১৬ লাখের ঢাকায় এখন দুই কোটি নাগরিক

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ০৬:৩৬ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২১

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেশে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। ওই শুমারিতে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ লাখ। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে তখন এই শহরের জনসংখ্যা দুই কোটির বেশি। প্রতিদিন বাড়ছে ঢাকার জনসংখ্যা। জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজধানী ঢাকায় জনদুর্ভোগ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতি বছর ঢাকা শহরে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হয়, যা দিনে এক হাজার ৭০০। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মেগাসিটিতে রূপান্তরিত হবে। এতো মানুষের আবাসন, কর্মসংস্থান সবই হয়েছে ঢাকায়। এতে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে ঢাকা মহানগরী। এখন সরকার ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তার সুফল পাচ্ছে না জনগণ। উল্টো নগরে যানজট, বায়ুদূষণ, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সমস্যা বেড়েই চলছে।

jagonews24

নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, ছোট্ট এ ঢাকায় মানুষ এভাবে আসতে থাকলে এই শহরের সমস্যা কখনোই সমাধান হবে না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমস্যার পরিমাণও বাড়বে। এখন ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য বিভাগীয় এবং জেলা শহরগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি বিচার বিভাগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিংসেবাসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সেবাব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা সমাধান করতে হবে। বিভিন্ন আঞ্চলিক শহরে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে। যাতে ঢাকার বাইরে অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসার প্রয়োজন বোধ না করেন।

বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭৫টি ওয়ার্ড এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫৪টি ওয়ার্ড নিয়ে রাজধানীর সীমানা। এর মধ্যে ডিএসসিসির আয়তন ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গকিলোমিটার। ডিএসসিসির তথ্য মতে, এখন ডিএসসিসিতে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষের বাস। অন্যদিকে ডিএনসিসির আয়তন ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার। এখানে প্রায় ৮০ লাখ মানুষের বাস।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ১১তম। কিন্তু আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। এই জনঘনত্ব অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক। পৃথিবীর আর কোনো অংশের জনপদের মানুষ কখনো এত ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে বসবাস করেনি। এ সমস্যা থেকে বাঁচতে যত দ্রুত সম্ভব বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়ন করতে হবে।

jagonews24

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রস্তাবিত ড্যাপে জনসংখ্যা ও চাহিদার বিশ্লেষণে বিস্তর তথ্য রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, শহর নিয়ে পরিকল্পনার মূল উপজীব্য হচ্ছে শহরের মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা শহর নিয়ে পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এই শহরে কত মানুষ হবে, তাদের চাহিদা কেমন হবে, সেসব বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে।

নতুন ড্যাপ প্রণয়নের কাজ চলছে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের কথা মাথায় রেখে (প্রথম খণ্ড, অনুচ্ছেদ ১.২.৩)। এ সংক্রান্ত আরও তথ্যের বিশদ উপস্থাপন হয়েছে খসড়া প্রতিবেদনের দ্বিতীয় খণ্ডের ১.২ অনুচ্ছেদে। উপ-অঞ্চলভিত্তিক বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য (প্রক্ষেপিত) জনসংখ্যা, চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন নাগরিক সুবিধার তালিকাও খসড়া প্রতিবেদনের দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তারিতভাবে আছে।

এ ছাড়া একটি এলাকায় কত মানুষ থাকবে, ওই সব মানুষের নাগরিক সেবার মান কেমন হবে- পরিকল্পনায় সে বিষয়ে আলোকপাত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রতিটি এলাকারই একটি নিজস্ব ধারণক্ষমতা থাকে। ধারণক্ষমতা অতিক্রম করলে তার চাপ সব ধরনের সেবার ওপরই পড়ে।

jagonews24

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়। সে আলোকেই ড্যাপে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এসেছে। যথাযথভাবে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) ও এমজিসি মেনেও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

কিন্তু বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় ‘এফএআর’র মান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এর মান বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় জনসংখ্যার চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

ডিএসসিসির নগর পরিকল্পনা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ঢাকা শহরে যতটুকু জলাভূমি ছিল, তা গত ৫০ বছরে ৮৫ শতাংশ হারিয়ে গেছে। এসব জলাভূমি ভরাট করে বাড়িঘর স্থাপন করা হয়েছে। যে কারণে ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা রয়েছে। সরু রাস্তায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এখন ড্যাপ বাস্তবায়ন হলে ঢাকায় জনঘনত্ব কমবে। অন্যথায় কোনো সুযোগ নেই।’

jagonews24

জানতে চাইলে স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পরের ঢাকা আর আজকের ঢাকা এক নয়। স্বাধীনতার পর ঢাকার জনসংখ্যা যেমন কম ছিল, সমস্যার পরিমাণ ছিল কম। এখন জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা পাহাড় পরিমাণ বেড়েছে। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এ সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে না।’

তিনি বলেন, ‘১৯৯৭ সালে ঢাকাকে বিস্মৃত করতে পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। কিন্তু নানা কারণে আজও সেই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। এখন ঢাকার সঙ্গে আশপাশের জেলার সংযোগ সড়ক উন্নয়ন করতে হবে। এছাড়া যত দ্রুত সম্ভব বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়ন করতে হবে।’

এমএমএ/ইএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।