স্বীকৃতির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মুক্তিযোদ্ধা জামাল উদ্দিন

মো. কামরুজ্জামান মিন্টু মো. কামরুজ্জামান মিন্টু , জেলা প্রতিনিধি, ময়মনসিংহ
প্রকাশিত: ১১:১৬ এএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবি: মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

যুদ্ধ করেও স্বীকৃতি পাননি এমন বহু মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশে এখনো রয়েছেন। তারা সরকারি দপ্তরে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। শেষ বয়সে স্বীকৃতির আশায় যারা দিন পাড়ি দিচ্ছেন তাদের মধ্যে একজন মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। তিনি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ঢাকুয়া ইউনিয়নের ঢাকুয়া গ্রামের মৃত আফসর উদ্দিনের ছেলে।

১৯৭১ সালে জামাল উদ্দিন নেত্রকোনার দুর্গাপুর কৃষাণ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। কলেজ থেকে পালিয়ে জন্মস্থান ফুলপুরের ঢাকুয়া গ্রামে এসে এলাকার অর্ধশত যুবক ও ছাত্রদের একত্রিত করেন। পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে তাদেরকে নিয়ে প্রথমে ভারতের ঢালু ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দেন। এই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (প্রয়াত সাবেক ধর্মমন্ত্রী)। জামাল উদ্দিনকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তিনিই তুরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন৷ এরপর জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের এতবছর পরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি জামাল উদ্দিন। এজন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বারান্দায় বারান্দায়। ধীরে ধীরে বয়সের ভারে এখন চলাফেরা করতেও কষ্ট হয়। তবুও মৃত্যুর আগে নিজের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় দেখে যেতে পারাটাই তার একমাত্র স্বপ্ন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে জামাল উদ্দিনের। তিনি জানান, ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তিনি। তুরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ৪ নম্বর উইংয়ে ২৭ দিন অস্ত্র প্রশিক্ষণ, দুইদিন জঙ্গল প্যারেড, একদিন কসম প্যারেডসহ জেএল কোর্স সম্পন্ন করেছিলেন। প্রশিক্ষণকালীন উইং কমান্ডার ছিলেন মো. আব্দুর রহিম, সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মো. আব্দুল রহমান। তিনি (জামাল উদ্দিন) প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং একটি এলএমজি সংগ্রহ করেছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে কোম্পানি কমান্ডারের সঙ্গে ঢালু ইয়ুথ ক্যাম্পের পাশে কন্যাডুবি এফএফ ক্যাম্পে অবস্থান করেন। এরপর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তখন শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।

যুদ্ধ করেও স্বীকৃতির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মুক্তিযোদ্ধা জামাল

তিনি বলেন, ‘ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সরচাপুর ব্রিজের কাছে পাক বাহিনীর মর্টার শেলের একটি টুকরা আমার ডান হাতের ওপর বিদ্ধ হয়। তখনই আমি আমার কোম্পানি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমার পেছন থেকে হালিম কোম্পানি কমান্ডার আমাকে সাহায্য করে এবং আমি হালিম কোম্পানিতে যোগ দিয়ে হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত যে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সবগুলোতেই অংশগ্রহণ করি। ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে অবস্থান নেওয়ার পর আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসক এবং ডা. অলিউল্লাহ আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। ৭ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়ে পুনরায় জিলা স্কুল বোর্ডিংয়ে হালিম কোম্পানিতে যোগ দিই এবং সর্বশেষ বেতনভাতা হালিম কোম্পানি থেকেই গ্রহণ করি। যখন ১১ নম্বর সেক্টর ক্লোজ করা হয়, তখন আমাদেরকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন অধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (এম.এ.জি. ওসমানী) স্বাক্ষরিত একটি সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।

দুঃখ প্রকাশ করে জামাল উদ্দিন বলেন, আমি জানতাম মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকায় আমার নাম থাকবে। কিন্তু ১৯৯০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত দলিলে আমার নাম না থাকায় আমি হতাশ হই৷ জেলা কল্যাণ ট্রাস্টের দলিলে উল্লেখ করা আছে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে প্রাপ্ত দলিলের মধ্য থেকে এক হাজার ৭৬টি দলিল বিনষ্ট বা অস্পষ্ট থাকায় সর্বমোট এক হাজার ১২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, আমার নামের দলিল বিনষ্ট বা অস্পষ্ট হয়েছে বলে আমি কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে ২০০৯ সালের ১৭ জুন, ২০১০ সালের ১৩ জুন ও ২০২১ সালের ২৭ জুন তিনটি আবেদন করি। আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আমাকে একটি পত্রও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা আবার স্থগিত করা হয়। এ বিষয়টি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর ২০১০ সালের ১৩ জুন, ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি ও ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আবেদন করি। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) আবেদন করেছিলাম। ভারত সরকারের কাছে প্রশিক্ষণের দলিল চেয়ে ভারতীয় হাই কমিশনার বরাবর ২০১৬ সালের ৯ জুন ও একই বছরের ২২ মে আবেদনের প্রেক্ষিতে ভারতীয় হাই কমিশনারের কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালের ৯ জুন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকায় পরপর দুইটি মেইল পাঠিয়ে আমাকে একটি পত্রের মাধ্যমে অবহিত করা হয়।

