‘সেজন্যই বাংলাদেশের প্রথম হাফ সেঞ্চুরিয়ান আমি!’


প্রকাশিত: ১০:০৯ এএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কথায় বলে, বিধাতা এক হাতে কেড়ে নিলেও আরেক হাত দিয়ে দেয়। অনেকটা এমনই হয়েছে বাংলাদেশ দলের সাবেক ওপেনার আজহার হোসেন সান্টুর সঙ্গে। প্রায় দেড় যুগ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলার পর বেশ কয়েকটি হাফ সেঞ্চুরি থাকলেও নামের পাশে নেই কোনো সেঞ্চুরি। তবে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে কলাবাগানের বিপক্ষে একবার সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন। কিন্তু দিনটি ছিল ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর, তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। গণঅভ্যুত্থানে সেদিনই মারা যান বিএমএ মহাসচিব ডা. মিলন। খেলাটি ছিল ৭৫ ওভারের। ডা. মিলন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর সেই ম্যাচটি পণ্ড হয়ে গেলে সেঞ্চুরি হাতছাড়া হয় সান্টুর। শেষ পর্যন্ত ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে আর সেঞ্চুরি করা হয়নি তার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেঞ্চুরিবিহীন থেকে যায় তার ক্যারিয়ার। কিছুটা আফসোস থাকলেও সান্টু এটাকে দেখছেন ভিন্নভাবে। সেদিনের সেই সেঞ্চুরিটি করেও স্বীকৃতি পাননি। আর তাই বিধাতা তাকে দেশের হয়ে প্রথম হাফ সেঞ্চুরির করার সুযোগ করে দিয়েছেন। মাস্টার্স ক্রিকেট কার্নিভাল টুর্নামেন্টে কক্সবাজারে এসেছেন তিনি। সেখানেই জাগো নিউজের ক্রীড়া প্রতিবেদক রামিন তালুকদারের মুখোমুখি হন তিনি। পুরোনো স্মৃতির পাশাপাশি বর্তমান সময়ের ক্রিকেট নিয়ে উঠে আসলো নানা আলোচনা। তারই চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য।

কেমন আছেন?

আজহার হোসেন সান্টু : এই তো, আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো।

আপনারা একসময় সবাই যারা খেলতেন, অনেক দিন পর আবার একত্রে হলেন। কেমন লাগছে?

আজহার হোসেন সান্টু : এক্সাইটেড, সবাই খুব এক্সাইটেড। খুবই ভালো লাগছে। অবিশ্বাস্য পরিবেশ, যারা এ প্রোগ্রামটা করেছে তারা পুরোপুরি সফল। খুবই ভালো একটা পুনর্মিলনী।

খেলা ছেড়েছেন অনেক আগেই। এখন কি খেলা দেখেন বাংলাদেশের?

আজহার হোসেন সান্টু : হ্যাঁ, দেখি। তবে ব্যস্ততায় কখনো দেখতে না পারলে খোঁজ নেই। এখন তো বাংলাদেশ অনেক ভালো খেলছে।

আপনি একসময় জাতীয় দলে খেলেছেন। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম দিকে। এখন বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। কি পরিবর্তন দেখছেন দলে?

আজহার হোসেন সান্টু : পার্থক্যটা খুব বেশি না। যুগোপযোগী বলতে পারেন। তখনকার সময় যে চাহিদা ছিল, আমরা সে চাহিদাই ক্রিকেট খেলেছি। চাহিদা পরিবর্তন হয় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে, এখনকার যুগের যে চাহিদা বাংলাদেশ এখন সেভাবেই ক্রিকেট খেলছে। যদি এর গভীরে যান, তাহলে দেখবেন তেমন পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু একটা জায়গায় আছে, বর্তমান সময়ের খেলোয়াড় অনেক বেশি শিক্ষিত। শিক্ষিত বলতে আমি পড়াশুনার কথা বলছি না। ক্রিকেটের ব্যাপারে শিক্ষিত। ক্রিকেট নিয়ে ওরা এখন অনেক পড়াশুনা করে। ওরা এখন অনেক বেশি স্মার্ট, অনেক বেশি পেশাদার, আমরা এতোটা ছিলাম না।

যখন আপনি খেলতেন তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য খেলতেন আর এখন বাংলাদেশ খেলে জয়ের লক্ষ্যে। এ দলটা অনেক অ্যাগ্রিসিভ। আপনি এখন খেললে কেমন করতেন বলে মনে হয়?

