পশুর হাড়-শিং ও অণ্ডকোষ থেকে কোটি টাকার ব্যবসা
গরুর হাড়, শিং এবং অণ্ডকোষসহ উচ্ছিষ্ট আবর্জনা হিসেবেই ফেলে দেওয়া হয়। বাসা-বাড়ি কিংবা রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারের উচ্ছিষ্টের সঙ্গেও ফেলে দেওয়া হয়ে থাকে এসব উচ্ছিষ্ট। কিন্তু আবর্জনাগুলোই কারো কারো কাছে সোনার মতো দামি। শুধু তাই নয়, আবর্জনার সঙ্গে রয়েছে শত শত মানুষের জীবন-জীবিকা।
এই আবর্জনা থেকেই প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করছেন কেউ কেউ। সিলেটের শতাধিক ব্যবসায়ী পশুর হাড়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কেবল কোরবানির পশুকে কেন্দ্র করে নয়, সারা বছরই গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার হাড়, শিং, অণ্ডকোষের ব্যবসা করছেন তারা। সে হিসাবে প্রতি মাসে সিলেট থেকে কোটি টাকার হাড়ের ব্যবসা হচ্ছে।
দেশের ওষুধ শিল্পসহ বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে পশুর এসব উচ্ছিষ্ট। তবে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায় এই খাতের খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না। রয়েছে সিন্ডিকেটের কালো থাবাও। যার কারণে অনেকে ব্যবসা করলেও আলোর মুখ দেখছেন না।
আরও পড়ুন-
- টুং-টাং শব্দে মুখর কামারপাড়া
- কোরবানির ঈদ এলেই চাহিদা বাড়ে তেঁতুল গাছের খাটিয়ার
- ঈদুল আজহায় ঢাকার দুই সিটিতে বসছে ১৯ অস্থায়ী পশুর হাট
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে গরু মহিষের হাড়সহ উচ্ছিষ্ট। সাধারণ মানুষের কাছে এর গুরুত্ব না থাকায় ফেলে দেওয়া হয় যত্রতত্র। কিন্তু কয়েক শ্রেণির মানুষ এসব সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করে পৌঁছে দেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
প্রতিবছর ঈদুল আযহা বা বিভিন্ন উৎসবে ব্যস্ততা বেড়ে যায় হাড় ব্যবসায়ীদের। এসময় মৌসুমী কিছু মানুষও নামেন হাড়ের ব্যবসায়। তবে স্থায়ীভাবে হাড়ের ব্যবসায় যুক্ত রয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। যাদের প্রত্যেকের রয়েছে ভাঙারির ব্যবসাও।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, ৮-১০ বছর আগে সিলেটে কয়েক শতাধিক পশুর হাড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। একসময় তারা শুধু এসবেরই ব্যবসা করতেন। কিন্তু লাভজনক এই ব্যবসায়ও সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ায় অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দেন। বর্তমানে যারা এই ব্যবসা করছেন, তারা মূলত ভাঙারির ব্যবসায়ী। পুরোনো জিনিসপত্র ক্রয় করার পাশাপাশি পশুর হাড়ের ব্যবসাও করছেন তারা।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সিলেটের বিভিন্ন মাংসের দোকান, কমিউনিটি সেন্টার, বিয়ে বাড়ি, মৎস্য খামার ও বাসাবাড়ি থেকে গরুর হাড়, শিং ও অণ্ডকোষ সংগ্রহ করেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। পথশিশুরাও বিভিন্ন জায়গা থেকে এগুলো সংগ্রহ করে থাকে। পুরো নগরী থেকে সংগৃহীত এসব উচ্ছিষ্ট জমা হয় বিভিন্ন স্থানে। সেখান থেকে প্রথম ধাপে বাছাই করা হয় গরুর হাড়, চর্বি, চোয়াল, শিং ও অণ্ডকোষগুলো। এরপর পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এগুলো আলাদা আলাদা করে প্যাকেটজাত করে দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা, কদতমলী, শিববাড়ি এলাকার বড় বড় ভাঙারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।
ব্যবসায়ীর জানান, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাছ থেকে প্রতিকেজি হাড় ১০-১২ টাকা, চর্বি, চোয়াল ও শিং ৮-১০ টাকা এবং অণ্ডকোষ প্রতি পিস ২০-৩০ টাকা ধরে কেনা হয়। পরে এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকা, বরিশাল ও যশোরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, সিলেট থেকে প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে প্রতিকেজি হাড়সহ উচ্ছিষ্ট ১৩-১৪ টাকা ও অণ্ডকোষ ৩০-৩৫ টাকা ধরে বিক্রি করা হয়।
সিলেট নগরীর লালবাজারে ৫০ বছর ধরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন শাহজাহান মিয়া। লালবাজারসহ সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় মাংস ব্যবসায়ী সমিতির অধীনে যত গরু জবাই হয় সবকয়টির হাড়সহ উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করেন তিনি। প্রতিদিন রাত আটটার পর থেকে জবাই করা পশুর হাড় সংগ্রহের কাজ শুরু করেন শাহজাহান। রাতভর কাজ করে পরদিন সিলেট নগরীর বিভিন্ন ভাঙারির দোকান ও আড়তে নিয়ে এসব বিক্রি করেন।
শাহজাহান মিয়া বলেন, একসময় তিনি সরাসরি ঢাকা, রাজশাহী ও যশোরে কোম্পানির কাছে মালামাল বিক্রি করতেন। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে ব্যবসায় সংকট দেখা দেয়। ঢাকা ও বরিশালের আড়তদাররা মালামাল ক্রয় করলেও বিল আটকে রাখেন। তারা জানান অপসোনিন কোম্পানি বিল দিতে দেরি করছে। এতে করে পুঁজি না থাকায় সংকট দেখা দেয়। এরপর থেকে সিলেটের বাইরে সরাসরি মালামাল পাঠানো বন্ধ করে দেন। বর্তমানে তিনি সিলেটের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে মালামাল বিক্রি করেন।
শাহজাহান মিয়া আরও বলেন, এই ব্যবসাতেও রয়েছে বড় সিন্ডিকেট। কোম্পানি দাম নির্ধারণ করে দেয়। আবার কখনো মালামাল নেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে করে সংকট তৈরি হয়। আমরাও বিনিয়োগ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।
নগরীর ভার্থখলা এলাকার ভাঙারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, সিলেটে শতাধিক ভাঙারি ব্যবসায়ী গরুর হাড়সহ উচ্ছিষ্টের ব্যবসা করেন। একসময় জমজমাট ছিল। এখন শুধু হাড়ের ব্যবসা কেউ করেন না। ভাঙারি পণ্যের সঙ্গে হাড়ের ব্যবসা করছেন।
তিনি বলেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পথশিশু ও বিভিন্ন বাজারের পরিচ্ছন্নতার কাজ যারা করেন তাদের কাছ থেকে আমরা হাড় কিনে থাকি। পরে এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকা, বরিশাল ও যশোরে পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, প্রতিকেজি হাড় ১৪-১৫ টাকা দরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়। প্রতিমাসে ৮-১০ টন মালামাল সিলেট থেকে বিক্রি করা যায়। ঈদ বা অন্য কোনো উৎসব এলে আরও বেশি কেনাবেচা হয়।
মোহাম্মদ হোসেন বলেন, পশুর হাড় দিয়ে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ক্যাপসুলের কাভার, নাড়ি দিয়ে অপারেশনের সুতা, রক্ত দিয়ে পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে সাবান তৈরি করা হয়। সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও হাড় ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকায় পশুর শিং চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বিদেশে পাঠান।
এফএ/এমএস