ঘরে বসে সবকিছু, মোবাইল অ্যাপেই ভরসা

বর্তমান যুগকে অনায়াসে বলা যায় ‘অ্যাপের যুগ’। একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে বিপ্লব এনেছে, তার অন্যতম চালিকাশক্তি হচ্ছে মোবাইল অ্যাপ। ঘুম থেকে উঠেই আমাদের অনেকের দিন শুরু হয় মোবাইল স্ক্রিন দেখে। ঘড়ি দেখা, আবহাওয়া বোঝা, প্রাতঃরাশের মেনু ঠিক করা থেকে শুরু করে অফিসের কাজ, কেনাকাটা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাগ্রহণ, বিনোদন সবই এখন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সম্ভব।
জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হচ্ছে যানজট এবং দৈনন্দিন রান্নার ঝামেলা। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ যেমন উবার, পাঠাও, বাইক, সহজ এসব আমাদের দ্রুত ও নিরাপদ যাতায়াতে সহায়তা করছে। বিশেষ করে জরুরি মিটিং বা নির্ধারিত সময়ে অফিসে পৌঁছাতে অনেকেই এই অ্যাপের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন।
অন্যদিকে রান্না না থাকলেও এখন আর চিন্তার কিছু নেই। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ যেমন ফুডপান্ডা, হাংরিনাকি এর মাধ্যমে ঘরে বসেই রেস্টুরেন্টের পছন্দের খাবার পেতে পারছেন ব্যবহারকারীরা। করোনাকালে এই অ্যাপগুলোর চাহিদা বিশেষকরে গুরুত্ব পেয়েছিল, যখন ঘর থেকে বের হওয়াই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ ও আতঙ্কের কারণ।
আগে যেখানে বিদ্যুৎ বিল বা অন্য কোনো অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য ব্যাংকে বা কাউন্টারে লাইনে দাঁড়াতে হতো, এখন এক ক্লিকেই কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। বিকাশ, নগদ, রকেট এসব অ্যাপ শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একজন কৃষক এখন মোবাইলে টাকা পেতে পারেন তার সন্তান বা আত্মীয়ের কাছ থেকে, আবার গৃহিণী নিজের স্মার্টফোন থেকেই বাজারের খরচ মেটাতে পারেন।
এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখন সহজেই পরিবারের সদস্যদের কাছে টাকা পাঠাতে পারছেন। ঈদ, রোজা কিংবা যে কোনো জরুরি সময়ে অর্থের লেনদেন যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি দ্রুততাও বেড়েছে।
শিক্ষার জগতে মোবাইল অ্যাপ এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। টেন মিনিট স্কুল, শিখো, স্মার্ট এডু এসব অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই পাচ্ছেন অনলাইন ক্লাস, ভিডিও লেকচার, কুইজ এবং পড়াশোনার সহায়তা। গ্রামের শিক্ষার্থী কিংবা শহরের কোচিং বঞ্চিত শিক্ষার্থী সবাই উপকৃত হচ্ছেন এই অ্যাপগুলো থেকে।
মায়া, টনিক, আমার ডাক্তার এমন অ্যাপের মাধ্যমে এখন মোবাইল থেকেই মিলছে চিকিৎসা পরামর্শ। গর্ভবতী মা থেকে শিশু, মানসিক স্বাস্থ্য থেকে হেলথ চেকআপ সবকিছুর জন্যই আছে আলাদা পরিষেবা। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করা থেকে শুরু করে ওষুধের নাম জানা, এমনকি লাইভ চ্যাটেও ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলা যায় এখন অ্যাপের মাধ্যমে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার ক্ষেত্রেও অ্যাপ ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। চালডাল অ্যাপ থেকে বাজার করা অনেক গৃহিণীকে উপকারে এনে দিয়েছে। এখন আর বাজার করতে বাইরে যাওয়ার দরকার পড়ে না।
অফিস ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত হচ্ছে গুগল ক্যালেন্ডার, ট্রেলো, স্ল্যাক, নোশন। যেগুলো টিমওয়ার্ক ও প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টকে করেছে সহজ, সুনিয়ন্ত্রিত ও সময়োপযোগী। বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সার বা রিমোট অফিসে কর্মরতদের জন্য এই অ্যাপগুলো কার্যকরী ভূমিকা রেখে চলেছে।
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রাম এই সব অ্যাপ মানুষকে সামাজিকভাবে সংযুক্ত রাখছে। ছবি, ভিডিও শেয়ার, লাইভ স্ট্রিমিং, বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট সবই এখন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। অবসরের সময় ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, স্পটিফাই কিংবা বঙ্গবিডির মতো অ্যাপগুলো ঘরে বসেই যোগাচ্ছে বৈচিত্র্যময় বিনোদন ও হাসির খোরাক।
ঘুমের মান উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে স্লিপ সাইকেল, ক্যাল্ম অ্যাপ্লিকেশন। যেগুলো ঘুমের স্বাভাবিকতা বিশ্লেষণ করে পরামর্শ দিচ্ছে মানসিক প্রশান্তির জন্য।
তবে মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারের ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ভিডিও গেম ও ইউটিউবের অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের পড়াশোনা ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। এছাড়া তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিয়েও রয়েছে কিছু শঙ্কা। অনেক অ্যাপ ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত ডাটা সংগ্রহ করে যা ভবিষ্যতে ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপ নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনকে সহজ, দ্রুত ও কার্যকর করেছে। এটি সময় বাঁচাচ্ছে, পরিশ্রম কমাচ্ছে এবং দরকারি সেবা পৌঁছে দিচ্ছে দ্রুত সময়ে। তবে প্রযুক্তির এই কল্যাণকে সত্যিকারের সুফল হিসেবে পেতে হলে চাই সচেতনতা, ভারসাম্য এবং সঠিক জ্ঞান। নয়তো প্রযুক্তির এই সহায়ক হাত একসময় আমাদের ওপরই চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
আরও পড়ুন
কেএসকে/এমএস