আজহার হোসেন সান্টু : ওই যে বললাম সময়ের চাহিদা। আমাদের সময়ে যেমন হওয়ার কথা ছিল আমরা ঠিক তেমনই করেছি। এখন ওরা বর্তমান সময়ে যা চায় তা-ই করছে। এখন ওরা ভালো সুযোগ পাচ্ছে, ভালো সুবিধা পাচ্ছে। তাই ওরা আরও ভালো খেলার চেষ্টা করছে, আরও পেশাদারভাবে খেলার চেষ্টা করছে। আমাদের সময় এসব একটু কম ছিল বলেই একটু পার্থক্য ছিলাম। যেহেতু ব্যাপারটা যুগোপযোগী, আমরা এখন ক্রিকেট খেললে... আগে যেহেতু ভালো খেলেছি এখনও ভালো খেলতাম। আমরা ন্যাচারাল ক্রিকেটার। আগে যেহেতু ভালো খেলেছি এখনও ভালো খেলতাম।

santu

আপনি বাংলাদেশের প্রথম হাফ-সেঞ্চিরিয়ান। কিন্তু আপনার ঢাকা লিগে কোনো সেঞ্চুরি নেই। একটি সেঞ্চুরি করেছিলেন সেটা ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে ডা. মিলন যেদিন মারা যায় সেদিন একটি সেঞ্চুরি করেছিলেন। কিন্তু সে ম্যাচটি পণ্ড হয়ে যাওয়ায় তা আপনার নামের পাশে নেওয়া হয়নি। এটা নিয়ে আফসোস হয়?

আজহার হোসেন সান্টু : ঢাকা লিগে আমার প্রচুর ৭০/৮০ এর ঘরে রান আছে। হাফ সেঞ্চুরিও করেছি অনেক। কিন্তু কেন জানি ১০০টা হচ্ছিল না। সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) আমি প্রথম সেঞ্চুরিটা করলাম, আর সেদিন রাত্রেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি পল্টে গিয়েছিল। যেকারণে ওই খেলাটাই পরে পণ্ড হয়ে যায়। সেজন্যই বাংলাদেশের প্রথম হাফ সেঞ্চুরিয়ান আমি! বিধাতা আমাকে দিয়েছিল। আমি ফিফটি মার্কের খেলোয়াড় ছিলাম। তবে সেদিনই সেঞ্চুরিটা করেছিলাম।

হাফ সেঞ্চুরি পেতেন সেটা প্রায় ৭০/৮০ পর্যন্ত যেত, কিন্তু সেঞ্চুরি কেন পেতেন না?

আজহার হোসেন সান্টু : আমার পায়ে একটা ছোট্ট প্রবলেম ছিল, এটা রকিবুল হাসান ভালো বলতে পারবে। একটা বড় ইনিংস খেলার পথে আমার প্রায়ই কাফ মাসেলটা ক্রাম্প করত। আর তখন তো এতো আধুনিক সুবিধা ছিল না। দেখা যায় এর কারণে বা কোনোভাবে আমি আউট হয়ে যেতাম।

এরপর কোনো সেঞ্চুরি করেছিলেন?

আজহার হোসেন সান্টু : এরপর আর ঢাকা লিগে সেঞ্চুরি হয়নি তবে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে পেয়েছিলাম।

আপনি একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি দারুণ একজন অফস্পিনার ছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশ দলে সেভাবে কোনো অফস্পিনার নেই। সোহাগ গাজী ছিল কিন্তু চাকিংয়ের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আর নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি। অফস্পিনারের এ সংকটের কারণ কি?

