একান্ত সাক্ষাৎকারে এলিটা কিংসলে
‘আমার কাজ খেলে যাওয়া, দলে নেওয়া না নেওয়া কোচের বিষয়’
২১ ফুটবলার নিয়ে শনিবার দুপুরে স্প্যানিশ কোচ হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরা যখন কম্বোডিয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছেন তখন এলিটা কিংসলে তার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসায় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য জাতীয় দলে ডাক পাননি বলে রোববারই তিনি যোগ দেবেন আবাহনীর ক্যাম্পে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য শনিবারটি তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এলিটা কিংসলেকে জাতীয় দলে ডাক না দেওয়ায় হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরার দিকে ছুটছে সমালোচনার তীর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই চামড়া ছিঁড়ছেন স্প্যানিশ কোচের। কারণ, এলিটা কিংসলে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বাধিক গোলদাতা হয়েও জাতীয় দলে সুযোগ পাননি। অথচ তার পরিবর্তে যাদের নেওয়া হয়েছে তাদের কোনো গোলই নেই।
বাংলাদেশের জার্সিতে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার স্বপ্ন নিয়েই নাইজেরিয়ার নাগরিকত্ব ছেড়ে বাংলাদেশি হয়েছেন কিংসলে। তারপর দীর্ঘদিন অপেক্ষায় ছিলেন লাল-সবুজ জার্সির জন্য। গত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ক্যাম্পে ডাক পেয়েও চূড়ান্ত দলে জায়গা পাননি। গত মার্চে সিলেটে সিশেলসের কিপক্ষে তার অভিষেক হয়েছে জাতীয় দলে। তারপর থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখে আসছিলেন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার। সে স্বপ্নের কথা তিনি প্রকাশও করেছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে। কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবেছেন তার। আবারও হয়েছে স্বপ্নভঙ্গ।
সাফের দলে ডাক না পাওয়ায় মনের অবস্থা কি কিংসলের? জানতে শনিবার দুপুরে তার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ১৯ নম্বর রোডের বাসায় যাওয়া। একজন পেশাদার ফুটবলার হিসেবে কোচের সিদ্ধান্তকে তিনি সম্মান জানিয়েছেন এবং আগামীতে জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে সর্বোচ্চ পরিশ্রমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দীর্ঘ সময় কিংসলের সঙ্গে আলাপচারিতার কিছু অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
জাগো নিউজ: সবার ধারণা ছিল জাতীয় দলের হয়ে আপনি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলবেন। আবাসিক ক্যাম্পে ডাক পেয়েও ২৩ জনের দলে জায়গা পাননি। আপনার অনুভূতি কি?
এলিটা কিংসলে: আমার অনুভূতি ভালো। কারণ, এটা ফুটবলের অংশ। একজন ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে এটা আমার ক্যারিয়ারেরও অংশ।
জাগো নিউজ: আপনার তো অনেক বড় স্বপ্ন ছিল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলবেন। গত মার্চে সিশেলসের বিপক্ষে অভিষেক হওয়ার পর এ স্বপ্নের কথা বলেছিলেন।
এলিটা: হ্যাঁ, সাফে খেলা আমার স্বপ্ন ছিল। দলকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মাঠে আমি থাকছি না। এটা অবশ্যই আমরা জন্য দুঃসংবাদ। তবে কোচের সিদ্ধান্তকে আমার সম্মান করতেই হবে। আমি কোচের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণভাবে সম্মান করছি। আমি এ নিয়ে কোচ বা ম্যানেজমেন্টের কাছে প্রশ্ন তুলতে পারি না, কেন আমাকে রাখা হয়নি।
জাগো নিউজ: সিশেলসের বিপক্ষে অভিষেক হওয়ার পর থেকেই তো নিজেকে সাফের জন্য প্রস্তুত করছিলেন। ভালো ফুটবল খেলার জন্য নিজেকে তৈরি করেছিলেন। এক কথায় আপনি সাফ খেলার জন্য রেডি ছিলেন। দুর্ভাগ্য দলে জায়গা পাননি।
এলিটা: আসলে আমি একা নই। প্রত্যেক খেলোয়াড়ই সাফের জন্য নিজেকে তৈরি করেছিল। আমি নিশ্চিত ৩৫ জন ফুটবলাই ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিল। ওই তালিকা থেকে অনেককেই বাদ পড়তে হয়েছে। সেই তালিকায় আমিও আছি। এটা সম্পূর্ণই কোচের সিদ্ধান্ত। ২৩ জনের চূড়ান্ত দল তৈরির কাজটি করা কোচের জন্য সহজ ছিল না। তাই আমি আবারো বলছি, কোচের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। তাই আমি খারাপ কিছু অনুভব করছি না। যে ২৩ জন দেশের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছেন তাদের আমি শুভকামনা জানাই।
জাগো নিউজ: আপনি লিগে স্থানীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বাধিক গোলদাতা। অথচ আপনাকে দলে নেওয়া হয়নি। আপনি কি মনে করেন, আপনার ওপর কোনো অবিচার করা হয়েছে?