তিনি আরও বলেন, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটিতে আমাকে ডাকা হয়। এসময় জামুকার কেন্দ্রীয় কমিটির একজন, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একজন, থানা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের একজন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ৭ সদস্যের কমিটির সবাই উপস্থিত ছিলেন। যাচাই-বাছাই শেষে উপজেলার ১০ জনকে ‘ক’ তালিকাভুক্ত করা হয়। এরমধ্যে আমার নামটির ক্রমিক নম্বর ১ এ রাখা হয়েছিল। এরপর ২০২১ সালের দিকে বিভাগীয় পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের সময় আমাকে ডাকা হয়। তবে এসময়ও আমার নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রস্তাব করা হয়নি। অথচ আমি যাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তাদের অনেকে এখনো জীবিত। একেক জনের এলাকা একেক জায়গায়। তারাও আমার সম্পর্কে বলতে পারবে- কোথায় কীভাবে যুদ্ধ করেছি।

জামাল উদ্দিন বলেন, বর্তমানে বয়সের ভারে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমি যা হারিয়েছি, তা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠাতে জীবনের বাকি সময়টুকু প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে এটা আমার জন্য দুর্ভাগ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্যও কলঙ্ক।

যুদ্ধ করেও স্বীকৃতির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মুক্তিযোদ্ধা জামাল

মুক্তিযুদ্ধের সময় জামাল উদ্দিনের সঙ্গে ভারতের ঢালু ইয়ুথ ক্যাম্পে দেখা হয়েছিল জেলার তারাকান্দা উপজেলার ঢাকুয়া ইউনিয়নের ভাদ্রাকান্দা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমানের। সেদিনের দৃশ্য এখনো চোখে জ্বলজ্বল করে জানিয়ে তিনি বলেন, ঢালু ইয়ুথ ক্যাম্পে ২৫ দিন থাকার সময় অনেকবার আমার সঙ্গে জামাল উদ্দিনের দেখা ও কথা হয়েছে। ক্যাম্পের ইনচার্জ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান আমাকে তুরাতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠান। ২৯ দিনে প্রশিক্ষণ শেষ করলে পরের ধাপে জামাল উদ্দিন তুরাতে প্রশিক্ষণের জন্য যোগ দেন।

তিনি বলেন, জামাল উদ্দিন প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা। অথচ আজও তার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ওঠানো হয়নি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।

একই উপজেলার কামারগাঁও ইউনিয়নের কালিখা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবি সিদ্দিক বলেন, আমি ও জামাল উদ্দিন হালিম কোম্পানিতে ছিলাম। একসঙ্গে তুরাতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। ভারতের তালিকায় আমার নাম আসার কারণে আমি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছি। কিন্তু ভারতের তালিকায় অনেকের নাম আসেনি, ফলে জামাল উদ্দিনের মতো অনেকে এখন পর্যন্ত সরকারি কাগজে-কলমে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেনি!

একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মুসলেম উদ্দিন সরকার। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তারাকান্দা উপজেলা সমন্বয় কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, তুরা ক্যাম্পে আমি প্লাটুন কমান্ডার ছিলাম৷ আমার সঙ্গে জামাল উদ্দিন ছিলেন হালিম কোম্পানিতে। আমরা একসঙ্গে ছিলাম।

তিনি আরও বলেন, সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেবে এটা অনেকেই ভাবাতেন না। কারণ ভাতা পাওয়ার জন্য জীবন বাজি রেখে কেউ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। সরকারিভাবে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আমাদেরকে সম্মান জানানো হয়েছে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পরও যেন পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারেন তিনি দেশকে ভালোবেসে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেজন্য হলেও তালিকা থেকে বাদ পড়া জামাল উদ্দিনসহ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম সরকারি তালিকায় ওঠানো প্রয়োজন।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার সংশোধন করা হয়েছে। অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন কৌশলে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিলেন। কিন্তু এখনো অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নিজের নামটি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় দেখতে পাচ্ছেন না। তাদের মধ্যে একজন জামাল উদ্দিন। তিনি এখন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। দেশের জন্য যুদ্ধ করে এখন স্বীকৃতির জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেজা মো. গোলাম মাসুম প্রধান বলেন, জামাল উদ্দিন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কি না এবং মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম ওঠানো যেতে পারে কি না, তা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করবে।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সহকারী পরিচালক (ময়মনসিংহ বিভাগের মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত) মোসা. জেসমিন আক্তার বলেন, জামাল উদ্দিন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কি না তা আমার জানা নেই। কেন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম ওঠেনি তা কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।