আজহার হোসেন সান্টু : আমাদের সময় অফস্পিনারদের এই দুসরা যাকে সেটা ছিল না। তেমনভাবে ছিল না। এখন যেমন অ্যাকশন করে দুসরাটা করা হয়। আমাদের সময় সিম ব্যবহার করে দুসরা ঠিক না তবে এমন কিছু করতাম। অনেকটা স্ট্রেটার বলটা হতো, কিছুটা আউটসুইংয়ের মতো হতো। এখন যেমন দুসরা টার্ন করে উল্টা দিকে আমাদের সময় এটা ছিল না। অফস্পিনারের বেসিক হলো ডান হাতি ব্যাটসম্যানের অফস্ট্যাম্পে বলটা পড়বে কিংবা অফস্ট্যাম্পের বাইরে পরে ভিতরের দিকে ঢুকবে, লেগস্ট্যাম্পের দিকে যাবে। এখন যারা তরুণ অফস্পিনার আছে ওরা প্রথমেই দুসরা শিখতে চায়। দুসরাটা হলো লেগস্ট্যাম্প থেকে অফস্ট্যাম্পের দিকে যাবে বা এর বাইরে যাবে। আর যখনই দুসরাটা করতে যায় তখনই ইনটার্নের বদলে আউট টার্ন করতে করতে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে চাকার হয়ে যায়। জয়ের জন্য এখন অফস্পিনার হয় না। আমার ধারণা দুসরাটা না করে কেউ যদি পিউর অফস্পিনার হতে চায়, তাহলে পারবে। আমার মতে দুসরা করা যাবে না। দুসরা করলে অফস্পিনারের অ্যাকশন ঠিক রাখা খুবই কঠিন।

তো নিজেকে কখনো অফস্পিনারের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন বা নেওয়ার ইচ্ছা আছে?

আজহার হোসেন সান্টু : না ঠিক সেভাবে নেই। আমি ঠিক ওইভাবে বোর্ডের কোনো কার্যক্রমে জড়িত নই। এজন্যই আমার নিজের কোনো পরিকল্পনা নেই। যদি কখনো প্রয়োজন হয়, বা কেউ যদি কিছু জানতে চায়, আমার সামর্থ্যের মধ্যে থাকে তাহলে অবশ্যই করবো বা চেষ্টা করব।

আপনি বাংলাদেশের হয়ে প্রথম হাফ সেঞ্চুরি করেছেন, আপনার ভাতিজা (মেহরাব হোসেন অপি) করেছেন প্রথম সেঞ্চুরি। কেমন এটা ভাবতে?

আজহার হোসেন সান্টু : অবশ্যই খুব ভালো। বাংলাদেশের হয়ে যতটুকু পেরেছি করেছি। অপিও চমৎকার খেলেই পেয়েছে। এটা অবশ্যই ভালো লাগার। আমরা ভাগ্যবানও।

হাফ-সেঞ্চুরি, সেঞ্চুরি এরপর আরও বড় কিছু কি আপনাদের পরিবার থেকে আসবে?

আজহার হোসেন সান্টু : দুঃখজনকভাবে তেমন কেউ নাই। আমাদের বাসায় অনেকগুলো ছেলে আছে অপির পরেও। দুঃখজনক, ঐ যে যুগটা বদলে গেছে, আমার যেমন তিনটা ছেলে। পড়াশুনায় ওদের এতো চাপ আমিই বলতে পারি না ক্রিকেট খেলতে। তবে ওরা ক্রিকেট খেলে, ভালোবাসে কিন্তু ওই খেলা এখনকার যুগে চলে না। এখন অনেক পেশাদারভাবে খেলা উচিৎ সেভাবে ওরা খেলতে পারে না। আমি জানি না ক্রিকেটার বা কেউ কোনো খেলোয়াড় হবে কিনা। এখন যে পরিস্থিতি পড়াশুনার পাশাপাশি আরেকটা ভালো কিছু হওয়া খুব কঠিন।

বাংলাদেশ দলটা এখন অনেক এগিয়েছে। এখন অনেক বড় বড় নাম যুক্ত হয়েছে। সদ্যই কোর্টনি ওয়ালশ আসলেন। এ দলটাকে আপনি পাঁচ বছর পর কোথায় দেখবেন বলে মনে হয়?

