ছুটি বিহীন চাকরি সফলভাবে সামলে নিচ্ছেন গেটম্যান লতা

আল মামুন সাগর আল মামুন সাগর , জেলা প্রতিনিধি কুষ্টিয়া
প্রকাশিত: ০২:৩৮ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২৫

বাটনফোনে রিংটন বাজতেই এদিক-সেদিক উঁকিঝুঁকি। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নামালেন রেললাইনের ভারী লোহার গেট। গেটের দু’পাশে অপেক্ষায় পথচারীরা। এরপর ডানহাতে সবুজ পতাকা শক্ত করে ধরে সোজা দাঁড়িয়ে থাকলেন। মুহূর্তে একটি ট্রেন চলে গেলো। এরপর হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ফের গেট তুলে দিলেন গেটম্যান লতিফা ইসলাম লতা (৩৪)।

কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী রেললাইনের কুমারখালী কাজীপাড়া রেলগেট এলাকার নিয়মিত দৃশ্য এটি। লতা ২০২০ সাল থেকে কুমারখালী পৌরসভার কাজীপাড়া রেলগেট এলাকায় গেটম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি তার এক হাতে শক্ত করে পতাকা ধরে হাজারো মানুষের প্রাণের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। আরেক হাতে সংসারের দায়িত্ব পালন করেন। স্বামীকে সহযোগিতা ও নিজেকে স্বাবলম্বী করতে এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি।

লতিফা ইসলাম লতা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সিমরাইলকান্দি এলাকার বালু ব্যবসায়ী মো. আফসানুর ভূঁইয়ার স্ত্রী। তাদের তিন ছেলে আফিফ (১৩), আরাফাত (১০) ও আরফান (৭ মাস)। তিনি কুমারখালী পৌরসভার কাজীপাড়া রেলগেট এলাকার আতিকুর রহমানের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। মাঝেমধ্যে তার স্বামী কুমারখালীতে আসেন।

ছুটি বিহীন চাকরি সফলভাবে সামলে নিচ্ছেন গেটম্যান লতা

আলাপকালে গেটম্যান লতিফা ইসলাম লতা হাসিভরা মুখে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ হলেও হাজারো প্রাণের নিরাপত্তার জন্য দিনে পালাক্রমে আট ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছি। মূলত স্বামীকে সহযোগিতা ও নিজেকে স্বাবলম্বী করতে এবং সন্তানদের মানুষ করতে দুই হাতে বড় দুই দায়িত্ব সমান তালে চালিয়ে নিচ্ছি। নারী হিসেবে এমন কাজ করায় কেউ কেউ খারাপ মন্তব্য করে। আবার অনেকে ভালোও বলে। সব মিলে চলে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেল ক্রসিংয়ের মানোন্নয়ন প্রোজেক্টের আওতায় ২০২০ সালে রেললাইনের গেটম্যান বা গেটকিপারের চাকরিতে যোগ দেন লতা। এর আগে তিনি ঢাকায় একটি শিল্প কারখানায় চাকরি করতেন। তার স্বামী ব্যবসার কাজে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকেন। আর তিনি সন্তানদের নিয়ে ভাড়া বাড়িতে কাজীপাড়া রেলগেট এলাকায় বাস করেন। বড় ও ছোট ছেলে স্থানীয় একটি হাফেজিয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করে। আর সাত মাস বয়সী ছোট আরফান মায়ের সঙ্গেই থাকে। যখন ট্রেন আসার সময় হয়, তখন শিশু ছেলেকে বিভিন্ন জনের কাছে রেখে দায়িত্ব পালন করেন লতা। এ পর্যন্ত সেখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে জানা গেছে।

ছুটি বিহীন চাকরি সফলভাবে সামলে নিচ্ছেন গেটম্যান লতা

লতার স্বামী আফসানুর ভূঁইয়া ফোনে বলেন, আমার স্ত্রী একজন কর্মঠ ও আদর্শ নারী। সময় সুযোগ পেলে তার কাজে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। তাকে নিয়ে আমি গর্বিত।

জানতে চাইলে লতার সহকর্মী আরেক গেটম্যান রাজিব হোসেন বলেন, জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তার জন্য আমরা তিনজন পালাক্রমে আট ঘণ্টা করে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছি। তিনজনের মধ্যে একজন নারী। ঝুঁকি আছে জেনেও লোকের কটূকথা শুনে লতা আপা কাজ করছেন। আমরা তাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।

স্থানীয় বাসিন্দা প্রসেনজিৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, কাজীপাড়া রেলগেট এলাকায় একজন নারী কিপার সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি সংসারের কাজকর্ম চালিয়ে নিচ্ছেন। সমাজে তিনি একজন আদর্শ। তার থেকে অন্যান্য নারীদের শেখার আছে অনেক।

ছুটি বিহীন চাকরি সফলভাবে সামলে নিচ্ছেন গেটম্যান লতা

শুক্রবার (৭ মার্চ) বিকেলে কাজীপাড়া রেলগেট এলাকার আতিকুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সাত মাসের সন্তানকে বিছানায় রেখে সংসারের কাজ সেরে নিচ্ছেন লতা।

এসময় তিনি বলেন, চাকরি করলেও আমি কারো স্ত্রী, কারো মা। একটা সংসার আছে। সবকিছুই মিলে তালে করতে হয়। তবে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এ চাকরিতে কোনো ছুটি নেই, আবার বেতন কম। তিনি বেতন বাড়ানো ও প্রয়োজনীয় ছুটি প্রাপ্তির দাবি জানান।

লতা শক্ত হাতে দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানিয়েছেন কুমারখালী রেলস্টেশন মাস্টার মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখন নারী-পুরুষের সমান অধিকার। ঝুঁকি জেনেও নারীরা এখন অনেক কাজ দক্ষভাবে করছেন।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।