সাহিত্যের শিল্পঋণ : একটি পাঠপ্রতিক্রিয়া


প্রকাশিত: ০৫:৫৩ এএম, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

‘সাহিত্যের শিল্পঋণ’ নামে কবি ফকির ইলিয়াসের সদ্যপ্রকাশিত বইটি পড়ে শেষ করলাম। বইখানা একুশে বইমেলা-২০১৬ থেকে সংগৃহীত। এর আগে তার সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধের বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তাই ফিরতি পথে প্লেনে বসে এই বইটিই প্রথমে হাতে নিলাম। উড়ালপথে দীর্ঘ পথ পাড়ির একটা বাড়তি পাওনা হলো একটানা বই পড়ার সুযোগ।
 
একশ চার পৃষ্ঠার এই বইতে আছে সতেরটি ছোট ছোট প্রবন্ধ। সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা। তবে চোখ আটকে যায় বইয়ের শিরোনামে। সাহিত্যের শিল্পঋণ। কি বুঝাতে চেয়েছেন লেখক? প্রথমে মনে হলো সাহিত্য আর শিল্পকে কি আলাদা করে ভাবছেন কবি? নাকি ঋণের প্রকার ভেদ বুঝাতেই এই বিশেষণ? পড়া শুরু করার আগেই শিরোনাম নিয়ে চিন্তা অবান্তর। কিন্তু ফকির ইলিয়াসের এই শিরোনামটি আমাকে প্রলুব্ধ করলো শিল্প সাহিত্যের সম্পূরক নির্ভরশীলতার বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে।
 
সম্ভবত এরিষ্টটলই সাহিত্য এবং শিল্প নিয়ে প্রথম কথা বলেন, তার ‘পয়েটিকস`-এ। কবিতায় (তথা সাহিত্যে) তিন ধরনের অনুষঙ্গের কথা বলেছেন তিনি - Matter (ভাষা, ছন্দ ও সুর), Subject (বিষয়বস্তু), Method (মাধ্যম, উপস্থাপনা)। তৎকালে গদ্যের চেয়ে গীতি-কাব্যিক প্রকাশই ছিলো বেশি, তাই কবিতা বলতে শুধু আক্ষরিক কাব্যই নয় বরং নাটক ইত্যাদিকেও বুঝিয়েছেন। আরো গভীরে গেলে দেখা যায় শিল্প আর সাহিত্যে তেমন ফারাক রাখেন`নি এরিস্টটল।
 
পয়েটিকস (Poetics) আর রেটরিকস (Rhetorics) নামের এরিস্টটলের দুইটি যুগল কাজ তাঁর অন্যান্য কাজ থেকে আলাদা। প্রসঙ্গটাও ভিন্ন মাত্রার। লক্ষ্যণীয়, পয়েটিকস-এ শিল্প সাহিত্যের গুণগত বিষয় নিয়ে মতামত ব্যক্ত হয়েছে। এর দায়- দায়িত্বের নির্দেশনা নেই। পরবর্তিতে আবু সিনা, আল ফারাবি, আবু রুশদ – এদের অনেকেই এরিস্টলের কাজের ওপর কাজ করেছেন। মূলত এরাই পরবর্তিতে গ্রীক দর্শণকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সাথে তাঁদের নিজস্ব মতামত আর টিকা পাদটিকা জ্ঞানের ভান্ডারকে শাণিত করতে থাকে। এই ভাবে দেখি একসময় শিল্প-সাহিত্যের দায়িত্ববোধ নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়। আবু রুশদ এতে নৈতিকতার প্রশ্নটি জুড়ে দেন। সেই থেকে শিল্প সাহিত্যের সামাজিক দায় আর নৈতিক দায় নিয়ে কথা হয়েই আসছে প্রতিনিয়ত। সমাজ সচেতন কবি ফকির ইলিয়াসকে চিনি বলেই মনে হলো লেখক হয়তো এই বোধ থেকেই কলম ধরেছেন।
 