এলিটা: না। আমি মনে করি না যে, আমার ওপর কোনো অবিচার করা হয়েছে। আমি মনে করি, কোচকে ২৩ জন খেলোয়াড় নির্বাচন করতে হতো, তিনি ২৩ জন নির্বাচন করেছেন। যাদের যোগ্য মনে করেছেন, নিয়েছেন। এখানে আমার ওপর কোনো অবিচার করা হয়েছে বলে মনে করি না। আমি কোচের সিদ্ধান্তকে ভালোভাবেই নিয়েছি। কারণ, আমাকে তার সিদ্ধান্তই মানতে হবে। কারণ, আমি কোচ নই। আমি জানি, জাতীয় দলের কোচ হিসেবে ২৩ জন চূড়ান্ত করা কতটা কঠিন কাজ। তাই আমি কোচের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই।
জাগো নিউজ: আপনি জানেন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট। আপনি দলে নেই। সাফ নিয়ে কী ভাবছেন?
এলিটা: ওরা যদি সাফ জিততে পারে সেটা বাংলাদেশের অর্জন হবে। বাংলাদেশের সবাই খুশি হবেন। আমি ওখানে (দলের সঙ্গে) থাকছি না। তবে আমার মন সবসময় দলের সঙ্গে থাকবে। আমার প্রার্থনা থাকবে তাদের জন্য। আমি সবার সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সাহস দিয়েছি। সবার প্রতি আমার শুভকামনা থাকলো।
জাগো নিউজ : গতকাল (শুক্রবার) যখন হোটেল ছেড়ে বাসায় ফিরলেন তখন কেমন অনুভূতি ছিল আপনার?
এলিটা: আমি বাসায় ফেরার আগে দারুণ কিছু মুহূর্ত কাটিয়েছি সবার সঙ্গে। ফেরার সময় আমি প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেছি, হাত মিলিয়েছি। আমরা একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়েছি।
জাগো নিউজ: ক্যাম্পের সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
এলিটা: অবশ্যই ভালো। আমি ফেরার সময় তপু বর্মন, জামাল ভূঁইয়া ও তারিক কাজির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছি। আমরা সব সময় এক সাথে সকালের নাস্তা এবং দুপুর ও রাতের খাবার খেতাম। তাদের সঙ্গে কথা বলার পর সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে দেখা করেছি। তখন তারা আমাকে ফেয়ারওয়েল দিয়েছে। এটা আমার জন্য দারুণ মুহূর্ত ছিল।
জাগো নিউজ: আপনি কি নিজেকে সম্পূর্ণ ফিট করে করছেন? নাকি কোনো ইনজুরি আছে?
এলিটা: এটা বলতে পারি, আমি ওকে। ফিজিক্যালি খুব ভালো আছি। আমার কোনো ইনজুরি নেই। এক কথায় আমি সম্পূর্ণভাবেই ভালো আছি।
জাগো নিউজ: আপনার সাফ নিয়ে একটা ভাবনা ছিল। সে ভাবনাটা কিভাবে সাজিয়েছিলেন?
এলিটা: আমি মানসিকভাবে খুবই প্রস্তুত ছিলাম। আমাদের প্রথম লক্ষ্য গ্রুপপর্ব টপকানো। তারপর সেমিফাইনাল জিতে ফাইনালে ওঠা। এটা আমার লক্ষ্য ছিল। আমি জানি দলের সবারই একই লক্ষ্য।
জাগো নিউজ: ব্যক্তিগতভাবে মাঠে পারফরর্ম করতে কি পরিকল্পনা ছিল আপনার?
এলিটা: আমি জানতাম কি করতে হবে। আমার গোল করাই ছিল প্রথম প্লান। আমি ভেবে রেখেছিলাম, সাফে যাব এবং আমি নিজের খেলাটা খেলে সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোল করার চেষ্টা করবো। আমার মাথায় এসবই ছিল।
জাগো নিউজ: আপনি কি মনে করেন সাফে ব্যক্তিগতভাবে দেশের জন্য ভালো কিছু করার সুযোগ ছিল?
