সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ

তিন চিকিৎসকের কাঁধে সাড়ে ৩ লাখ মানুষের ভার

আহসানুর রহমান রাজিব
আহসানুর রহমান রাজিব আহসানুর রহমান রাজিব , সাতক্ষীরা সাতক্ষীরা
প্রকাশিত: ০৪:৪৫ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৫০ শয্যার এই হাসপাতালটি উপজেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের একমাত্র সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র। দীর্ঘদিনের চিকিৎসক সংকট ও অব্যবস্থাপনার কারণে কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কার্যত অচল অবস্থায় রয়েছে। ৩৪ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৩ জন। বন্ধ আছে ডেন্টাল বিভাগ, রেডিওগ্রাফি ও অপারেশন থিয়েটার (ওটি)।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে একমাত্র অ্যাম্বুলেন্সটিও। ফলে চিকিৎসা না পেয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ, আর হাসপাতালটি পরিণত হয়েছে শুধুই একটি ‘রেফার সেন্টারে’।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে কনসালট্যান্ট, মেডিকেল অফিসার, নার্স, টেকনিশিয়ান ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীসহ মোট ১৬৮ জন জনবল থাকার কথা। চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদ ৩৪টি। অথচ সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে নিয়মিত রোগী দেখছেন মাত্র তিনজন চিকিৎসক। এর বাইরে একজন সিনিয়র চিকিৎসক সপ্তাহে মাত্র দুই দিন রোগী দেখেন। অপর একজন চিকিৎসক সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে প্রেষণে থাকায় কালিগঞ্জে আসেন না।

আরও পড়ুন:
‘ডাক্তার হঠাৎ এলেও দালাল আসে নিয়মিত’
চার ডাক্তার দিয়ে চলছে ২ লাখ মানুষের হাসপাতাল!

চিকিৎসক না থাকলেও হাসপাতালে ২৫ জন স্টাফ নার্স, মিডওয়াইফ, টেকনোলজিস্ট, ওয়ার্ড বয়, আয়া ও মালিসহ প্রায় সব কর্মচারী নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন। তবে চিকিৎসকের নির্দেশনার অভাবে তাদের নিয়মিত দায়িত্বপালন করা সম্ভব হচ্ছে না। জনবলের এই অসম বণ্টনের কারণে একদিকে সরকারের অর্থের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ।

হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ডেন্টাল ইউনিট, রেডিওগ্রাফি বিভাগ ও অপারেশন থিয়েটার (ওটি) তালাবদ্ধ। ধুলো জমে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রপাতি। এক্স-রে বা আল্ট্রাসনোগ্রামের মতো মৌলিক পরীক্ষাগুলোও এখানে করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া জরুরি রোগীদের পরিবহনের জন্য থাকা একমাত্র সরকারি অ্যাম্বুলেন্সটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। ফলে স্ট্রোক বা দুর্ঘটনার মতো মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে স্বজনদের বিপাকে পড়তে হয়।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তার দেখানোর সুযোগ মিললেও জুটছে না সঠিক চিকিৎসা। জটিল বা মুমূর্ষু রোগী এলেই প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে সরাসরি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজে ‘রেফার’ করে দেওয়া হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই রেফার্ড প্রক্রিয়ার আড়ালে সময়ক্ষেপণ করা হয়, যার ফলে পথেই অনেক রোগীর মৃত্যু বা অবস্থার অবনতি ঘটে।

অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল চত্বর ও এর আশপাশে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালাল চক্র। অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে দেওয়া বা দ্রুত ভালো চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যাচ্ছে এই চক্রটি। এতে রোগীরা আর্থিকভাবে নিঃস্ব হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালের সীমিত সেবার সুযোগে এলাকায় বেসরকারি ক্লিনিকের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন।

আরও পড়ুন:
উপকূলের লবণাক্ত মাটিতে নতুন আশা ‘বিনা ধান-১০’
পর্যটন মৌসুমে নির্জন সুন্দরবন, সাতক্ষীরা রেঞ্জে শুধুই হতাশা

চিকিৎসা নিতে আসা হাসান আলী নামের এক ভুক্তভোগী রোগী বলেন, অনেক কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখালাম। কিন্তু ফার্মেসিতে গেলে প্যারাসিটামল আর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ছাড়া কিছুই দেয় না। অ্যান্টিবায়োটিক বা দামি ওষুধ সব বাইরে থেকে কিনতে হয়। নামেই এটা সরকারি হাসপাতাল, কাজের কিছুই না।

শহিদুল ইসলাম নামে এক রোগী বলেন, প্রেসক্রিপশনে লেখা তিনটি ওষুধের মধ্যে শুধু একটি দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।

তিন চিকিৎসকের কাঁধে সাড়ে ৩ লাখ মানুষের ভার

হাসপাতালের ফার্মেসিতে রোগীদের দেওয়া প্রেসক্রিপশন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তালিকাভুক্ত একাধিক ওষুধ ‘স্টকে নেই’ উল্লেখ করে দেওয়া হয়নি। অথচ একই ওষুধ হাসপাতালের পাশের কয়েকটি ফার্মেসিতে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে বলে রোগীরা অভিযোগ করেন।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা একাধিক রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা বা পরীক্ষা ছাড়াই রোগীকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে রেফার্ডের কাগজ পেতে দীর্ঘসময় লেগে যাচ্ছে ও রোগীর অবস্থা আরও অবনতি হচ্ছে।

স্থানীয়দের দাবি, অনতিবিলম্বে কালিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শূন্য পদে চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। বন্ধ থাকা অপারেশন থিয়েটার ও এক্স-রে বিভাগ চালু এবং অ্যাম্বুলেন্সটি মেরামত করতে হবে। একইসঙ্গে হাসপাতাল চত্বর থেকে দালাল চক্র উৎখাত করে অনিয়ম বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে জনস্বাস্থ্য চরম ঝুঁকির মুখে পড়বে।

কালিগঞ্জের নাগরিক নেতা অ্যাডভোকেট জাফর উল্লাহ ইব্রাহিম জাগো নিউজকে বলেন, সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, সাড়ে তিন লাখ মানুষের জন্য মাত্র তিনজন ডাক্তার। রোগীরা এখানে এসে প্রতারিত হচ্ছেন। কোনো চিকিৎসা না দিয়ে শুধু ‘রেফার্ড’ করে হাজার হাজার টাকা নষ্ট করানো হচ্ছে। দালালদের খপ্পরে পড়ে সাধারণ মানুষ আজ দিশেহারা।

কালিগঞ্জ উপজেলা ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রূপা রানী পাল জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের চিকিৎসক সংকট রয়েছে। ৩৪ জন চিকিৎসকের জায়গায় আমিসহ মাত্র তিনজন দিয়ে হাসপাতাল চালানো হচ্ছে। প্রতিদিন শতশত রোগীর চাপ সামলানো আমাদের জন্য অমানবিক হয়ে পড়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। নতুন চিকিৎসক পদায়ন করা হলে সেবার মান উন্নত হবে বলে আশা করছি।

সার্বিক বিষয়ে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুস সালাম জাগো নিউজকে বলেন, কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি আমরা অবগত আছি। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, চিকিৎসক সংকটের কারণে কিছু বিভাগ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে, এটা সত্য। তবে আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব শূন্য পদগুলো পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। নতুন পদায়ন ও সংযুক্তির মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

দালাল চক্র ও রোগী হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে সিভিল সার্জন বলেন, সরকারি হাসপাতাল চত্বরে দালালচক্র সক্রিয় থাকার অভিযোগ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এমএন/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।