সুস্বাদু আর পুষ্টি গুণে ভরপুর নরসিংদীর লটকন


প্রকাশিত: ১১:৫২ এএম, ১১ জুলাই ২০১৬

লটকন, ফলটির নাম শুনলেই যেন জিভে জল চলে আসে। নরসিংদীর শিবপুর ও বেলাবো উপজেলার চাষিদের কাছে অর্থকরী ফসল এটি। তেমন কোনো পরিচর্চা ছাড়াই উৎপাদিত হয় এ ফল। তাই ক্রমেই অর্থকরী ফসল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে এ অঞ্চলের চাষিদের কাছে।

সুস্বাদু আর পুষ্টিগুণে ভরপুর এখানকার লটকন স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে বিদেশে। আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। স্বল্প ব্যয় আর অল্প পরিচর্চায় অভাবনীয় ফলন আসায় বাণিজ্যিকভাবে দিন দিন বাড়ছে লটকন চাষের জনপ্রিয়তা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলার শিবপুর, বেলাবো ও রায়পুরা উপজেলায় লাল রঙের উঁচু জমিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান থাকায় এই এলাকার মাটি লটকন চাষের জন্য খুব উপযোগী। গত বছর ৫৮০ হেক্টর জমিতে লটকনের চাষ হয়েছিল। চলতি বছর জেলার ৬২৫ হেক্টর জমিতে লটকনের আবাদ হয়েছে।

Narsingdi-Latcon

বাণিজ্যিক চাষ ছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও পতিত জমিতেও লটকন গাছ রয়েছে, যা কৃষি বিভাগের হিসাবের অন্তর্ভুক্ত নয়।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে সাড়ে ১৬ মেট্রিক টন লটকন উৎপাদিত হচ্ছে। নরসিংদীর পাশাপাশি সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাজীপুর জেলায়ও লটকনের চাষ হচ্ছে। অঞ্চলভিত্তিক এর বেশ কিছু স্থানীয় নাম রয়েছে।

চট্টগ্রামে এর নাম হাড়ফাটা, সিলেটবাসী চেনে ডুবি নামে, ময়মনসিংহে বলে কানাইজু। আঙুরের মতো থোকায় থোকায় ধরে বলে ইংরেজিতে এর নাম Burmese grap। বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea sapida।

কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের নরসিংদীর শিবপুর আঞ্চলিক উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ কে এম আরিফুল হক বলেন, লটকনের স্বাদ অম্লমধুর এবং পুষ্টিমান প্রচুর। লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-২, ভিটামিন-সি রয়েছে। এছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আমিষ, স্নেহ লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। রোজ আমাদের দেহের জন্য যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন চারটি লটকনে সেই চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট।

Narsingdi-Latcon

নরসিংদীর শিবপুর, বেলাবো ও রায়পুরা উপজেলার বিশাল অঞ্চল লাল মাটির টিলাময়। গ্রামের ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে ছায়াঘেরা লটকন বাগান। বাগানের অধিকাংশ গাছ গোড়ালি থেকে উপরি অংশের শাখা-প্রশাখায় লটকন ফলে জড়িয়ে আছে। দেখতে মনে হয় যেন পুরো গাছে লটকনের ফুল ফুটছে।

লটকন চাষী শিবপুরের জয়নগর আলহাজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক ললিত রায় বলেন, আজ থেকে ১২-১৪ বছর আগে গ্রামের লোকজন শখের বসে বাড়ির আঙ্গিনায় লটকনের চারা লাগায়। দেখতে সুন্দর ও খেতে সুস্বাধু হওয়ায় ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় লাভজনক ফলন হিসেবে লটকনের চাষের ব্যাপক প্রসার হয়েছে।

একই গ্রামের লটকন চাষি রাকিবুল হাসান বলেন, চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলের কারণে লটকনের ফলন ভালো হয়েছে। সাধারণত একটি পূর্ণ বয়স্ক লটকন গাছে ৫ থেকে ৭ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

মৌসুমি ফসলের মধ্যে শুধু সৌন্দর্য ও স্বাদে নয় লটকন নিরাপদও বটে। কারণ লটকন বাজারজাতে কোনো ক্ষতিকর ফরমালিন ব্যবহার করা হয় না। ফলে সচেতন সব বয়সী মানুষের মধ্যে লটকনের চাহিদা বাড়ছে। তাই লটকনের বাজারজাত নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই চাষিদের। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লটকন কাঁচা থাকা অবস্থায় বাগান থেকে কিনে নেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাকা লটকন বাগান থেকে সংগ্রহ করে পাইকারি বাজারে বিক্রি করেন।

মৌসুমি ব্যবসায়ী আবদুল হক বলেন, গত ৫ বছর ধরে আমরা চারজন অংশীদার মিলে লটকনের মৌসুমে বাগান কিনে ব্যবসা করছি। এবারো চার লাখ টাকায় তিনটি বাগান কিনেছি। এতে দুই লাখ টাকা লাভের আশা করছি।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরা উপজেলার মরজাল বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে আশপাশের গ্রাম থেকে চাষিরা ঝুড়িতে লটকন নিয়ে ভ্যানে বাজারে ভিড় করছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে লটকন কিনে প্রথমে ঝুড়িতে সাজাচ্ছে এরপর তা ট্রাকে ভর্তি করছে।

Narsingdi-Latcon

বাজারে কথা হয় পার্শ্ববর্তী শিবপুর উপজেলার ছোটাবন গ্রাম থেকে লটকন নিয়ে আসা চাষি আবদুল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, দেশ-বিদেশে কদর বাড়ার কারণে এবার হাটে লটকনের চাহিদা বেশ। প্রকারভেদে দেড় হাজার থেকে চার হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে, যা খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চার কানি জমি থেকে খরচ বাদ দিয়ে দুই লাখ টাকা মুনাফার আশা করছি।

নরসিংদী থেকে রাজধানীর শ্যামবাজারে পাইকারি লটকন বিক্রি করেন আলতাফ হোসেন। তিনি জানান, নরসিংদীর লটকন দেখতে বড় ও খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ঢাকার বাজারে এর চাহিদা ব্যাপক। প্রতিদিন এ বাজার থেকে তিনি ৩০ থেকে ৪০ মণ লটকন কিনছেন। জুনের প্রথম দিক থেকে শুরু হওয়া এ লটকনের বাজার চলবে জুলাইয়ের পুরো মাস।

লটকন ফরমালিনমুক্ত। সাধারণত দুই দিন তার সৌন্দর্য অক্ষুণ্ন থাকে। সৌন্দর্য ও স্বাদ অক্ষুণ্ন রেখে কীভাবে লটকন দীর্ঘস্থায়ী সংরক্ষণ করা নিয়ে গবেষণা চলছে জানিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, লটকনে রোগ-বালাইয়ের তেমন সংক্রমণ না হওয়ায় উৎপাদন খরচ কম ও ফলনও ভালো।

সবচেয়ে ভালো মানের লটকন মধ্যপ্রাচ্য, লন্ডন ও ইউরোপে রফতানি হচ্ছে। এতে লটকনের ন্যায্যমূল্যও পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণে নরসিংদীতে প্রতিদিনই লটকন চাষের প্রসার ঘটছে।

এআরএ/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।