আজহার হোসেন সান্টু : আমাদের বর্তমান যে পরিকল্পনা তাতে বাংলাদেশ যেভাবেই যাক অনেক এগিয়ে যাবে। এতে ওয়ালশ আসুক কিংবা না আসুক। যদি এই ট্রাকে থাকতে পারি যদি কোনো ব্রেক না আসে তাহলে আশা করি আরও অনেক এগিয়ে যাবে। আগামী পাঁচ বছরে টি-টোয়েন্টি কিংবা ওয়ানডেতে আমরা বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল বা ফাইনালে দেখতে পারব। চ্যাম্পিয়ন পরের কথা সেটা তো একটি মাত্র ম্যাচের ব্যাপার। তবে আমরা অনেক ভালো করতে পারব।

আপনি বললেন টি-টোয়েন্টি কিংবা ওয়ানডেতে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু টেস্টে সেভাবে উন্নতি হচ্ছে না...

আজহার হোসেন সান্টু : আসল কথা হচ্ছে এটা (টেস্ট) ক্রিকেটের মূল খেলা, আর যদি এটাই যদি না খেলেন তাহলে কীভাবে পারবেন, কীভাবে পরিকল্পনা করবেন আর কীভাবেই বা স্বপ্ন দেখবেন। আমরা এতো কম টেস্ট খেলি তাতে আমাদের এখনই অনেক বড় স্বপ্ন দেখাটা মনে হয় না ঠিক। এখন উচিৎ অনেক টেস্ট খেলা এবং চেষ্টা করা উচিৎ যতটুকু সম্ভব ভালো খেলা। চেষ্টা করা উচিৎ খেলাটাকে পাঁচ দিনে টেনে নিয়ে যাওয়া। ফলাফল এর পরের ব্যাপার। আমরা বেশকিছু ম্যাচ খেলতে থাকি তারপর এ নিয়ে পরিকল্পনা করা যাবে। তখন এমনিতেই এগিয়ে যাব।

আপনি একজন নিখুঁত খেলোয়াড় ছিলেন, সময় নিয়ে খেলতেন। কিন্তু তখন বাংলাদেশ টেস্ট খেলত না। বর্তমানে বাংলাদেশ দলকে টেস্ট খেলতে দেখে টেস্ট ক্রিকেটকে মিস করেন?

আজহার হোসেন সান্টু : আমি প্রচণ্ডভাবে মিস করি। যারা আমাকে চিনে তারা সবাই বলে যদি টেস্ট খেলতে তাহলে ভালো করতে। আমি খেলাটা শিখেছি এখান থেকে এরপর আমি খেলার জন্যই ইংল্যান্ড চলে যাই। আমি সেখানে ইংলিশদের খেলা দেখেছি। সেখানে গ্রামাটিকাল খেলা দেখেছি। ওরা সবসময় বেসিকটা ভালো, স্ট্রেইট ব্যাটে খেলা এসব করতো, আমিও ওদের মতোই চেষ্টা করতাম। আমি একটু সময় নিতাম, একটু ধীরে খেলতাম, তবে খুব একুরেট খেলার চেষ্টা করতাম। আমার কাছের সবাই যারা ক্রিকেটপাড়ায় আছে সবাই বলে এখন যদি সান্টু খেলতো তাহলে টেস্ট খুব ভালো খেলতো। আমারও তাই মনে হয়। কারণ আমি একটু ধীরেসুস্থে সোজা ব্যাটে খেলতাম। আমি এটা মিস করি। বড় ইনিংসের খেলা খেললামই না কখনো।

আরটি/এনইউ/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।