জঞ্জালই এখন আয়ের উৎস
বিলে মাছ ধরার সময় এক প্রকার জলজ উদ্ভিদ জঞ্জাল আকারে জালে জড়িয়ে বাধা সৃষ্টি করতো। এই উদ্ভিদের জঞ্জালে বিরক্ত হয়ে অনেক জেলে বিলটিতে মাছ ধরতে আসতেন না। তবে সময় বদলে এই জঞ্জালই এখন স্থানীয় শতাধিক পরিবারের আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে।
শেরপুরের নকলা উপজেলার গণপদ্দি এলাকার পেকুয়া বিলে থাকা এই জঞ্জালগুলোর নাম ‘ঝাই’। তবে আঞ্চলিকভাবে নেওড়া ঘাস, পানি তরুলতা, পাইনসে ঘাস নামেও পরিচিত। শ্যাওলা জাতীয় ভাসমান উদ্ভিদ ‘ঝাই’ বিক্রি করে সংসার চলছে শতাধিক পরিবারের।
স্থানীয় মৎস্য চাষি ও ঝাই ব্যবসায়ীরা জানান, ২১৯ একর আয়তনের পেকুয়া বিলের বেশিরভাগ অংশই ঢেকে আছে ঝাই দিয়ে। মাছ চাষিরা ‘ঝাই’ কিনে খামারে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। রুই, কাতলা, মৃগেল, শিং, মাগুর ও তেলাপিয়া মাছের খাদ্য হিসেবে ঝাই খুব জনপ্রিয়। চাষ করা মাছের সাশ্রয়ী খাবার হিসেবে ঝাই স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

নকলা উপজেলার গণপদ্দি ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুর রফিক। তিনি একসময় পাশের পেকুয়া বিলে মাছ ধরতেন। সেই আয়েই চলত তার সংসার। তবে বিলজুড়ে কচুরিপানা ও ‘ঝাই’ ছড়ানো। এসব জঞ্জালে মাছ ধরার জাল আটকা পড়ে। ফলে মাছ ধরা যায় না। তারপর স্থানীয় মাছচাষিরা বিল থেকে ঝাই সংগ্রহ করে মাছের খামারে ব্যবহার শুরু করে। তা দেখে আব্দুর রফিকও ভ্যানে করে এসব ঝাই বিভিন্ন মৎস্য খামারে বিক্রি শুরু করেন। এখন ঝাই বিক্রির টাকা দিয়েই চলছে তার সংসার।
শুধু আব্দুর রফিক নন, উপজেলার পেকুয়া বিলপাড়ের গণপদ্দি, জালালপুর ও গজারিয়া, এই তিন গ্রামের শতাধিক পরিবার এখন ‘ঝাই’ বিক্রি করে। এ আয়েই চলে তাদের সংসার।
ঝাই ব্যবসায়ী মুত্তালেব, ছামিদুল, রহমান আলী বলেন, আমরা বিল থেকে ঝাই সংগ্রহ করে ভ্যান বোঝাই করি। এক ভ্যান ঝাইয়ের ওজন ৮ থেকে ১০ মণ হয়। আকারভেদে প্রতিভ্যান ঝাই ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিদিন সকাল থেকেই আমরা নৌকা নিয়ে বিলে গিয়ে ঝাই সংগ্রহ করি। নৌকায় ভরে ডাঙায় নিয়ে পানি ঝরিয়ে ভ্যানে ওঠানো হয়। এরপর ফোনে যোগাযোগ করে মাছচাষিদের খামারে পৌঁছে দিয়ে আসি। গত পাঁচ-সাত বছর ধরে এই ঝাই বিক্রি করছি।
বিলপাড়ে নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে ঝাই থেকে, তবে যদি দূরদূরান্তের মাছচাষিদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে ঝাই থেকে আরও বেশি লাভবান হওয়া যাবে বলে দাবি স্থানীয় ঝাই ব্যবসায়ীদের।

গণপদ্দি গ্রামের আবদুর রউফ বলেন, আগে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতাম। একসময় বিলে ঝাই আর কচুরিপানা বাড়ায় মাছ ধরা প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে। পরে বিল থেকে ঝাই তুলে স্থানীয় মাছের খামারিদের কাছে বিক্রি শুরু করি। এখন দিনে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হয়। এখানে অন্যকোনো কাজকর্মের সুযোগ নেই, বেকার বসে চলতে হয়। তাই বিল থেকে ঝাই সংগ্রহ করে বিক্রি করছি, এতে ভালোভাবেই সংসার চলছে।
গজারিয়া গ্রামের সুলতান মিয়া বলেন, আমরা চারজন মিলে দিনে চার ভ্যান ঝাই সংগ্রহ করি। আর এসব ঝাই বিক্রি করে আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা পাওয়া যায়। এ টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চলছে।
স্থানীয় মাছচাষি মনির হোসেন বলেন, পেকুয়া বিলের ঝাই আমার প্রজেক্টের মাছের প্রিয় খাবার। দুই ভ্যান ঝাই দিয়ে চারটি পুকুরের প্রায় ১০ দিনের খাবার হয়ে যায়। এজন্য এখন ফিড কম লাগে। তাছাড়া মাছের রোগব্যাধির সংক্রমণও কম হয়।
স্থানীয় আরেক মাছচাষি আশরাফ আলী বলেন, আগে প্রজেক্টে মাছের খাবার হিসেবে কেবল ফিড ব্যবহার করতাম। খরচ মোটামুটি প্রতি মাসে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকার মতো লাগতো। তবে এখন দুই ভ্যান ঝাই দিলেই সেই চাহিদা পূরণ হয়। এতে খরচ অনেকটা কমে গেছে। আর মোবাইলে জানালে, ঝাই সহজেই ভ্যানবোঝাই করে তারা প্রজেক্টে দিয়ে যায়।
বিভিন্ন উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করছেন অভিজিৎ চক্রবর্তী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ঝাই এক ধরনের ভাসমান সবুজ উদ্ভিদ। এটি বিল বা খালের পানির ওপর চাদরের মতো ভেসে থাকে। এ উদ্ভিদটি পানি ধরে রাখতে সক্ষম। অনেক এলাকায় এটি ‘তরুলতা’ বা ‘জলঢাকনা’ নামেও পরিচিত। বিভিন্ন মাছের এটি প্রিয় খাবার।
নকলা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অনিক রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মাছচাষিরা বিভিন্ন কোম্পানির প্রস্তুতকৃত ফিড মাছের খাবার হিসেবে প্রজেক্টে ব্যবহার করেন। এতে তাদের প্রচুর খরচ হয়। কিন্তু পেকুয়া বিল থেকে সংগ্রহ করা ঝাই স্থানীয়ভাবে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে মাছ চাষিদের ফিডের পরিমাণ অনেকাংশে কম ব্যবহার করতে হচ্ছে। এবং ন্যাচারালি খাবারে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকিও কম। তাই এটি একটি ইতিবাচক দিক। আর অন্যদিকে পেকুয়া বিল সংলগ্ন জেলে ও এলাকাবাসীর বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ঝাইয়ের ব্যাপারে আমরা আরও বিস্তারিত তথ্যের জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি।
এফএ/জেআইএম