বিবিসির অনুসন্ধান
ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় তহবিল সংগ্রহে প্রতারণা
একটি ছোট ছেলে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। তার গায়ের রং ফ্যাকাশে, মাথায় চুল নেই। সে বলছে, ‘আমার বয়স সাত বছর এবং আমার ক্যানসার হয়েছে। দয়া করে আমার জীবন বাঁচান এবং আমাকে সাহায্য করুন।’
ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে তার নাম খালিল। সে এই ভিডিও ধারণ করতে চায়নি, বলছেন খলিলের মা আলজিন। তাকে বলা হয়েছিল, ছেলের মাথার চুল কামিয়ে দিতে। এরপর একটি চলচ্চিত্র দলের সদস্যরা তাকে নকল স্যালাইন লাগিয়ে দেয় এবং পরিবারকে বলা হয়েছিল যেন জন্মদিনের অভিনয় করে। তাকে ইংরেজিতে শেখানো একটি স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করে বলতে বলা হয়েছিল।
আলজিন বলছেন, খলিলের চোখে পানি আনার জন্য তার পাশে পেঁয়াজ রাখা হয়েছিল এবং চোখের নিচে মেনথল লাগানো হয়েছিল— যা তার মোটেই ভালো লাগেনি।
আলজিন এতে রাজি হয়েছিল কারণ সেটআপটি নকল হলেও খলিল সত্যিই ক্যানসারে আক্রান্ত ছিল। তাকে বলা হয়েছিল, এই ভিডিওর মাধ্যমে ভালো চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হবে। সত্যি অর্থ সংগ্রহও হয়েছিল— খলিলের নামে পাওয়া একটি প্রচারণা অনুযায়ী এর পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ডলার।
আরও পড়ুন>>
পরীক্ষায় সফল রাশিয়ার ক্যানসার ভ্যাকসিন, বাস্তব প্রয়োগের অপেক্ষা
স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে স্ক্রিনিং শুরু করবেন কোন বয়সে
বছরে প্রতি লাখে নতুন করে ক্যানসার আক্রান্ত হয় ৫৩ জন
কিন্তু আলজিনকে জানানো হয়েছিল, প্রচারণাটি ব্যর্থ হয়েছে এবং তিনি এই অর্থের কিছুই পাননি— শুধু ৭০০ ডলার শুটিং ফি পেয়েছিলেন সেদিন। এক বছর পর খলিল মারা যায়।
বিশ্বজুড়ে অসুস্থ বা মৃত্যুপথযাত্রী শিশুদের অভিভাবকদের অনলাইন প্রতারণামূলক প্রচারণার মাধ্যমে শোষণ করা হচ্ছে বলে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অনুসন্ধানে জানা গেছে।
জনসাধারণ এমন সব প্রচারণায় অর্থ দিয়েছেন, যেগুলোতে দাবি করা হয়েছিল— জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
বিবিসি এরকম ১৫টি পরিবারকে চিহ্নিত করেছে, যারা বলছেন, তারা সংগৃহীত অর্থের সামান্য অংশও পাননি এবং অনেক সময় জানতেনই না যে তাদের নামে প্রচারণা চালানো হয়েছে, যদিও তারা মর্মস্পর্শী ভিডিও ধারণে অংশ নিয়েছিলেন।
বিবিসি আই ইনভেস্টিগেশনস যে নয়টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে— যাদের প্রচারণা একই প্রতারণা চক্রের অংশ বলে মনে হচ্ছে। তারা বলছেন, তাদের নামে সংগৃহীত চার মিলিয়ন ডলার (৪০ লাখ) অর্থের কিছুই তারা পাননি।
এই নেটওয়ার্কের একজন হুইসেলব্লোয়ার বলেছেন, তারা খুঁজতেন ‘সুন্দর শিশু’, যারা ‘তিন থেকে নয় বছরের মধ্যে… মাথায় চুল থাকবে না’।
এই প্রতারণার মূল ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি কানাডায় বসবাসরত একজন ইসরায়েলি নাগরিক, নাম এরেজ হাদারি।
বিবিসির এই অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের অক্টোবরে, যখন একটি বেদনাদায়ক ইউটিউব বিজ্ঞাপন নজরে আসে।
‘আমি মরতে চাই না,’ কান্নায় ভেঙে পড়ে বলছিল ঘানার এক মেয়ে আলেকজান্দ্রা, ‘আমার চিকিৎসার খরচ অনেক।’
তার জন্য একটি ক্রাউডফান্ডিং প্রচারণায় প্রায় সাত লাখ ডলার সংগ্রহ করা হয় বলে মনে হয়েছিল।
ইউটিউবে এমন আরও অসুস্থ শিশুদের ভিডিও দেখা যায়, যার সবগুলোই আশ্চর্যজনকভাবে একই রকম— ঝকঝকে প্রযোজনা এবং মনে হচ্ছিল বিপুল অর্থ সংগ্রহ করেছে। সবগুলোতেই আবেগপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে জরুরি আকুতি প্রকাশ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক পরিসরের প্রচারণাগুলো চালানো হচ্ছিল চান্স লেটিকভা (ইংরেজিতে চান্স ফর হোপ) নামে একটি সংস্থার মাধ্যমে, যা ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত।
