সোনালি অতীত হারিয়ে রেশম বীজাগার এখন ‘ভূতের’ ডেরা

শেখ মহসীন
শেখ মহসীন শেখ মহসীন ঈশ্বরদী (পাবনা)
প্রকাশিত: ০৪:৪৬ পিএম, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
ঈশ্বরদী রেশম বীজাগার এখন ঘন জঙ্গল

ঐতিহ্যবাহী ঈশ্বরদী রেশম বীজাগার। যেখানে আগে বছরজুড়ে তুত গাছের পাতা কাটা, পলু পোকা পালন, গুটি তৈরি আর সেগুলো থেকে সিল্কের সুতা তৈরির ধুম লেগে থাকতো। তবে কালের বিবর্তনে আজ সেই বীজাগারে ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। দীর্ঘদিন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বীজাগারের বিশাল জায়গাজুড়ে এখন ঘন জঙ্গল, পরিত্যক্ত ভবন আর সাপ-পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে।

জানা গেছে, ঈশ্বরদী রেশম বীজাগারে ১৭টি অনুমোদিত পদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন ম্যানেজার দায়িত্বে আছেন, বাকি পদগুলো ফাঁকা। এছাড়াও শতাধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলেও এখানে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক ২২ জন শ্রমিক, দুইজন নৈশপ্রহরী ও মাসিক চুক্তিভিত্তিক একজন কম্পিউটার অপারেটর কর্মরত। দৈনিক হাজিরার এসব শ্রমিকের আবার মাসে কাজ হয় ১০ থেকে ১২ দিন। বাকি দিন তাদের কর্মহীন থাকতে হয়। ফলে এখানকার শ্রমিকদের মানবেতন জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

সোনালি অতীত হারিয়ে রেশম বীজাগার এখন ‘ভুতের’ ডেরা

ঈশ্বরদী-পাবনা মহাসড়কের অরণকোলা মৌজায় ১৯৬২ সালে ১০৭ বিঘা ১২ কাঠা জমিতে রেশম বীজাগার স্থাপিত হয়। এক সময় ঈশ্বরদীর রেশম বীজাগারে পলু পালন, রেশম ডিম, রেশম গুটি উৎপাদন হতো। গুটি থেকে হতো সুতা। পাশাপাশি বছরজুড়েই চলতো তুত গাছ চাষাবাদের কর্মযজ্ঞ। বর্তমানে এখানে স্বল্প পরিসরে শুধু তুত গাছের চারা উৎপাদন চলছে। এছাড়া বন্ধ বাকি সব কার্যক্রম। ফলে এক সময়ের কর্মচাঞ্চল্য রেশম বীজাগার এখন নীরব-নিস্তব্ধ।

রেশম বীজাগার অফিস সূত্রে জানা যায়, রেশম বীজাগারের ১০৭ বিঘা ১২ কাঠা জমির মধ্যে তুত গাছ আবাদি জমি ৫৯ বিঘা। বাকি ৩৮ বিঘা জমিতে রয়েছে অফিস, আবাসিক ভবন, পলু পালন ঘর, তাঁত ঘরসহ ১৯ ভবন ও চারটি পুকুর।

সরেজমিনে দেখা যায়, পলু পালন, রেশম গুটি ও রেশম ডিম উৎপাদন বন্ধ। তুত গাছ থাকলেও পরিচর্যা করার লোকবল নেই। ফলে তুত গাছের জমি জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। পলু পোকা পালন, রেশম গুটি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত একতলা চারটি ও দোতলাবিশিষ্ট দুটি বিশাল ভবন রয়েছে। এর মধ্যে একতলা চারটি ভবন পরিত্যক্ত। ভবনের ছাদের পলেস্তারা খুলে এবং জানাল-দরজা ভেঙে যাওয়া সেখানে লতাপাতা গজিয়ে উঠে ঝোপঝাড়ে তৈরি হয়েছে। ফলে বিরাজ করছে ভূতুড়ে পরিবেশ।

রেশম বীজাগারের শ্রমিকরা জানান, এখানকার সোনালি অতীত রয়েছে। তুতের চারা উৎপাদন, পলু পোকা পালন, রেশম ডিম ও গুটি উৎপাদনের পাশাপাশি একসময় এখানে রেশমের গুটি থেকে সুতা তৈরি হতো। সেই সুতা রাজশাহী সিল্ক কারখানায় যেত। তৈরি হতো বিশ্ব বিখ্যাত সিল্কের শাড়িসহ নানান পোশাক। এখন শুধু ২৯ বিঘা জমিতে তুতের চারা উৎপাদন কার্যক্রম চলমান। বাকি সব কার্যক্রম বন্ধ।

সোনালি অতীত হারিয়ে রেশম বীজাগার এখন ‘ভুতের’ ডেরা

শ্রমিকরা জানান, ২০১৯ সালের ২৭ জুন এ বীজাগারের পাঁচজন শ্রমিককে অবসরজনিত বিদায়ের কারণে রেশম বোর্ড কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে শ্রমিকরা। দীর্ঘদিন আন্দোলনের ফলে কর্তৃপক্ষ বীজাগারের সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। প্রায় আড়াই বছর পর ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর রেশম উন্নয়ন প্রকল্পের একটি প্রজেক্টের আওতায় তুতের চারা উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই থেকে কোন রকমে চলছে। চারা উৎপাদন ও পরিচর্যার কাজ মাসে ১২ থেকে ১৩ দিন হয়। বাকি দিন বন্ধ থাকে। ফলে শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়।

