বিলুপ্তির পথে তাঁত শিল্প, পেশা ছাড়ছেন কারিগররা

রুবেলুর রহমান
রুবেলুর রহমান রুবেলুর রহমান , জেলা প্রতিনিধি রাজবাড়ী
প্রকাশিত: ০৬:০৯ পিএম, ০৮ অক্টোবর ২০২৫
তাঁতের বস্ত্র তৈরি করছেন এক কারিগর/ ছবি: জাগো নিউজ

একসময় তাঁতিদের হাতে তৈরি বস্ত্রশিল্পের জন্য সুপরিচিত ছিল রাজবাড়ী। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। কাঁচামালের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব এবং প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ঐতিহ্যবাহী এই তাঁত শিল্প এখন চরম সংকটে। ফলে বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অসংখ্য কারিগর।

স্থানীয়রা জানান, একসময় রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন স্থানে কয়েক হাজার কারিগর দিনরাত তাঁত বুনে ব্যস্ত সময় পার করতেন। কালুখালীর মৃগী, কালিকাপুর, মাজবাড়ী এবং পাংশার যশাই, মাছপাড়া ও সরিষাসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁত শিল্পের সেই পুরোনো দিনের কর্মচাঞ্চল্য এখন আর নেই। বর্তমানে এই শিল্পের সঙ্গে টিকে আছে মাত্র দুই শতাধিক তাঁতি পরিবার, যারা এখন মূলত লুঙ্গি ও গামছা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

বিলুপ্তির পথে তাঁত শিল্প, পেশা ছাড়ছেন কারিগররা

তাঁতশিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও কাঁচামালের উচ্চমূল্য এবং বিদেশি পণ্যের প্রভাবে কমেছে তাঁতশিল্পের কারিগরদের তৈরি পণ্যের কদর। পণ্যের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় তাদের বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং অধিকাংশ তাঁতিরা ভুগছেন পুঁজি সংকটে। যার কারণে অনেকেই বাধ্য তাদের পৈতৃক পেশা ছেড়ে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। এ অবস্থায় তাদের দিন কাটছে এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে।

আরও পড়ুন
পাবনায় ক্রমাগত লোকসানে বিলীন হচ্ছে তাঁত
ঋণের চাপে ধুঁকছে তাঁতিরা

তাঁত মালিক ইমরান হোসেন হতাশা প্রকাশ করে বলেন, বাপ দাদার পেশা অনেক কষ্ট করে ধরে রেখেছি। সুতার দাম অনেক বেশি, সে তুলনায় লুঙ্গির দাম কম। লোকসানের কারণে আমাদের এলাকায় কয়েকশ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ৩০ থেকে ৩৫টি তাঁত আছে, তার মধ্যে আমার আছে মাত্র পাঁচটি।

কারিগর শাহিনা খাতুন বলেন, আমাদেরই এই এলাকায় আগে অনেক তাঁত ছিল। এখন সুতার দাম হিসাবে কাপড়ের দাম কমে গেছে। যার কারণে এলাকার অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। অন্য কোনো কাজ করতে পারি না বিধায় আমরা এখনও কয়েক ঘর এই কাজ করে কোনোরকম সংসার চালাচ্ছি। এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে কাপড় তৈরির সুতার দাম কমাতে হবে এবং তৈরিকৃত পণ্যের দাম বাড়াতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা। তাহলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

বিলুপ্তির পথে তাঁত শিল্প, পেশা ছাড়ছেন কারিগররা

খরচের তুলনায় পণ্যে দাম কম পাওয়া যায় উল্লেখ করে সাইফুল ইসলাম নামে আরেক তাঁত মালিক বলেন, আমি ছোটোবেলা থেকেই লুঙ্গি, গামছা ও শাড়ি তৈরির কাজ করে আসছি। আগে এগুলো আমরা হাতে তৈরি করলেও এখন মেশিনের সাহায্যে তৈরি করছি। কিন্তু বিদ্যুৎ বিল, সুতার খরচ এবং নিজেদের পারিশ্রমিক হিসাবে বাজারে বিক্রি করতে গেলে পণ্যের দাম কম। যার কারণে দিন দিন অনেকেই এই পেশা থেকে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
রেশম পল্লিতে দুই বছরে বন্ধ হয়েছে এক হাজার তাঁতঘর
মানিকগঞ্জের তাঁতপল্লিতে ভরা মৌসুমেও হাহাকার
তাঁত শিল্পে বিনিয়োগকারীদের সহায়তা করবে সরকার

তিনি আরও বলেন, লেখাপড়া শিখি নাই, অন্য কোনো কাজও জানি না। ফলে বাধ্য হয়েই বাপ দাদার রেখে যাওয়া এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করছি। কিন্তু এখন সংসার আর চলছে না। অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিনিয়ত বাড়ছে সুতার দাম। আর লুঙ্গির দাম কমছে। তাছাড়া লুঙ্গি গামছা তৈরির পর অন্য জেলায় নিয়ে বিক্রি করতে হয়। যার কারণে খরচ আরও বেড়ে যায়। নিজেদের এলাকার বাজারে এসব পণ্য বিক্রি করার সুযোগ থাকলে ভালো হতো।

বিলুপ্তির পথে তাঁত শিল্প, পেশা ছাড়ছেন কারিগররা

কালুখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহুয়া আফরোজ বলেন, তাঁত শিল্প বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব। সরকারিভাবে কেউ সহযোগিতা নিতে চাইলে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করব। এলাকায় এসব পণ্য বাজারজাত করার জন্য চেষ্টা করা হবে।

বিসিক রাজবাড়ী জেলা কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক চয়ন বিশ্বাস জানান, তারা উদ্যোক্তাদের সেবা প্রদানে প্রস্তুত। তাঁত শিল্পীরা নিয়ম-নীতি মেনে তথ্য উপস্থাপন করলে বিসিক থেকে পরামর্শ, কারিগরি সহযোগিতা এবং ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে।

রুবেলুর রহমান/কেএইচকে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।