জমিদারবাড়ি ও তিন সাইকেল আরোহীর গল্প

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৪৫ পিএম, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
জমিদারবাড়ির সামনে তিন সাইকেল আরোহী, ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কামরুল হাসান হৃদয়

তখন দুপুর। চাঁদপুরের রুপসা জমিদারবাড়ির প্রাচীন ইটের গায়ে পড়ছিল রোদ। যেন সময়ের নিজের আলোয় সেজে উঠেছে স্থাপনাটি। উঠোনে রাখা তিনটি সাইকেল। কেবল লোহা নয়; তা যেন তিনটি জীবন্ত স্বপ্ন। পাশে তিনজন মানুষ। ঘামে ভেজা মুখ কিন্তু চোখে ভ্রমণের উচ্ছ্বাসের ঝিলিক। তারা এসেছেন রাজধানী থেকে। চাকরির ক্লান্তি আর কংক্রিটের বন্ধন ছেড়ে। সপ্তাহজুড়ে কাজের পর ছুটির দিনে তারা খোঁজেন মুক্তির ঠিকানা। পথে, নদীতে, প্রকৃতির বুকে।

তারা তিন বন্ধু। সৈয়দ বাহা উদ্দিন শিপন, প্রদীপ কুমার আর ওয়ায়েল আহম্মদ। ব্যাগের ব্যবসায়ী, স্টক ব্যবসায়ী আর কর্পোরেট অফিসে চাকরি করেন। পেশায় ভিন্ন হলেও তিনজনের মনেই এক বিন্দুতে মিলেছে তৃষ্ণা। দেশ দেখা, পথ চেনা আর সাইকেলের চাকা ঘোরানো। অফিসের কোলাহল পেছনে ফেলে যখন তারা সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামেন; তখন জীবনের সব ক্লান্তি যেন হাওয়া হয়ে যায়। ‘অফিসের পরের জীবনটা আমাদের, তাই সেটাকে প্রাণভরে বাঁচাতে চাই’। হাসতে হাসতে বললেন শিপন।

জমিদারবাড়ি ও তিন সাইকেল আরোহীর গল্প

তাদের পরিচয় ‘হেমন্ত রাইডার্স’। একঝাঁক তরুণ-অদম্য ভ্রমণপ্রেমীর তৈরি অনলাইনভিত্তিক ভ্রমণগোষ্ঠী এখন দশম বর্ষে। এই দলের সদস্যসংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়েছে। কেউ চাকরিজীবী, কেউ উদ্যোক্তা, কেউ ছাত্র কিন্তু সবার মনে একই নেশা, দেশের পথে বেরিয়ে পড়ার। ছুটি পেলেই তারা দলবেঁধে বেরিয়ে পড়েন। কখনো পাহাড়ে, কখনো নদীর তীরে, কখনো আবার ইতিহাসের পুরোনো স্থাপনায়। এবারের যাত্রায় তারা এসেছেন চাঁদপুরে ইলিশের রাজ্যে, নদীর জনপদে।

ঢাকায় ব্যাগের ব্যবসা করেন সৈয়দ বাহা উদ্দিন শিপন। ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা তার দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের। এর মধ্যে দেশে তিনি ভ্রমণ করেছেন চল্লিশটি জেলা। দেশের বাইরে গেছেন ভারত, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভুটান, ইন্দোনেশিয়া ও সৌদি আরব। তার চোখে পৃথিবী মানে গল্পে ভরা চলমান বই। প্রদীপ কুমার তুলনামূলক নতুন, তবে উৎসাহে একটুও কম নন। বছরখানেক হলো যুক্ত হয়েছেন হেমন্ত রাইডার্সের সঙ্গে, ঘুরেছেন পঁচিশ জেলা। ‘চাকা ঘোরালেই মনটা হালকা হয়ে যায়। রাস্তায় নামলেই মনে হয়, জীবনটা শুধু অফিস না’ বললেন তিনি। ওয়ায়েল আহম্মদ ঢাকায় থাকেন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ শেষ করেছেন। অবসরে তিনি বেরিয়ে পড়েন পথের খোঁজে, কখনো একা, কখনো দলবেঁধে। তিনি ঘুরেছেন সৌদি আরব ও থাইল্যান্ডে। ‘দেশকে জানতে হলে হাঁটতে হয়, সাইকেল সেই জানার সেরা সঙ্গী’ বললেন তিনি।

জমিদারবাড়ি ও তিন সাইকেল আরোহীর গল্প

আরও পড়ুন
আবার লালকুঠি হবে পর্যটকদের বড় আকর্ষণ
৬০০ বছরের পুরাকীর্তি ধানুকা মনসাবাড়ির মন্দির

চাঁদপুরের রুপসা জমিদারবাড়ি প্রায় তিনশ বছরের পুরোনো স্থাপনা। একসময় এটি ছিল প্রজাদের আশ্রয়স্থল, জমিদারদের দপ্তর। এখন নিঃসঙ্গ স্মৃতি। তারা বাড়ির দেওয়ালে হাত বুলিয়ে ইতিহাসের গন্ধ নিলেন। শিপন বললেন, ‘এ বাড়ির প্রতিটি ইট যেন গল্প বলে। কেমন সময় গেছে, কত কিছু বদলেছে, অথচ এই স্থাপত্য এখনো টিকে আছে।’ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে তারা জেনেছেন, জমিদারবাড়িটি একসময় ছিল এলাকার কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক স্থান। এখন এটি নিস্তব্ধ, অথচ প্রাণভরা ইতিহাসের এক নিদর্শন।

বিকেল গড়িয়ে গেলে তারা নদীর দিকে গেলেন। চাঁদপুরে এসে নদী না দেখা মানে ভ্রমণ অপূর্ণ। লঞ্চে বসে তারা নদীর ঢেউ দেখলেন, বাতাসে মুখ মেললেন, কেউ ছবি তুললেন, কেউ চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ‘নদী শেখায় চলতে, থেমে না যেতে’ বললেন ওয়ায়েল আহম্মদ। নদীর পাশে একটা চায়ের দোকানে বসে তিনজন ভাগাভাগি করে খেলেন স্থানীয় ইলিশ ভাজা। শহরের ব্যস্ততা থেকে অনেক দূরে, সেই মুহূর্তটিই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় শান্তি।

জমিদারবাড়ি ও তিন সাইকেল আরোহীর গল্প

রাত নামলে তারা উঠলেন রজনীগন্ধা হোটেলে। ক্লান্ত শরীর, তবু মন উচ্ছ্বসিত। ঘরে বসেই পরিকল্পনা করতে লাগলেন পরের দিনের গন্তব্য চাঁদপুরের আরেকটি জমিদারবাড়ি কিংবা হয়তো পরের সপ্তাহে মেঘনার অন্য পারে কোনো নতুন গল্পের খোঁজে। তাদের কাছে ভ্রমণ মানে শুধু জায়গা দেখা নয় বরং দেশের মানুষ, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের সঙ্গে আত্মার মেলবন্ধন।

তিন বন্ধু বললেন, ‘দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু পতাকা না, তার ইতিহাস, নদী, পথ, মানুষের মুখ—সব জানা।’ রাত তখন গভীর, বাইরে নদীর হাওয়া বইছে। রুপসা জমিদারবাড়ি পেছনে ফেলে তাদের সাইকেলগুলো বিশ্রামে কিন্তু তিন বন্ধুর মন এখনো পথে। যেখানে ইতিহাস, প্রকৃতি আর বন্ধুত্ব মিলেমিশে আছে বাংলাদেশেরই মতো বিস্তৃত ও অমলিন।

লেখক: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।