তারা আরও জানান, দীর্ঘ আড়াই বছর এ বীজাগারের সব কার্যক্রম বন্ধ পর পুনরায় চালু হলেও কর্মরত শ্রমিকদের পুরো মাস কাজের সুযোগ নেই। মাসের অধিকাংশ দিন কাজ থাকে না। অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এখানে কর্তৃপক্ষ পলু পালন, রেশম ডিম, রেশম গুটি উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। রেশম উন্নয়ন বোর্ডের বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি বীজাগারে পলু পালন, ডিম ও রেশ গুটি উৎপাদন পুনরায় চালু করা হোক। তাহলে শ্রমিকদের মাসব্যাপী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

শ্রমিকদের অভিযোগ, এ বীজাগারে ৩০ বছর কাজ শেষে শ্রমিকরা অবসরে যাওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ খালি হাতে শ্রমিকদের বিদায় দেয়। ফলে বৃদ্ধ বয়সে শ্রমিকদের অর্থকষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়।

রেশম বীজাগারের শ্রমিক মো. বাদশা শেখ জাগো নিউজকে বলেন, এই রেশম বীজাগার এক সময় ভালোভাবে চলতো। ৫০ থেকে ৬০ জন শ্রমিক কাজ করতো। এখন রেশম বীজাগারটি বন্ধের পথে। আমাদের কাজ নেই। সপ্তাহে দুই-তিন দিন কাজ হয়। এটি চালু হলে আমরা কাজ করার সুযোগ পেতাম। পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে পড়ে চলতে পারতাম।

শ্রমিক আফজাল হোসেন বলেন, আগে এখানে ১২ মাস কাজ হতো। ৬ বছর এখানকার প্রায় সব কাজকর্ম বন্ধ। শুধুমাত্র তুতের চারা উৎপাদন হয়। মাঝেমধ্যে এখানে ডেইলি হাজিরায় কাজ করি। এ বয়সে আর কোথায় যাবো, কী করবো? সরকারের কাছে দাবি পুনরায় এ প্রতিষ্ঠান পুরোপুরিভাবে চালু করা হোক। যাতে এখানে কাজ করে আমরা দু’বেলা ডাল-ভাত খেতে পারি।

সোনালি অতীত হারিয়ে রেশম বীজাগার এখন ‘ভুতের’ ডেরা

শ্রমিক মনরঞ্জন কুমার বলেন, এসময় এ প্রতিষ্ঠান রমরমা চলতো। পলু পালন ও সুতা উৎপাদন হতো। ৬ বছর হলো এসব বন্ধ রয়েছে। শুধুমাত্র তুতের চারা এখানে উৎপাদন হয়। আমাদের মাসে ৭ থেকে ৮ দিন কাজ পাই। একসময় ৩৫ থেকে ৪০ জন নিয়মিত শ্রমিক ও ১০০ মতো মৌসুমি শ্রমিক কাজ করতো। এ ফার্মের চারদিকে ঘন জঙ্গল হয়ে গেছে। বাসা-বাড়ি, পলু পালন ভবন ও অফিস সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি দ্রুত এ প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি চালু করতো তাহলে সরকারও লাভবান হতো এবং আমাদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো।

ঈশ্বরদী রেশম বীজাগারের ভারপ্রাপ্ত ফার্ম ম্যানেজার মো. খোকন আলী বলেন, ঈশ্বরদী রেশম বীজাগারে ১৭টি পদ এর মধ্যে একটি পদে শুধু মাত্র আমি দায়িত্ব পালন করছি। অন্য কোনো পদে লোক নেই। আমি একাই সকালে প্রতিষ্ঠান চালু করি আবার বিকেলে আমিই বন্ধ করি আর। কোনো জনবল নেই।

তিনি আরও বলেন, পুরো প্রতিষ্ঠানজুড়ে জঙ্গল হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানের ভিতরে জঙ্গলের কারণে চলাচল করা যায় না। অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো জঙ্গল ভরে যাওয়ায় সাপ-পোকা বাসা বেঁধেছে। টাকার অভাবে জঙ্গল পরিষ্কার করা যাচ্ছে না। ৬ বছর ধরে পলু পালন, রেশম ডিম ও রেশম গুটি উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ। শুধু রেশম শিল্প ও সম্প্রসারণ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২৯ বিঘা জমিতে তুত চারা উৎপাদন চলছে। এসব চারা রেশম উন্নয়ন বোর্ডের নির্দেশনায় বিনামূল্যে বিভিন্ন এলাকায় চাষিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। পলু পোকা পালন, রেশম ডিম ও গুটি উৎপাদনে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এসব কার্যক্রম বন্ধ।

এসকেএম/এনএইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।