বিধিনিষেধে বন্ধ পশুরহাট, অবিক্রীত থাকার শঙ্কায় কুষ্টিয়ার খামারিরা
ঈদের সময় যত ঘনিয়ে আসছে কোরবানির পশু বিক্রি নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার খামারিদের মধ্যে দুশ্চিন্তা ততই বাড়ছে। প্রতি বছরের মতো দেশের বিভিন্ন হাটে বিক্রির জন্য এবারও কুষ্টিয়া জেলায় দেড় লাখেরও বেশি গরু-ছাগল প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণ এবং ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের কারণে সারাদেশেই কুষ্টিয়া অঞ্চলের পশুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অন্যান্য বছর ঈদের এক-দেড় মাস বাকি থাকতেই দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ব্যাপারীরা পছন্দের গরু-ছাগল ক্রয়ের জন্য কুষ্টিয়া জেলায় ভিড় করতেন। কিন্তু করোনার কারণে এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষ ২১ জুলাই কোরবানির ঈদ অনুষ্ঠিত হতে পারে। সে হিসাবে ঈদের আর ১৩ দিন বাকি। কিন্তু করোনা রোধে চলমান কঠোর বিধিনিষেধে এখনো ব্যাপারীদের পা পড়েনি এ জেলায়। জেলার সব পশুর হাটও বন্ধ। কবে উন্মুক্ত হবে সেটাও নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
এ অবস্থায় কোরবানির জন্য প্রস্তুত বিপুল সংখ্যক পশু নিয়ে দুশ্চিন্তায় এখানকার প্রায় ১৮ হাজার খামারি। এছাড়া বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনার কারণে গত কোরবানির ঈদের প্রায় ২০-২৫ ভাগ অবিক্রীত পশু।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে এবারও যদি পশু বিক্রি করতে না পারেন তাহলে এ অঞ্চলের হাজার হাজার খামারি একেবারেই পথে বসবেন। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, করোনার কারণে শেষ পর্যন্ত পশুর হাট চালু না হলে এ বছরও অর্ধেকেরও বেশি পশু অবিক্রীত থেকে যাবে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সিদ্দিকুর রহমান জানান, এ বছর কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে জেলায় প্রায় ১ লাখ ৫১ হাজার গরু ও ছাগল প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে গরু ৯০ হাজার। ছাগল ৬১ হাজার। গত বছরের তুলনায় এ বছর পশুর সংখ্যা বেশি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার।
তিনি আরও জানান, কোনো প্রকার মেডিসিন ছাড়াই কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজা করায় দেশব্যাপী এ অঞ্চলের গরুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। একইভাবে দেশের বিখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট একমাত্র এ অঞ্চলেই পাওয়া যাওয়ায় গরুর পাশাপাশি ছাগলেরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে জেলার প্রায় ১৭ হাজার ৭৯৩ জন খামারির পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গরু-ছাগল পালন করা হয়।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া ইউনিয়নের হাতিয়া গ্রামের মৃত আরজ আলি বিশ্বাসের ছেলে আমিরুল। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে কয়েকটি গরু প্রস্তুত করেছেন। এর মধ্যে একটি গরু বিশাল আকৃতির। গায়ের রঙ কালো হওয়ায় ভালোবেসে গরুটির নাম রেখেছেন ‘ব্ল্যাক কাউ’। দু’বছর আগে গরুটি কেনেন আমিরুল।
গত কোরবানির ঈদে সঠিক দাম না পাওয়ায় গরুটি তিনি বিক্রি না করে এ বছর বিক্রির জন্য রেখে দিয়েছেন। কিন্তু বিধিনিষেধের কারণে শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত দামে গরুটি বিক্রি করতে পারবেন কিনা এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আমিরুল।
তার মতো কোরবানির পশু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় খাজানাগর এলাকার খামারি ওমর ফারুক, হরিপুর ইউনিয়নের জাকিরুল ইসলামসহ এ অঞ্চলের হাজারও খামারি।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বৃত্তিপাড়া এলাকার রওশন আরা জানান, গত বছর তার আটটি গরুর মধ্যে মাত্র দুটি বিক্রি করতে পেরেছেন। করোনার কারণে ভালো দাম না পেয়ে এ বছর ভালো দামে বিক্রি করবেন বলে বাকি ছয়টি গরু রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসছে রওশন আরার দুশ্চিন্তা যেন ততোই বাড়ছে।
তিনি জানান, লকডাউনে হাট বন্ধ। গরুগুলো শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে বিক্রি করবেন এ দুশ্চিন্তায় তার ঘুম হারাম। বিক্রি না হলে বাড়িতে রেখে আরেক বছর যে পালবেন সে সক্ষমতাও তার নেই। এদিকে ভুসি, খড়, বিচালিসহ পশু পালনের সব খাদ্য উপকরণের দাম প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে।
গরুর পাশাপাশি যারা ছাগল পালন করছেন তারাও ছাগল বিক্রি নিয়ে একইভাবে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন বলে জানা গেছে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সার্বিক অবস্থা ভালোর দিকে যাচ্ছে না। করোনার কারণে লকডাউনে জেলার ১৫টি হাটের সব কটি বন্ধ। জেলায় এবার কোরবানির জন্য প্রায় ১ লাখ গরু মোটাতাজা করা হয়েছে। জেলার চাহিদা পূরণ করে প্রায় ৭০ শতাংশ গরু ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন হাটে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু করোনার কারণে জীবন-জীবিকা এখন প্যারালাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশু বিক্রি করতে না পেরে জেলার খামারিরা এখন কাঁদছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এই মুহূর্তে পশুর হাট খুলে দেয়া না হলে জেলার খামারিদের পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘পশুর হাট বন্ধ থাকায় জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের পক্ষ থেকে খামারিদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে অনলাইনে বিক্রির জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। জেলায় এরই মধ্যে অনলাইনে পশু বিক্রি শুরু হলেও তা খুবই অপ্রতুল।’
আল-মামুন সাগর/এসজে/এমএস