যেসব শিশুকে দেখানো হচ্ছিলো তাদের চিহ্নিত করা কঠিন ছিল। বিবিসি জিওলোকেশন, সামাজিক মাধ্যম এবং মুখ শনাক্তকরণ সফটওয়্যার ব্যবহার করে তাদের পরিবারকে খুঁজে পায়। এরা কলম্বিয়া থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত অর্থের পরিমাণ সত্য কি না তা নিশ্চিত করা কঠিন ছিল। তবে বিবিসির টিম দুটি প্রচারণায় সামান্য অর্থ দান করে এবং দেখতে পায় সেই পরিমাণ যোগ হয়েছে।
বিবিসি এমন একজনের সঙ্গেও কথা বলেছিল, যিনি জানান, তিনি আলেকজান্দ্রার প্রচারণায় ১৮০ ডলার দিয়েছিলেন, এরপর তাকে আরেও অর্থ দেওয়ার অনুরোধে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল— সবগুলোই এমনভাবে লেখা ছিল যেন আলেকজান্দ্রা ও তার বাবার পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে।
ফিলিপিন্সে আলজিন তাবাসা আমাদের বলেছেন, তার ছেলে খলিল তার সপ্তম জন্মদিনের পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ‘যখন জানতে পারলাম ক্যানসার হয়েছে, মনে হলো আমার পুরো পৃথিবী ভেঙে গেছে,’ তিনি বলছেন।
আলজিন বলছেন, তাদের শহর সেবুর স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা ধীরগতির ছিল এবং তিনি যাকে পারতেন সবাইকে সাহায্যের জন্য বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
একজন তাকে স্থানীয় ব্যবসায়ী রোই ইনসিয়ের্তোর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন— যিনি খলিলের একটি ভিডিও চেয়েছিলেন, যা মূলত একটি অডিশন ছিল বলে এখন আলজিন বুঝতে পারছেন।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে কানাডা থেকে আরেকজন ব্যক্তি এসে নিজেকে ‘এরেজ’ বলে পরিচয় দেন। আলজিন বলছেন, তিনি আগেই শুটিং ফি পরিশোধ করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে ভিডিও থেকে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ হলে প্রতি মাসে আরও দেড় হাজার ডলার করে দেবেন।
এরেজ স্থানীয় একটি হাসপাতালে খলিলের ভিডিওটির পরিচালনা করেন, বারবার রিটেকের নির্দেশ দেন— শুটিংয়ে ১২ ঘণ্টা লেগেছিল, আলজিন বলছেন।
কয়েক মাস পরও পরিবার জানতে পারেনি ভিডিওটি কেমন ফলাফল করেছে। আলজিন এরেজকে বার্তা পাঠালে তিনি জানান ভিডিওটি ‘সফল হয়নি’। ‘এর মধ্য দিয়ে আমি বুঝেছিলাম ভিডিও থেকে কোনো অর্থই আসেনি,’ তিনি বলছেন।
কিন্তু বিবিসি তাকে জানায়, ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রচারণায় প্রায় ২৭ হাজার ডলার সংগ্রহ হয়েছে এবং সেটি এখনো অনলাইনে রয়েছে।
‘যদি আমি জানতাম আমরা এত অর্থ সংগ্রহ করেছি, মনে হয় খালিল আজও বেঁচে থাকতো,’ আলজিন বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি না তারা কীভাবে আমাদের সঙ্গে এমন করলো।’
শুটিংয়ে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রোই ইনসিয়ের্তো অস্বীকার করেন যে, তিনি পরিবারগুলোকে শুটিংয়ের জন্য সন্তানের মাথার চুল কামাতে বলেছেন এবং দাবি করেন পরিবার সংগ্রহের জন্য তিনি কোনো অর্থ পাননি।
তিনি বলেন, অর্থের কী হয়েছে সে বিষয়ে তার ‘কোনো নিয়ন্ত্রণ’ ছিল না এবং শুটিংয়ের দিন ছাড়া পরিবারগুলোর সঙ্গে তার আর কোনো যোগাযোগ ছিল না।
যখন আমরা তাকে জানাই পরিবারগুলো প্রচারণার অর্থের কিছুই পায়নি, তিনি বলেন তিনি ‘হতবাক’ এবং ‘পরিবারগুলোর জন্য খুবই দুঃখিত’।
‘চান্স লেটিকভা’র নিবন্ধন নথিতে এরেজ নামে কেউ নেই। তবে যে দুটি প্রচারণা তদন্ত করা হযেছে, সেগুলো আরেকটি সংস্থা ওয়ালস অফ হোপ দিয়ে প্রচারিত হয়েছে— যা ইসরায়েল এবং কানাডায় নিবন্ধিত। নথিতে কানাডার পরিচালক হিসেবে এরেজ হাদারির নাম রয়েছে।
অনলাইনে তার ছবি দেখা যায় ফিলিপাইন, নিউইয়র্ক এবং মিয়ামিতে ইহুদি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। বিবিসি আলজিনকে ছবি দেখালে তিনি বলেন, এ সেই একই ব্যক্তি যাকে তিনি দেখেছিলেন।
এ বিষয়ে হাদারিকে ফিলিপাইনের প্রচারণায় সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
বিবিসি আরও কয়েকটি পরিবার পরিদর্শন করেছে যাদের প্রচারণা হয় হাদারির মাধ্যমে আয়োজিত, নয়তো তার সঙ্গে যুক্ত। একটি ছিল কলম্বিয়ার প্রত্যন্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ে, আরেকটি ইউক্রেনে।
খলিলের ঘটনার মতোই স্থানীয় মধ্যস্থতাকারীরা সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে যোগাযোগ করেছিল। শিশুদের ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল এবং তাদের কান্না করতে বা নকল কান্না দেখাতে বলা হয়েছিল সামান্য অর্থের বিনিময়ে, কিন্তু তারা আর কোনো অর্থ পায়নি।
কলম্বিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সুক্রে এলাকার সার্জিও কেয়ার বলেন, তিনি প্রথমে এই সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছিলেন। তার দাবি, ইসাবেল নামে একজন ব্যক্তি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, যিনি আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দেন যখন তার আট বছর বয়সী মেয়ে আনা ম্যালিগন্যান্ট ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হয়।
সার্জিও বলেন, কিন্তু ইসাবেল তাকে খুঁজতে আসেন সেই হাসপাতালে যেখানে আনার চিকিৎসা হচ্ছিল, সঙ্গে ছিলেন একজন ব্যক্তি যিনি নিজেকে আন্তর্জাতিক এনজিওর কর্মী বলে পরিচয় দেন।
সার্জিও যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এরেজ হাদারির সঙ্গে মিলে যায়, এরপর তিনি আমাদের দেখানো ছবিতে তাকে চিনতে পারেন। ‘তিনি আমাকে আশা দিয়েছিলেন... আমার ভবিষ্যতের জন্য কোনো অর্থ ছিল না।’
শুটিংয়ের পরও পরিবারের ওপর চাপ শেষ হয়নি। ইসাবেল বারবার ফোন করতেন বলে সার্জিও বলেছেন, হাসপাতালে আনার আরও ছবি চাইতেন তিনি। সার্জিও উত্তর না দিলে ইসাবেল সরাসরি আনাকে বার্তা পাঠানো শুরু করেন।
আনা ইসাবেলকে বলেছিল, তার কাছে আর কোনো ছবি নেই। ইসাবেল জবাব দেন, ‘এটা খুবই খারাপ আনা, সত্যিই খুব খারাপ।’
এখন সম্পূর্ণ সুস্থ আনা। এই বছরের জানুয়ারিতে সে জানতে চেয়েছিল, প্রতিশ্রুত অর্থের কী হয়েছে।
‘ওই ফাউন্ডেশন উধাও হয়ে গেছে,’ ইসাবেল তাকে একটি ভয়েস নোটে বলেন, ‘তোমার ভিডিও কখনো আপলোড করা হয়নি। কখনো না। কিছুই করা হয়নি, শুনছো?’
কিন্তু আমরা দেখতে পেয়েছি ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছে এবং ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার সংগ্রহ করেছে।
অক্টোবরে বিবিসি ইসাবেল হার্নান্দেজকে ভিডিও লিংকে কথা বলতে রাজি করায়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ইসরায়েল থেকে একজন বন্ধু তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এমন একজনের সঙ্গে, যিনি ‘একটি ফাউন্ডেশনের’ জন্য কাজের প্রস্তাব দিয়েছিলেন—যার লক্ষ্য ছিল ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের সাহায্য করা। তিনি কার জন্য কাজ করেছেন, তা বলতে অস্বীকার করেন।
তার দাবি, তিনি যে প্রচারণাগুলোতে সাহায্য করেছিলেন, তার মধ্যে মাত্র একটি প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেটি সফল হয়নি।
আমরা ইসাবেলকে দেখাই যে, আসলে দুটি প্রচারণা আপলোড করা হয়েছে—এর মধ্যে একটি প্রায় সাত লাখ ডলার সংগ্রহ করেছে বলে মনে হয়।
‘আমাকে (পরিবারগুলোর কাছে) ক্ষমা চাইতে হবে,’ তিনি বলেন, ‘যদি আমি জানতাম কী ঘটছে, আমি কখনো এমন কিছু করতে পারতাম না।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা
কেএএ/