অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস

সংস্কার কাজে পিছিয়ে ক্রীড়াঙ্গন

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ১২:২১ পিএম, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠন হওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৬ মাস পূর্ণ হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। মানুষের প্রত্যাশা ছিল ক্রীড়াঙ্গন দলীয়করণমুক্ত হবে, প্রকৃত ক্রীড়া সংগঠকের জায়গা হবে ফেডারেশন, অ্যাসোসিয়েশন ও সংস্থাগুলোতে। ক্রীড়াঙ্গনের মানুষের সেই প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির কতটুকু মিলন ঘটেছে এই ৬ মাসে?

মোটা দাগেই বলে দেওয়া যায়, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ড. ইউনূসের সরকার যে কার্যক্রমগুলো হাতে নিয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানোর জন্য যে কমিশন গঠন করেছে, সেগুলো কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কমিশন তাদের প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। সেই দিক দিয়ে ক্রীড়াঙ্গন অনেক পিছিয়ে।

ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কার কাজ চলছে ঢিমেতালে। ৮ আগস্ট ২০২৪ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত কী পেলো ক্রীড়াঙ্গন, সেগুলো বিশ্লেষণ করতেই এই প্রতিবেদন।

ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই কয়েকটি সাফল্য আসে ক্রীড়াঙ্গনে। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাসেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পাকিস্তান সফর করে এবং রাওয়ালপিন্ডিতে হওয়া দুই টেস্টে স্বাগতিকদের বিধ্বস্ত করে (২-০ ব্যবধানে) প্রথম ঐতিহাসিক সিরিজ জেতে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরুতেই পায় ঐতিহাসিক এক সফলতা।

ক্রিকেট মাঠে জাতীয় দলের এই ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের মাসেই নেপাল থেকে সুখবর দিয়েছিল অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবল দল। নেপালের কাঠমান্ডুতে হওয়া যুবাদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ প্রথমবার উড়িয়েছিল বিজয়ের পতাকা। এই ৬ মাসে আরও দুটি সফলতা যোগ হয়েছে ক্রীড়াঙ্গনে।

জাতীয় নারী ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। যুব হকি দল প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ওমানে হওয়া একই টুর্নামেন্টে মেয়েরা অংশ নিয়ে ভালো কিছু করতে না পারলেও প্রথম অংশ নেওয়া ছিল মেয়েরে হকিতে একটা মাইলফলক।

মাঠের এই সাফল্য-ব্যর্থতা ছিল ধারাবাহিকতার অংশ। মানুষের বেশি নজর ছিল ক্রীড়াঙ্গন সচল রাখার দিকে। দীর্ঘ একটা সময় ক্রীড়াঙ্গন ছিল আওয়ামী লীগ ঘেঁষা সংগঠকদের দখলে। যে যেভাবে পেরেছেন ক্রীড়াঙ্গন দখল করে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। এই অবস্থা থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে বের করে মাঠের খেলা দ্রুত সচল করবে ক্রীড়া প্রশাসন, সেই প্রত্যাশা ছিল সবার। এই জায়গায় ক্রীড়ামোদীদের প্রত্যাশার সাথে মিলের বেশ দূরত্ব রয়েছে।

ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দায়িত্ব নেওয়ার ১০ দিন পর (১৮ আগস্ট ২০২৪) প্রথম গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে। ওই দিন তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, দেশে প্রথমবারের মতো স্পোর্টস ইনস্টিটিউট তৈরির। সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের উদ্যোগ সেভাবে চোখে পড়েনি কারো। আরেকটি ঘোষণা দিয়েছেন ক্রীড়া সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময় (২ সেপ্টেম্বর ২০২৪) অনুষ্ঠানে। সে দিন বলেছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের সিন্ডিকেট ভেঙে দেবেন।

সেই সিন্ডিকেট ভাঙার কাজ আগায়নি বললেই চলে। ক্রীড়াঙ্গনে সিন্ডিকেট বলতে বিভিন্ন ফেডারেশন, অ্যাসোসিয়েশন, সংস্থা ও সরকারী প্রতিষ্ঠানে সুবিধাবাদীদের দখলারিত্ব। বাস্তবে সিন্ডিকেট ভাঙার কাজটি সেভাবে হয়নি। সবার চোখ ছিল ফেডারেশনগুলোর দিকে। অযোগ্য ও দলীয় লোকদের সরিয়ে কবে প্রকৃত ক্রীড়া সংগঠকদের দিয়ে ফেডারশনগুলো নতুন করে গঠন হবে সেই আশায় বসে সবাই। কার্যত এখানেই সবাই হতাশ।

দেশে ৫৫ টি ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন আছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ মাত্র ১৬টি ফেডারেশনের পুরোনো কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন অ্যাডহক কমিটি ঘোষণা করতে পেরেছে।

ক্রীড়াঙ্গন সংস্কারের জন্য ২৯ আগস্ট ২০২৪ একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছিল সরকার। শুরু থেকেই সেই কমিটি নিয়ে ছিল বিতর্ক। বিতর্কের মুখে ১ অক্টোবর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় একজন সদস্যকে বাদ দিয়ে নতুন একজনকে অন্তর্ভূক্ত করেছে।

মূলত, এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন পুনর্গঠন করছে। তবে এই কাজের গতি খুবই হতাশাজনক।

সার্চ কমিটি গঠনের পর ৫ মাসের বেশি সময় কেটে গেছে। এর মধ্যে ১৪ নভেম্বর ৯টি এবং তার আড়াই মাস পর ২৮ জানুয়ারি ৭টি ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিঠি ঘোষণা করেছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এই সময়ের মধ্যে হয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচন। সভাপতিসহ কয়েকটি শূন্যপদ পূরণ হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনেও নতুন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন এই সময়ে।

ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটি গঠন করতে গিয়ে সার্চ কমিটি ভুগছে সভাপতি সংকটে। ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে ৪২টি ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিকে অব্যাহতি দিয়েছিল। তার আগে ২১ আগস্ট দেশের সব বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটি ভেঙে দেয় সরকার। ভাঙার কাজটি যত দ্রুত করেছে ক্রীড়া প্রশাসন, গড়ার কাজ সেভাবে করতে পারেনি বলেই দেশের অন্যসব সেক্টরের তুলনায় স্থবির হয়ে আছে ক্রীড়াঙ্গন।

প্রায় ৬ মাস হতে চললো এই সংস্থাগুলোর কমিটি বিলুপ্ত করেছে সরকার। এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র একটি বিভাগীয় ও ১৭টি জেলা ক্রীড়া সংস্থার নতুন কমিটি অনুমোন দিয়েছে সরকার। এখনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি উপজেলা ও বিভিন্ন মহিলা ক্রীড়া সংস্থা গঠনের।

৬ মাসে হওয়া ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কার নিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) সচিব মো. আমিনুল ইসলাম জাগোনিউজকে বলেন, ‘আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। তবে যে ফেডারেশন, অ্যাসোসিয়েশন ও সংস্থা গঠন হয়েছে সেই সংখ্যাটা কম। আরো বেশি হলে ভালো হতো।’

এই ৬ মাসে ক্রীড়াঙ্গনের কোন বিষয়টির অগ্রগতিতে আপনার সন্তুষ্টি আছে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘দেশের ৭১ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আড়াইশ’র বেশি সংস্থা আছে। সেগুলোর মধ্যে কিছু আছে যেখানে শতভাগ কাজ ডিজিটালমুখী হয়েছে। তার মধ্যে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদও আছে। গত ৩ নভেম্বর থেকে আমরা শতভাগ ডিজিটালমুখী হয়েছি। বড় কথা হলো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে ক্রীড়াঙ্গনকে গতিশীল করা। সেই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমরা বেশ সাফল্য দেখিয়েছি।’

কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনের আসল তো মাঠের খেলা। সেই জায়গায় তো স্থবিরতা কাটেনি। এ বিষয়ে কী বলবেন?

মো. আমিনুল ইসলামের জবাব, ‘দেখেন ফেডারেশনগুলো হলো ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণ। যতটা সংস্কার হওয়ার কথা ছিল এই সময়ে সার্বিক প্রেক্ষাপটে সেটি হয়নি। এ জন্য আমি ফেডারেশনগুলোকে দায়ী করছি না। আমরা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের নির্দেশে তারুণ্যের উৎসব পালন করছি। ক্রীড়াঙ্গনে যে স্থবিরতা ছিল এই উৎসবের মাধ্যমে কেটেছে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে ক্রীড়াঙ্গন জেগে উঠেছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক।’

এই তারুণ্যের উৎসব নিয়ে অনেক ফেডারেশন-অ্যাসোসিয়েশনের চাপা ক্ষোভ আছে। অনেকে মনে করছেন, এটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই উৎসবের জন্য কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব বলেন, ‘এটা চাপিয়ে দেওয়ার কিছু না। বিষয়টি আসলে দৃষ্টিভঙ্গির। ফেডারেশনগুলোর নিয়মিত কার্যক্রম থাকেই। সেই কার্যক্রমকে একটা উৎসবের মধ্যে নিয়ে করা হচ্ছে।’

তারুণ্যের উৎসব পালনের সরকারী নির্দেশনা থাকলেও উপেক্ষাও করা হয়েছে। কেন সব ফেডারেশন-অ্যাসোসিয়েশন এই কার্যক্রমে অংশ নেয়নি? ‘৫৫ ফেডারেশনের ৪৩টি এই কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। ১২টি কোনো পরিকল্পনাই প্রেরণ করেনি। সেগুলো নির্দেশনা উপেক্ষা করেছে। তাই আমরা তাদের বরাদ্দ ছাড় দেওয়া স্থগিত করছি। উপদেষ্টা মহোদয়ের নির্দেশনা এটা। কারণ, সবারই জবাবদিহিতার মধ্যে থাকা উচিত। আমাকেও তো কাজের জবাবদিহিতা করতে হয়। এটা বিশ্বজুড়ে নিয়ম। কোনো ফেডারেশন কর্মসূচি পালন করতে না পারলে তাদের কাছ থেকে একটা কারণ তো আমাদের জানতে হবে। যেকোনো একটা কর্মসূচি পালন করে এই উৎসবের অংশ হওয়া যেতো। কিন্তু তারা কোনো সাড়াই দেয়নি। তাই শাস্তি তারা পাবে’- বলেছেন মো. আমিনুল ইসলাম।

এ পর্যন্ত মাত্র ১৬টি ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি ঘোষণা করেছেন। সহসা কোনো ফেডারেশনের কমিটি পাওয়া যাবে? জবাবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব বলেন, ‘এখন আমার হাতে কোনো কমিটি পেন্ডিং নেই। আমার কাছে আসলেই আমি দ্রুত তা ছেড়ে দেই।’

ক্রীড়া উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অবস্থিত দোকান পরিদর্শন করে বলেছিলেন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্থাপনায় থাকা দোকানগুলো ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিযোগ আছে। সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি আছে?

জবাবে মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আছে। উপদেষ্টার নির্দেশনার পর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল। সেই কমিটি একটা প্রতিবেদনও দিয়েছিল সুপারিশ আকারে। সেই সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য জাতীয ক্রীড়া পরিষদ থেকে ৭টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলো কাজ করছে।’

আরআই/এমএইচ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।