কানাকুয়া পাখির ডাকে কি বৃষ্টি নামে?

মামুনূর রহমান হৃদয়
মামুনূর রহমান হৃদয় মামুনূর রহমান হৃদয় , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ১২:৪২ পিএম, ১৯ জুন ২০২৫
গ্রামীণ জীবনে পরিচিত পাখির নাম কানাকুয়া, ছবি: জাগো নিউজ

একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের সকালে কিংবা দুপুরের বৃষ্টিভেজা বাতাসে হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন এক মিষ্টি অথচ রহস্যময় সুরে ভেসে আসতো—কুপ-কুপ-কুপ। সেই সুরে যেন প্রকৃতি নিজেই ডাকে; কারও মনোযোগ চায়। আশপাশের বড়রা তখন বলতেন, ‘দেখিস, কানাকুয়া ডাকছে, এখনই বৃষ্টি নামবে!’ যেন পাখির ডাকেই প্রকৃতি সাড়া দেয়। এ বিশ্বাস শুধু কুসংস্কার নয় বরং প্রকৃতি আর প্রাণীর মাঝে গভীর সম্পর্কের প্রমাণ।

বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে পরিচিত এক পাখির নাম কানাকুয়া। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘গ্রেটার কোকাল’ আর বৈজ্ঞানিক নাম ‘সেন্ট্রোপাস সাইনেনসিস’। এটি কোকিল পরিবারের সদস্য হলেও কোকিলের মতো পরজীবী নয়। কোকিল যেমন অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে; কানাকুয়া কিন্তু নিজের মতো করে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে বাসা বানিয়ে সংসার সাজায়।

বিজ্ঞাপন

বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাখিটির আছে নানা নাম। কেউ বলে কুপ পাখি, কেউ বলে কুবো, কানাকুও। আবার কোথাও কুক্কাল, কানাকোকা কিংবা কানা কুবো। যদিও কানা শব্দটি ব্যবহৃত হলেও পাখিটি অন্ধ নয়। এসব নাম মূলত তাদের ডাকের সুরের ওপর ভিত্তি করেই এসেছে।

পাখিটির রং অত্যন্ত আকর্ষণীয়। পুরো শরীর কালচে, তবে সূর্যের আলোতে তা চকচকে হয়। ডানাগুলো বাদামি রঙের, লম্বা লেজ একদম কুচকুচে কালো। চোখের মণি কালো হলেও তার চারপাশ ঘিরে থাকে লালচে বৃত্ত, যা একে রহস্যময় রূপ দেয়। পা থেকে নখ পর্যন্ত কালো বর্ণের। হাঁটা-চলা করে নিঃশব্দে, যেন প্রকৃতির নীরব এক চরিত্র। গাছের ডালে কম বসে বরং ঝোঁপঝাড়, খালপাড় কিংবা ধানক্ষেতের গা ঘেঁষে চুপচাপ হেঁটে চলে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

কানাকুয়া মূলত মাংসাশী পাখি। তারা শুঁয়োপোকা, ঘাসফড়িং, টিকটিকি, ব্যাঙ—এমনকি ছোট পাখির ডিম ও ছানা খেয়ে থাকে। ফলে ছোট পাখিরা একে ভয় পায়। প্রায়ই একা দেখা যায়, তবে জোড়া বাঁধলে যুগলে ঘোরে। এদের চলাফেরায় যেমন ধীরতা; তেমনই আছে একধরনের আত্মস্থতা।

বাংলার লোকসংস্কৃতিতে কানাকুয়ার ডাক একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্বাসে রূপ নিয়েছে। বলা হয়, এ পাখি ডাকলে বৃষ্টি হয়। আবার কিছু অঞ্চলে বিশ্বাস করা হয়, এ পাখির ডাক শোনা মানেই কোনো অশুভ সংবাদ আসতে পারে। যদিও এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তবে লোকজ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। প্রাকৃতিক ছন্দের সঙ্গে এদের ডাকার সময় এবং আবহাওয়ার মিল দেখে হয়তো মানুষের মনে এ বিশ্বাস গেঁথে আছে।

একসময় গ্রামে সহজেই চোখে পড়তো এ পাখি। কিন্তু এখন অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। নগরায়ন, বনাঞ্চলের অবলুপ্তি, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার আর খাদ্যচক্রের ভারসাম্যহীনতার কারণে আজ কানাকুয়াও বিপন্ন হওয়ার পথে। শহরের ইট-পাথরের জঞ্জালে এরা হারিয়ে যেতে বসেছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

তবুও এখনো যারা ভোরবেলা গ্রাম কিংবা শহরের সবুজ প্রান্তে হাঁটতে যান; তারা কখনো কখনো শুনতে পান সেই চিরচেনা ডাক—কুপ-কুপ-কুপ। তখন বাতাসে মিশে যায় এক মধুর স্মৃতি। চোখে ভেসে ওঠে দাদার গল্প। দাদি মুখে হাসি এনে বলে উঠতেন, ‘দেখিস, কানাকুয়া ডাকছে—বৃষ্টি নামবে!’

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।