্ণনায় হজরত ইকরিমা বলেন, 'যার থেকে কোনো কিছু বের হয়নি এবং যিনি খাবার গ্রহণ করেন না।'
হজরত রবি ইবনে আনাস বলেন, 'যিনি জন্ম গ্ৰহণ করেননি এবং জন্ম দেননি।'
শাবি বলেন, এর অর্থ- 'যিনি খাবার খান না এবং পানীয় গ্রহণ করেন না।' (তাবারি, ইবন কাসির, ফাতহুল কাদির)
উপরে সবগুলো অর্থই নির্ভুল। এর মানে হচ্ছে, আসল ও প্রকৃত সামাদ হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। সৃষ্টি যদি কোনো দিক দিয়ে সামাদ হয়ে থাকে তাহলে অন্য দিক দিয়ে তা সামাদ নয়; কারণ তা অবিনশ্বর নয় একদিন তার বিনাশ হবে।
কোনো কোনো সৃষ্টি তার মুখাপেক্ষী হলেও সে নিজেও আবার কারো মুখাপেক্ষী। তার নেতৃত্ব আপেক্ষিক, নিরংকুশ নয়। কারো তুলনায় সে শ্রেষ্ঠতম হলেও তার তুলনায় আবার অন্য কেউ আছে শ্রেষ্ঠতম। কিছু সৃষ্টির কিছু প্রয়োজন সে পূর্ণ করতে পারে। কিন্তু সবার সব প্রয়োজন পূর্ণ করার ক্ষমতা কোনো সৃষ্টির নেই।
পক্ষান্তরে মহান আল্লাহর সামাদ হবার গুণ অর্থাৎ তাঁর মুখাপেক্ষীহীনতার গুণ সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ। সারা দুনিয়া তাঁর মুখাপেক্ষী তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিস নিজের অস্তিত্ব, স্থায়ীত্ব এবং প্রয়োজন ও অভাব পূরণের জন্য সচেতন ও অবচেতনভাবে তাঁরই শরণাপন্ন হয়। তিনিই তাদের সবার প্রয়োজন পূর্ণ করেন।
আল্লাহ; তিনি অমর, অজয়, অক্ষয়। তিনি রিজিক দেন, নেন। সমগ্ৰ বিশ্ব জাহানের ওপর তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই তিনি 'আস-সামাদ'। অর্থাৎ তিনিই একমাত্র সত্তা যিনি অমুখাপেক্ষিতার গুণাবলীর সাথে পুরোপুরি সংযুক্ত। আবার যেহেতু তিনি 'আস-সামাদ' তাই তার একাকি ও স্বজনবিহীন হওয়া অপরিহার্য। কারণ এ ধরনের সত্তা একজনই হতে পারেন, যিনি কারো কাছে নিজের অভাব পূরণের জন্য হাত পাতেন না, বরং সবাই নিজেদের অভাব পূরণের জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী হয়।
দুই বা তার চেয়ে বেশি সত্তা সবার প্রতি অমুখাপেক্ষী ও অনির্ভরশীল এবং সবার প্রয়োজন পূরণকারী হতে পারে না। তাছাড়া তাঁর 'আস-সামাদ' হবার কারণে তাঁর একক মাবুদ হওয়ার ব্যাপারটিও অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
কারণ মানুষ যার মুখাপেক্ষী হয় তারই ইবাদাত করে। আবার তিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। 'আস-সামাদ' হওয়ার কারণে এটাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ, যে প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষমতা ও সামর্থই রাখে না, কোনো সচেতন ব্যক্তি তার ইবাদাত করতে পারে না। এভাবে আমরা উপরোক্ত অর্থগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারি।
لَمۡ یَلِدۡ ۬ وَ لَمۡ یُوۡلَدۡ
'তিনি কাউকেও জন্ম দেননি এবং তাকেও জন্ম দেওয়া হয়নি।' (সুরা ইখলাস : আয়াত ৩)
যারা আল্লাহর বংশ পরিচয় জিজ্ঞাসা করেছিল, এটা তাদের প্রশ্নের উত্তর। সন্তান প্ৰজনন সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য; স্রষ্টার নয়। অতএব, তিনি কারও সন্তান নন এবং তাঁর কোনো সন্তান নেই। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, 'আদম সন্তান আমার উপর মিথ্যারোপ করে অথচ এটা তার জন্য উচিত নয়। আর আমাকে গালি দেয়, এটাও তার জন্য উচিত নয়। তার মিথ্যারোপ হচ্ছে, সে বলে আমাকে যেভাবে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন সেভাবে তিনি কখনও আমাকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন না। অথচ দ্বিতীয় সৃষ্টি প্রথম সৃষ্টির চেয়ে কোনভাবেই কঠিন নয়। আর আমাকে গালি দেওয়ার ব্যাপারটি হলো, সে বলে আল্লাহ সন্তান গ্ৰহণ করেছেন। অথচ আমি একক, সামাদ, জন্মগ্রহণ করিনি এবং কাউকে জন্মও দেইনি। আর কেউই আমার সমকক্ষ নেই।' (বুখারি)
وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّهٗ کُفُوًا اَحَدٌ
'এবং তাঁর সমতুল্য কেউই নেই।' (সুরা ইখলাস : আয়াত ৪)
