আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমি : একজন রাসুল প্রেমিকের বিদায়

ধর্ম ডেস্ক
ধর্ম ডেস্ক ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:২০ পিএম, ০৪ জুন ২০২০

ড. নিজামউদ্দিন জামি

১৪৪১ হিজরির ৯ শাওয়াল, ২ জুন (মঙ্গলবার) ভোরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম, শায়খুল হাদিস আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একজন প্রকৃত প্রেমিক হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত।

তিনি ১৯২৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি থানার ঐতিহাসিক জালালাবাদের বটতলা গ্রামের হাশেমি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের অসংখ্য আলেম-ওলামা তথা সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসল্লি আল্লামা হাশেমিকে   ইসলামের সুমহান খেদমতে অবদান রাখার জন্য চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।

তিনি শুধু ইলমে দ্বীন ও ইসলাম প্রচারেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং দেশের স্বাধীনতা ও মুক্ত বাংলাদেশ গঠনেও অনন্য কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে গেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মাওলানা হাশেমি এক গৌরবময় কীর্তির নাম।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে লেখক, গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধা সিরু বাঙালি বলেন-

‘বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র ইসলামি চিন্তাবিদ, যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, সোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসা ও ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় রাজাকার-আলবদরকে কমিটি গঠনে বাধা প্রধান করে সাফল্য লাভ করেছিলেন।' (বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল, ৪র্থ সংস্করণ, পৃ. ২৮৭)

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেদন- 'এ ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা রাসুল প্রেমিক শীর্ষস্থানীয় আলেমের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।'

কর্ম জীবনে তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, পটিয়া শাহচান্দ আউলিয়া কামিল মাদ্রাসা, হাটহাজারী অদুদিয়া কামিল মাদ্রাসার মুহাদ্দিস ছিলেন। নিজেও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।

জীবনে বহুবার তাঁর ওয়াজ শুনেছি। তাঁর সান্নিধ্যও পেয়েছি। রাত যত গভীর হতো হুজুরের কণ্ঠে ততই মধুময় বয়ান বের হতো, কণ্ঠ জোরালো হতো। হুজুরের কণ্ঠে ইলমে দ্বীনের বয়ান শুনতে দূরদূরান্ত থেকে আসতো অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মানুষ।

মাওলানা হাশেমি ছিলেন একজন সত্যিকারের রাসুল প্রেমিক ও আল্লাহর প্রিয় বন্ধু। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেমেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন সারাটি জীবন।

দুঃখজনক বিষয় হলো-

দেশের অনেক আলেম রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধায় চিকিৎসা সেবা পেলেও একজন আশেকে রাসুল ও দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম আল্লামা হাশেমি কোনো চিকিৎসা পায়নি। এমনকি চট্টগ্রামের কয়েকটি হাসপাতালও তাকে চিকিৎসা সেবা দিতে আগ্রহ দেখায়নি বলেও অভিযোগ উঠছে। যা ইসলাম প্রিয় সব আশেকে রাসুল, আলেম-ওলামা ও ভক্ত-অনুরাগীদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।

মনে রাখতে হবে

আল্লামা হাশেমি কোনো সাধারণ পরিবারের থেকে ওঠে আসেনি। বরং তিনি নিজে যেমন ছিলেন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের মুহাদ্দিস। আবার তার নানা ছিলেন আওলাদে রাসুল। যিনি বাগদাদ-দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শাহী জামে মসজিদের খতিব ছিলেন।

আল্লামা হাশেমির বাবাও ছিলেন অলিয়ে কামেল। তার পুরো পরিবারই আলেম-ওলামায় অলংকৃত। ইমামে আহলে সুন্নাত, আল্লাম গাজী শেরে বাংলা রহমাতুল্লাহি আলাইহির জামাতা ছিলেন আল্লামা হাশেমি।

আল্লামা হাশেমি ১৯৬৪ সালে তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করেন আহসানুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা। ১৯৮৭ সালে তিনি আধ্যাত্মিক সংগঠন ‘আঞ্জুমানে মুহিব্বানে রাসুল (স.) গাউসিয়া জিলানি কমিটি’ প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রতিবছর রবিউল আউয়াল মাসে ১২ দিনব্যাপী ঈদে মিলাদুন্নবি সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জন্য ইসলাম ও আক্বিদা শিক্ষার পথকে প্রশস্ত করেন। এ আয়োজনে দেশবরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদগণ অংশগ্রহণ করতেন। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার ‘জশনে জুলুস’-এর পর আল্লামা হাশেমির এ আয়োজনই ছিল অন্যতম সমৃদ্ধ আয়োজন।

তখনই হতাশ হয়ে পড়ি, দুঃখ পাই, যখন দেখি-

'দেশের সুন্নি সমাজের একজন নিবেদিত আলেমের চিরবিদায়ে আমরা নিরবতা পালন করি। স্মরণ করি না তাঁর রেখে যাওয়া অবদান ও কীর্তি। যাতে দরবারগুলোর ভূমিকা আশা জাগানিয়া নয়। তাহলে কি আমরা এসব আলেমদের অবদানের কথা ভুলেই গিয়েছি, নাকি স্বীকার করতে চাই না! অথচ আল্লাহ পাক ঘোষণা করছেন-

‘লা তাফাররাকু'- (তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না),

বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সুন্নিয়তের দাবিদাররা সবচেয়ে অধিক বিভক্ত! তাহলে তো আমরা কুরআনকেই অবমাননা করলাম।

মোটকথা, যতক্ষণ নিজের উপর বিপদ না আসছে, ততক্ষণ আমরা সবাই চুপচাপ দর্শক! তাহলে আম জনতার দোষ কোথায়?

চট্টগ্রামের যেসব হসপাতাল হুজুরসহ অন্যান্যের চিকিৎসা দিতে অনীহা দেখিয়েছে, তাদের তালিকা প্রকাশ করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বয়কট করার ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহবান জানাই।

পাশাপাশি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই, যারা নির্ভয়ে হুজুরকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। আমি রাজনীতি করি না। মগজের দায় থেকে এসব বলছি।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মো. ইমামুল কবীর শান্তর মৃত্যুর চতুর্থ দিন পর আল্লামা মাওলানা হাশেমি  বিদায় নিলেন। এ সংবাদ আমাকে আরো বেশি ব্যথাতুর ও শোকাহত করেছে। যেমনিভাবে শোকাহত করেছে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা তার আশেক-ভক্ত, ছাত্র-শিক্ষককে। তিনি জান্নাতে আমাদের প্রতিনিধি হয়ে থাকবেন।

মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ তিনি আল্লামা হাশেমি হুজুর ও ইমামুল কবির শান্ত স্যারকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়।

এমএমএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।