আমার নিজের মত, শিল্প আসলে এক ও অভিন্ন। সকল আলঙ্কারিক বহিঃপ্রকাশের মাতৃরূপ। এই বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম ভিন্ন ভিন্ন শাখার জন্ম দেয়। এবং সঙ্গত কারণেই শিল্পের এক শাখা অন্য শাখার প্রতি সর্বদাই ঋণগ্রস্ত। আর সামগ্রিক ভাবে শিল্প তার সকল মাধ্যম ও শাখা প্রশাখার কাছে ঋণগ্রস্ত। সঙ্গীত, চিত্র, অভিনয় ইত্যাদির মতো সাহিত্য নিয়েই শিল্পের সৃষ্টি। কাজেই ‘শিল্পঋণ’ কথাটা হয়তো শিল্পের কাছে সাহিত্যের ঋণ নয়। বরং আমার চোখে শিল্পই সাহিত্যের কাছে ঋণী।

শিল্পমাধ্যমের এই পারস্পরিক ও অন্তর্গত সম্পুরক নির্ভরশীলতা ছাড়াও আরও একটা দায় থেকে যায়। শিল্পী তার সৃষ্টির অনুষঙ্গ জোগাড় করেন পারিপার্শ্বিকতা থেকে। সেখানে সমাজ আছে। প্রকৃতি আছে। এই দুইকে ঘিরে একটা মনোজগত তৈরি করেন তিনি। আর সেই জগতটাকে উন্মুক্ত করেন তার মাধ্যমে, হোক সাহিত্য, হোক সঙ্গীত, হোক নাট্যকলা, হোক চিত্রকলা। এইভাবে সমাজের কাছে, প্রকৃতির কাছেও রয়ে যায় শিল্পের অগাধ ঋণ। শিল্পের একটা অঙ্গ বা শাখা হিসেবে সাহিত্যেরও এই ‘শিল্পঋণ’ আছে। আমি যা বুঝেছি, এতে সমাজের কাছে সাহিত্যের দায়বদ্ধতার কথাই বুঝানো হয়েছে।

দূরূহ এই বিষয়টা বুঝাতে গিয়ে লেখক বার বার উদাহরণ টেনেছেন বাংলা সাহিত্যের (এবং কাইয়ুম চৌধুরীর মতো শিল্পীর) নক্ষত্রদের। উদ্বৃতি দিয়েছেন ঘন ঘন। তাঁর উদ্ধৃতিগুলোও অত্যন্ত মনোগ্রাহী, আলাদা করে পড়ার মতো। এতে শুধু লেখকের ব্যাপক পড়াশুনার প্রকাশ ঘটে নি, তাঁর রুচি ও বিশ্লেষণধর্মী মনেরও প্রতিফলন ঘটেছে। ভালো লেগেছে প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম। শিরোনামের নান্দনিক সৌন্দর্য্য দৃষ্টিকাড়া। কবির কলমের স্পষ্ট ছোঁয়া। বইটির শুরু ‘কবিতার গ্রহপথে হেঁটে যায় মৌন কাব্যকার’ নামের প্রবন্ধটি দিয়ে, আর শেষ ‘সাহিত্যের শিল্পঋণ, গ্রহিতার ভোরের জানালা’ নামের চমৎকার একটা আলোচনা দিয়ে।
 
বইটি পড়ার পর মনে হলো সুলিখিত জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধগুলো সাহিত্য বিষয়ে নিঃসন্দেহে আমাদের চিন্তাকে সমৃদ্ধ করবে। জানি, যারা বইটি পড়বেন তাদের একেক জন বইটির একেক দিক নিয়ে চিন্তা করবেন। পাঠকদের সেই স্বাধীনতা তো আছেই। আমি নিজে আকৃষ্ট হয়েছি বইটির শিরোনামে। শেষমেষ দেখলাম ফকির ইলিয়াস আমাকে নিরাশ করেন নি। স্খলন আর অবক্ষয়ের যুগে কবি-সাহিত্যিকদের সামাজিক-নৈতিক দায়বদ্ধতার সূত্রটি বারবার ধরিয়ে দেয়া বড়োই জরুরি। কবি সেই কাজটিই করেছেন। তাঁকে সাধুবাদ।

সাহিত্যের শিল্পঋণ। ফকির ইলিয়াস। পৃষ্ঠা ১০৪। মূল্য ২৩০ টাকা।
প্রচ্ছদ তৌহিন হাসান। প্রকাশক অনুপ্রাণন প্রকাশন। একুশে বইমেলা ২০১৬

লেখক : কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক
জেলিকো, টেনেসি, যুক্তরাষ্ট্র

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।