বলা হয়েছে ‘কুফু’। এর মানে হচ্ছে, নজীর, সদৃশ, সমান, সমমর্যাদা সম্পন্ন ও সমতুল্য। আয়াতের মানে হচ্ছে, সারা বিশ্ব-জাহানে আল্লাহর সমকক্ষ অথবা তাঁর সমমর্যাদাসম্পন্ন কিংবা নিজের গুণাবলী, কর্ম ও ক্ষমতার ব্যাপারে তাঁর সমান পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে এমন কেউ কোনো দিন ছিল না এবং কোনো দিন হতেও পারবে না। এবং আকার-আকৃতিতেও কেউ তাঁর সাথে সামঞ্জস্য রাখে না। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত বুরাইদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে মসজিদে প্রবেশ করে দেখলেন এক লোক নামাজ আদায় করছে এবং বলছে-
اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ بِأَنِّى أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ الَّذِى لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ الأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِى لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُواً أَحَدٌ
উচ্চারণ : 'আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা বিআন্নি আশহাদু আন্নাকা আংতাল্লাহুল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা আংতাল আহাদুস সামাদুল্লাজি লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইউলাদ ওয়া লাম ইকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ।'
এটা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ করে বলছি, এ লোকটি আল্লাহকে তাঁর এমন মহান নামে ডাকলো যার অসিলায় চাইলে তিনি প্ৰদান করেন। আর যার দ্বারা দোয়া করলে তিনি কবুল করেন।' (আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)
মুশরিকরা প্রতি যুগে মাবুদদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করে এসেছে যে, মানুষের মতো তাদেরও একটি জাতি বা শ্রেণী আছে। তার সদস্য সংখ্যাও অনেক। তাদের মধ্যে বিয়ে-শাদী এবং বংশ বিস্তারের কাজও চলে। তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকেও এ জাহেলি ধারণা মুক্ত রাখেনি।
তাঁর জন্য সন্তান সন্ততিও ঠিক করে নিয়েছে। তারা ফেরেশতাদেরকে মহান আল্লাহর কন্যা গণ্য করতো। যদিও তাদের কেউ কাউকে আল্লাহর পিতা গণ্য করার সাহস করেনি। কিন্তু তারা তাদের কোনো কোনো ব্যক্তি বা নবিকে আল্লাহর সন্তান মনে করতে দ্বিধা করেনি। এ সবের উত্তরেই এ সুরায় বলা হয়েছে-
'তিনি কাউকে জন্ম দেননি। আর তাকেও কেউ জন্ম দেয়নি।'
যদিও মহান আল্লাহকে 'আহাদ' ও 'আস-সামাদ' বললে এসব উদ্ভট ধারণা-কল্পনার মুলে কুঠারাঘাত করা হয়, তবুও এরপর 'না তাঁর কোনো সন্তান আছে, না তিনি কারো সন্তান' একথা বলায় এ ব্যাপারে আর কোনো প্রকার সংশয় সন্দেহের অবকাশই থাকে না।
এরপর যেহেতু আল্লাহর মহান সত্তা সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা-কল্পনা শিরকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর অন্তর্ভুক্ত, তাই মহান আল্লাহ শুধুমাত্র সুরা ইখলাসেই এগুলোর দ্ব্যর্থহীন ও চূড়ান্ত প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন।
এভাবে লোকেরা সত্যকে পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ নীচের আয়াতগুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে-
১. اِنَّمَا اللّٰهُ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ ؕ سُبۡحٰنَهٗۤ اَنۡ یَّکُوۡنَ لَهٗ وَلَدٌ ۘ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ وَکِیۡلًا
'আল্লাহই হচ্ছেন একমাত্র ইলাহ। কেউ তাঁর পুত্র হবে, এ অবস্থা থেকে তিনি মুক্ত-পাক-পবিত্র। যা কিছু, আকাশসমূহের মধ্যে এবং যা কিছু জমিনের মধ্যে আছে, সবই তার মালিকানাধীন।' (সুরা নিসা : আয়াত ১৭১)
২. اَلَاۤ اِنَّهُمۡ مِّنۡ اِفۡکِهِمۡ لَیَقُوۡلُوۡنَ - وَلَدَ اللّٰهُ ۙ وَ اِنَّهُمۡ لَکٰذِبُوۡنَ
'জেনে রাখো! এরা যে বলছে আল্লাহর সন্তান আছে, এটা এদের নিজেদের মনগড়া কথা। আসলে এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা।' (সুরা আস-সাফফাত : আয়াত ১৫১–১৫২)
৩. وَ جَعَلُوۡا بَیۡنَهٗ وَ بَیۡنَ الۡجِنَّۃِ نَسَبًا ؕ وَ لَقَدۡ عَلِمَتِ الۡجِنَّۃُ اِنَّهُمۡ لَمُحۡضَرُوۡنَ
