পাবনায় বাড়ছে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা

পাবনায় উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গত এক মাসে জেলার পাঁচ শিক্ষক হামলার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর হাতেই মার খেয়েছেন। নির্যাতনের শিকার কেউ আইনের আশ্রয় নেন, কেউ আবার ভবিষ্যতে হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কায় সেদিকে যাননি।
জানা গেছে, সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে সাঁথিয়া উপজেলার কাশীনাথপুর ইউনিয়নের মেহেদীনগর এম সি কে আলিম মাদরাসায়। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী শিক্ষক আব্দুর রশিদকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আহত করেছেন ওই মাদরাসার নৈশপ্রহরী আবু মুছা।
এ ঘটনায় সাঁথিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ করেন শিক্ষক আব্দুর রশিদ। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, নৈশপ্রহরী আবু মুছা দীর্ঘদিন ধরে মাদরাসা থেকে অবৈধভাবে সংযোগ নিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতেন। প্রতিবাদ করায় গত ১৮ অক্টোবর সকালে মাদরাসায় ঢোকার সময় শিক্ষক আব্দুর রশিদকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। পরে অন্য শিক্ষকরা তাকে সাঁথিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। এ ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়। পরে ১৮ অক্টোবর রাতে মুছাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ভাঙ্গুড়া উপজেলায় একদল দুর্বৃত্ত শ্রেণিকক্ষে ঢুকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মারধর করে। গত ১৮ অক্টোবর দুপুরে উপজেলার পারভাঙ্গুড়া ইউনিয়নের ভেড়ামারা এলাকার উদয়ন একাডেমিতে এ ঘটনা ঘটে। এতে দুই শিক্ষক আহত হন। পরে ঘটনার প্রতিবাদে এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জীবনের নিরাপত্তায় বিবেচনায় ওই প্রতিষ্ঠানটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া ইভটিজিংয়ে বাধা দেওয়ায় দশম শ্রেণির এক ছাত্র ও তার সঙ্গীদের হাতে মার খেয়ে গুরুতর আহত হন আবু বক্কার (৩৮) নামে এক শিক্ষক। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে বেড়া উপজেলার আমিনপুর থানার সাগরকান্দি ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের রিয়াজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। আহত ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানটির শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক।
শিক্ষকের ওপর হামলায় নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রের নাম ফারদিন সরদার। সে গোবিন্দপুর গ্রামের মুক্তার সরদারের ছেলে এবং দশম শ্রেণির ছাত্র।
এ বিষয়ে আমিনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রওশন আলী বলেন, হামলাকারীদের হুমকিতে ওই শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান প্রধান মামলা করার সাহস পাননি। এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হালিম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানান, বখাটেদের কাছে তারা অসহায়।
এর আগে পাবনার সাঁথিয়ায় শাহাদত হোসেন নামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষককে মারধরের ঘটনা ঘটে। বহিরাগতরা তাকে ক্লাস থেকে বের করে স্কুল মাঠে নিয়ে মারধর করেন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। শাহাদত হোসেন সাঁথিয়া উপজেলার গৌরীগ্রাম উম্মে কুলসুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি ঘটনার পরদিন ২৭ সেপ্টেম্বর সাঁথিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু প্রভাবশালীদের তদবিরে পরে আপসে বাধ্য হন।
এ প্রসঙ্গে পাবনা জেলা স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক ফিরোজ হোসেন বলেন, এমন এক সমাজে বসবাস করছি যেখানে শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষক খুন ও নির্যাতিত হওয়ার চিত্র দেখতে হচ্ছে। এগুলোকে সাধারণ অপরাধ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। বিচারের মাধ্যমে এসব অপকর্ম চিরতরে দমনে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষকদের যে বা যারা শারীরিকভাবে আঘাত করতে পারে, তাদের পক্ষে যে কোনো ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটানো সম্ভব। শিক্ষককে লাঞ্ছিতের প্রতিটি ঘটনায় প্রভাবশালীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। আবার কিছু শিক্ষার্থী স্কুল জীবন থেকেই মাদকে আসক্ত হওয়ায় শিক্ষকরা তাদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো দরকার।
কাশীনাথপুর নাগরিক কমিটির সভাপতি আমিরুল সানু বলেন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। যেসব দেশ শিক্ষকের মর্যাদা বুঝতে পেরেছে, সেসব দেশ আজ উন্নতির উচ্চস্থানে রয়েছে। দেশ ও জাতিকে রক্ষায় শিক্ষকদের গুরুত্ব দিতেই হবে।
পাবনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও পাবনা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ (অবসরপ্রাপ্ত) মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, শিক্ষকরা আজ নানাভাবে নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। শিক্ষকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার বা ম্যানেজিং কমিটিতে স্থান পেয়ে বা না পেয়ে অনেকে শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতন, লাঞ্ছনা, হুমকি ও কর্তব্য পালনে বাধা দিচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করতে হবে।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও প্রশাসন) মাসুদ আলম জানান, জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ইভটিজিং বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। টহল বাড়ানোসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কোনো শিক্ষককে হুমকি দেওয়া বা হামলার ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
এমআরআর/এএইচ/জেআইএম