এলিটা: অবশ্যই। একজন স্ট্রাইকারের সব সময় একটা লক্ষ্য থাকতে হবে, স্বপ্ন থাকতে হবে। সেটা গোল করা। কারণ, গোল করার ক্ষেত্রে স্টাইকার দলের এক নম্বর খেলোয়াড়। সবার নজর কিন্তু থাকে স্ট্রাইকারের দিকেই।
জাগো নিউজ: এখন তো আপনি নেই। দলে যারা স্ট্রাইকার আছেন তারা কেমন করবেন বলে আপনি মনে করেন?
এলিটা: সুমন রেজা আছে, সজীব আছে। আমি বিশ্বাস করি, তারা দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারবেন। আমি তাদের চিনি। তারা সুযোগ পেলে দেশের জন্য কিছু করতে পারবেন।
জাগো নিউজ: আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের যে দলটি হয়েছে সেখানে কোন বিভাগের শক্তি কেমন?
এলিটা: দলের রক্ষণভাগ মজবুত। মধ্যমাঠও ভালো আছে। এক কথায় বলবো অনেক অভিজ্ঞ মধ্যমাঠ। আক্রমনভাগও ভালো। কারণ, সুমন ও সজীব আছে। স্কোয়াডই খুবই ভালো। একটা ব্যালান্সড দল।
জাগো নিউজ: এখন আপনি সময় কিভাবে কাটাবেন?
এলিটা: আমার কোনো সময় নেই। কারণ, আগামীকালই আমাকে ক্লাবে যোগ দিতে হবে। তাই মাত্র একদিনের বিশ্রাম। কোনো সময় নেই।
জাগো নিউজ: জাতীয় দলে আবার ফিরতে আপনার এখন পরিকল্পনা কি?
এলিটা: আমার একটাই লক্ষ্য খেলে যাওয়া। খেলাটা চালিয়ে যাওয়া। যেটা আমার কাজ। আমি বিশ্বাস করি, যদি খেলা চালিয়ে যাই এবং মাঠে ভালো করি, তাহলে যে কোনো সময়ই জাতীয় দলে আবার ডাক পাবো। আমার কাজ খেলে যাওয়া, দলে নেওয়ার বিষয়টি কোচের।
জাগো নিউজ: আর কতদিন ফুটবল খেলতে পারবেন বলে আপনি মনে করে?
এলিটা: খুব বেশি লম্বা সময় নয়। কারণ, একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের ধারণা থাকতে হবে কখন খেলা শুরু করবেন এবং কখন শেষ করবেন। আমি খেলে যাবো। দেখি কি হয়।
জাগো নিউজ: খেলোয়াড়ী জীবন শেষ ফুটবল নিয়ে কি পরিকল্পনা আছে আপনার? ব্যবসা নাকি কোচিং?
এলিটা: পরিকল্পনা আছে। তবে তা এখন প্রকাশ করবো না। এটা গোপনীয়।
জাগো নিউজ: আপনি বাংলাদেশি বিয়ে করেছেন। আমাদের কালচার অনুযায়ী আপনি অনেকের দুলাভাই। কেউ আপনাকে দুলাভাই বলে ডাকেন?
এলিটা: অনেকেই ডাকেন দুলাভাই বলে। কেউ কেউ আমাকে জামাই বলেও ডাকেন। আমি এসব উপভোগ করি। স্ত্রীর ভাইকে শালা বলে সেটাও আমি জানি।
জাগো নিউজ: ঘরোয়া ফুটবল নিয়ে জানতে চাই। আগামী মৌসুম নিয়ে পরিকল্পনা কি? আবাহনীতে থাকছেন? নাকি অন্য কোথাও যাচ্ছেন?
এলিটা: আগামী মৌসুম নিয়ে আমি এখনই কিছু বলতে পারবো না। কারণ, আমি এখনো আবাহনীর খেলোয়াড়। তাই এখনই কিছু বলতে পারছি না। বলা ঠিকও হবে না।
জাগো নিউজ: আপনি ১২ ম্যাচ খেলে লিগে ৯ গোল করেছেন। এই গোলে আপনি সন্তুষ্ট কিনা?
এলিটা: না। আমি অবশ্যই সন্তুষ্ট না। আবাহনী বাংলাদেশের অন্যতম বড় ক্লাব। তাদের লক্ষ্যও অনেক উঁচুতে। আবাহনীকে খেলা চ্যালেঞ্জের। সে চ্যালেঞ্জ আমি উপভোগ করি। তবে এটা বলবো ৯ গোল আমার জন্য যথেষ্ট নয়।
জাগো নিউজ: বৃহস্পতিবার আপনি ভারতের ভিসা পেয়েছেন। সাফ দেখতে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
এলিটা: যদি বাংলাদেশ ফাইনালে উঠতে পারে তাহলে আমি বেঙ্গালুরু যাব দেখতে।
জাগো নিউজ: ধন্যবাদ।
এলিটা: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরআই/আইএইচএস/