'তারা আল্লাহ ও জিনদের মধ্যে বংশীয় সম্পর্কে তৈরি করে নিয়েছে অথচ জিনেরা ভালো করেই জানে এরা (অপরাধী হিসেবে) উপস্থাপিত হবে।' (সুরা আস-সাফফাত : আয়াত ১৫৮)
৪. وَ جَعَلُوۡا لَهٗ مِنۡ عِبَادِهٖ جُزۡءًا ؕ اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَکَفُوۡرٌ مُّبِیۡنٌ
'লোকেরা তার বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে তার অংশ বনিয়ে ফেলেছে। আসলে মানুষ স্পষ্ট অকৃতজ্ঞ।' (সুরা আয-যুখরুফ : আয়াত ১৫)
৫. وَ جَعَلُوۡا لِلّٰهِ شُرَکَآءَ الۡجِنَّ وَ خَلَقَهُمۡ وَ خَرَقُوۡا لَهٗ بَنِیۡنَ وَ بَنٰتٍۭ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ؕ سُبۡحٰنَهٗ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یَصِفُوۡنَ - بَدِیۡعُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اَنّٰی یَکُوۡنُ لَهٗ وَلَدٌ وَّ لَمۡ تَکُنۡ لَّهٗ صَاحِبَۃٌ ؕ وَ خَلَقَ کُلَّ شَیۡءٍ ۚ وَ هُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ
'আর লোকেরা জিনদেরকে আল্লাহর শরীক বানিয়েছে। অথচ তিনি তাদের স্রষ্টা। আর তারা না জেনে বুঝে তার জন্য পুত্ৰ-কণ্যা বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তারা যে সমস্ত কথা বলে তা থেকে তিনি মুক্ত ও পবিত্র এবং তার ঊর্ধ্বে তিনি অবস্থান করছেন। তিনি তো আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা। তাঁর পুত্র কেমন করে হতে পারে যখন তাঁর কোন সঙ্গিনী নেই? তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন।' (সুরা আনআম : আয়াত ১০০-১০১)
৬. وَ قَالُوا اتَّخَذَ الرَّحۡمٰنُ وَلَدًا سُبۡحٰنَهٗ ؕ بَلۡ عِبَادٌ مُّکۡرَمُوۡنَ
'আর তারা বললো, দয়াময় আল্লাহ কাউকে পুত্ৰ বানিয়েছেন। তিনি পাক-পবিত্র। বরং (যাদেরকে এরা তাঁর সন্তান বলছে) তারা এমন সব বান্দা যাদেরকে মৰ্যদা দান করা হয়েছে।' (সুরা আম্বিয়া : আয়াত ২৬)
যারা আল্লাহর জন্য সন্তান গ্রহণ করার কথা বলে, এ আয়াতগুলোতে সর্বতোভাবে তাদের এহেন আকিদা-বিশ্বাসের প্রতিবাদ করা হয়েছে। এ আয়াতগুলো এবং এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্য যে সব আয়াত কোরআনের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়, সেগুলো সূরা ইখলাসের অতি চমৎকার ব্যাখ্যা। তিনিই মহান আল্লাহ যিনি এসব কিছু থেকে পবিত্র।
আল্লাহ তাআলা মুহসিন বান্দার পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তারা যা চাইবে, তা-ই পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
لَهُمۡ مَّا یَشَآءُوۡنَ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ ؕ ذٰلِکَ جَزٰٓوٴُا الۡمُحۡسِنِیۡنَ
'তাদের জন্য তাদের রবের কাছে তা-ই রয়েছে যা তারা চাইবে। এটাই মুমিনদের পুরস্কার।' (সুরা যুমার : আয়াত ৩৪)
মহান আল্লাহ তাদের পাপগুলো মাফ করে দেবেন এবং তাদের মর্যাদাও বাড়িয়ে দেবেন। কেননা, প্রত্যেক মুসলিম আল্লাহর কাছে এটাই আশা রাখে। এ ছাড়া জান্নাতে যাওয়ার পর তো প্রত্যেক বাঞ্ছিত জিনিস পাওয়া যাবে।
সুরা ফালাক্ব ও নাস : আয়াত যথাক্রমে ৫ ও ৬
এ সুরা দুটিতে আরবের জাহেলি সমাজের নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বের প্রেক্ষাপট এবং তারা আল্লাহকে একেবারে ভুলে গিয়েছিল। আল্লাহর সম্মুখে নানা প্রতিকৃতি সমাসীন করেছিল। এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতে বিশ্বনরি ইসলামের দাওয়াত শুরু করেন।
সে সময় অবিশ্বাসী কাফের সকল অপচেষ্টায় ইসলামের অগ্রযাত্রা যখন ছুটে চলছিল তখন এ সুরাদ্বয়ের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সাহায্য ও তাঁর স্মরণাপন্ন হওয়ার নির্দেশ ছিল।
সৃষ্টিকুলের যাবতীয় অনিষ্ট হতে মুক্ত হতেই বিশ্বনবি এ সুরাদ্বয় দিয়ে সাহায্য কামনা করতেন।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের এ গুরুত্বপূর্ণ সুরাগুলো বুঝে পড়ার এবং তাঁর ওপর আমল করার পাশাপাশি নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম