‘মে আই হেল্প ইউ’ বলে হয়রানি করছে বিএসএফ
আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট বেনাপোল দিয়ে ভারতে যাতায়াতকারী পাসপোর্টধারীযাত্রীরা পদে পদে ব্যাপক হয়রানি আর অর্থদণ্ডের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পেট্রাপোল চেকপোস্টে কাস্টমস ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্যরা এই হয়রানি করছেন। তবে পেট্রাপোল নোম্যান্সল্যান্ডে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ সদস্যদের হয়রানি নজিরবিহীন।
সর্বশেষ বুধবার (২২ এপ্রিল) সকালে হাসুরা বেগম (৩৪) নামে এক বাংলাদেশি নারী পাসপোর্টযাত্রীকে পিটিয়ে আহত করে বিএসএফ। মারাত্মক আহত হাসুরাকে অজ্ঞান অবস্থায় ভ্যানযোগে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। তার অবস্থার অবনতি হলে স্থানীয় লোকজন তাকে দ্রুত চিকিৎসা দিতে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
আহত হাসুরা বেগম যশোর শহরের চাঁচড়া ডাল মিল এলাকার জামাল শেখের স্ত্রী। তার পাসপোর্ট নাম্বার বিসি-০৬৩৬৪৮২।
হাসুরার ছোট বোন টুনি বেগম (৩৫) জানান, তারা বুধবার সকালে পাসপোর্ট যোগে ভারত থেকে পেট্রাপোল চেকপোস্ট দিয়ে দেশে ফিরছিল। পেট্রাপোল নোম্যান্সল্যান্ডে ভারতীয় বিএসএফ সদস্যরা এসময় তাদের পেট্রাপোল বিএসএফ ক্যাম্পে নিয়ে মালামাল তল্লাশির এক পর্যায়ে কোনো কারণ ছাড়াই হাসুরাকে পিটিয়ে আহত করে। এ ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে বাংলাদেশি নারী পাসপোর্টযাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় বিএসএফের কাছে প্রতিবাদ জানানো হয়।
ভুক্তভোগী পাসপোর্টধারী যাত্রীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক এই চেকপোস্টে এর আগে কখনও তারা এ রকম হয়রানির শিকার হননি। হয়রানির শিকার হয়ে যাত্রীরা কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালেও তা কোনো কাজে আসছে না। ফলে তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বেনাপোল দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক ও সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর। এই বন্দরের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল স্থলবন্দর। এপারে বেনাপোল পুলিশ ইমিগ্রেশন এবং ওপারে হরিদাসপুর ইমিগ্রেশন, যা বাংলাদেশের সকল স্থলবন্দরের তুলনায় উন্নত। কলকাতার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগও খুবই ভালো। বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা শহরের দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিমি। ঢাকা থেকে বেনাপোল আসতে ৬ ঘণ্টা আর বেনাপোল থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা শহরে পৌঁছানো যায়। তাছাড়া এ পথে ভারত-বাংলাদেশ যাতায়াতে খরচটা একেবারেই কম। বেনাপোলের ওপার থেকে মাত্র ২০ রুপীতে কলকাতায় পৌঁছানো যায়। আবার কলকাতা থেকেও অল্প টাকায় ফিরে আসা যায় বাংলাদেশে। এ কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে সব যাত্রী যায় তার সিংহভাগ যায় এই পথ দিয়ে। যাতায়াতকারী যাত্রীরা উভয় দেশের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার সময় সীমান্তের কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, পুলিশ, বিজিবি ও বিএসএফের সদস্যের হাতে পদে পদে হয়রানি আর অর্থদণ্ডের শিকার হয়।
একটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত চেকপোস্টে এ রকম অর্থদণ্ড আর হয়রানির শিকার হয়ে যাত্রীরা নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছায়। বর্তমানে যাত্রীরা এ রকম হয়রানি আর অর্থদণ্ডের শিকার হচ্ছে বেনাপোল ও পেট্রাপোল চেকপোস্টে।
সরেজমিন বেনাপোল ও পেট্রাপোল বন্দর ঘুরে একাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্টে নোম্যান্সল্যান্ডে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী যাত্রীরা হয়রানি ও অর্থদণ্ডের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন ভারতীয় বিএসএফের হাতে। বিএসএফের সদস্যরা ভারত থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশি যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশির নামে নো-ম্যান্সল্যান্ডে ব্যাপক হয়রানি করতে দেখা গেছে।
একজন যাত্রী চিকিৎসা কিংবা ব্যবসায়ীক কাজ শেষে বাংলাদেশে আসার পথে বিএসএফ সদস্যরা অবৈধ মালামাল আছে সন্দেহে যাত্রীর ব্যাগ আটকে দেয়। এরপর সড়কের উপর তাদের ব্যাগ খুলে ব্যাগে থাকা মালামাল মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। প্রতিবাদ করলে ব্যাগেজসহ পাসপোর্টযাত্রীদের ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনও করে থাকে। এরকম ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে নো-ম্যান্সল্যান্ডে।
সম্প্রতি কয়েক যাত্রী ভারতে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার সময় নোম্যান্সল্যান্ডে এ রকম হয়রানির শিকার হন।
একাধিক ভুক্তভোগী পাসপোর্টধারী যাত্রী জানান, শুধু বিএসএফ সদস্যরা নয়, উভয় বন্দরে নিয়োজিত কাস্টমস, পুলিশ, দালাল, মাস্তানের হাতে তারা হয়রানি আর অর্থদণ্ডের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ভারতের পেট্রাপোলে কখনও কখনও যাত্রীরা শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হন। এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে কয়েক মাস আগে নোম্যান্সল্যান্ডে।
বাংলাদেশ থেকে ইয়াকুব আলী নামে এক ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী ভারতে প্রবেশের পর বিএসএফ সদস্যরা কোনো কারণ ছাড়াই তাকে ব্যাপক মারপিট করে। এ ঘটনায় ইয়াকুব আলী নোম্যান্সল্যান্ডে ডিউটিরত বিজিবির সাহায্য চাইলে তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন বলে ইয়াকুবের পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়। পরে ইয়াকুবের আত্মীয়স্বজন বিষয়টি বাংলাদেশের পুলিশ ইমিগ্রেশনকে জানালে তারাও কোনো উপকারে আসেনি। পরে ব্যবসায়ীরা আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দিলে দুঃখ প্রকাশ করে বিএসএফ।
জানা গেছে, কয়েক মাস আগে নো-ম্যান্সল্যান্ডে পাসপোর্টধারী যাত্রীদের সেবা দেয়ার নামে একটি টংঘর তৈরি করেছে বিএসএফ। তাতে লেখা আছে ‘মে আই হেল্প ইউ।’ কিন্তু সাহায্যের নাম করে সেই থেকে চেকিং আর হয়রানির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বিএসএফ। ‘মে আই হেল্প ইউ’-এমন লেখা দেখলে যে কারোরই সেবা নেয়ার আগ্রহ জাগবে। কিন্তু, বেনাপোল চেকপোস্টের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল নো-ম্যান্সল্যান্ডে ‘মে আই হেল্প ইউ’ অফিস বানিয়ে সেবার নামে ভারতীয় বিএসএফ সদস্যরা পাসপোর্টধারী যাত্রীদের সীমাহীন হয়রানি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগী বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী যাত্রীরা জানান, ভারত ভ্রমণ শেষে তারা ভারতীয় ইমিগ্রেশন, কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাগেজ নিয়ে নোম্যান্সল্যান্ডে এলে বিএসএফ সদস্যরা সব সময় বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী যাত্রীদের লাগেজসহ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তাদের চোরাচালানি হিসেবে মামলা দেয়ার ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক টাকা আদায় করে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এ সব বিষয়ে একাধিক অভিযোগ থাকলেও বিজিবি কোনো বিষয়ে গুরুত্ব দেয় না।
২৬ বিজিবির বেনাপোল চেকপোস্ট ক্যাম্প কমান্ডার আইয়ুব হোসেন বিএসএফের দ্বারা যাত্রী হয়রানির কথা স্বীকার করে জানান, কোনো পাসপোর্টযাত্রী অভিযোগ জানালে আমরা সাথে সাথে বিএসএফের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে থাকি। যাত্রীদের মারপিট ও হয়রানির বিষয়টি আমরা ইতোমধ্যে বিএসএফের কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। আশা করছি অচিরেই হয়রানি বন্ধ হবে। তা না হলে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে এর সমাধান করা হবে।
এমএএস/আরআইপি