দৌলতদিয়ায় হাহাকার

রুবেলুর রহমান
রুবেলুর রহমান রুবেলুর রহমান , জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮:৪৬ এএম, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
যানবাহন ও যাত্রীর সংখ্যা কমে আসায় বেশিরভাগ খাবার হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো চালু আছে নেই বেচাকেনা। ছবি-জাগো নিউজ

একসময় ঘাট পার হওয়ার অপেক্ষায় লম্বা সিরিয়ালে সড়কে থেমে থাকতো শত শত যানবাহন। শোনা যেত হকারদের হাঁকডাক। ঘাট কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা হোটেল ও দোকানের ব্যবসাও ছিল জমজমাট।

তবে এসব এখন শুধুই অতীত! চিরচেনা সেই রূপে আর দেখা যায় না রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ঘাট। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘাটটি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট দিয়ে প্রতিদিন ছোট-বড় ৫-৮ হাজার যানবাহন ও লক্ষাধিক যাত্রী নদী পারাপার হলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র দেড় থেকে দুই হাজারের মধ্যে।

jagonews24

আরও পড়ুন: দুশ্চিন্তায় পদ্মাপাড়ের হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিক-শ্রমিকরা

২০২২ সালের ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর গত সাত মাসে দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে পদ্মা নদী পারাপার হওয়া যানবাহনের সংখ্যা কমেছে কয়েকগুণ। এতে দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় নেই সেই চিরচেনা যানবাহনের দীর্ঘ সারি। পারাপারের অপেক্ষায় আটকে থাকে না হাজার হাজার যাত্রী। বরং বর্তমানে যানবাহনের অপেক্ষায় থাকে ফেরি।

আগে ঘাট এলাকার খাবার হোটেল, মুদি দোকান, হকারসহ অন্য ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ছিল রমরমা। বর্তমানে যানবাহন ও ক্রেতা সংকটে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ শতাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। যানবাহনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন পরিবহন সেক্টরের কয়েকশ শ্রমিক।

jagonews24

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট। এ ঘাট কেন্দ্র করে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকার সড়কের পাশ দিয়ে গড়ে উঠেছিল শত শত দোকানপাট ও খাবার হোটেল। হরেক পদের পণ্য নিয়ে হকারদের পদচারণায় মুখর থাকতো ঘাট এলাকা। তবে ২০২১ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর অনেকটা কমে এসেছে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটের গুরুত্ব। ফলে যানবাহন ও যাত্রীর সংখ্যা কমে আসায় বেশিরভাগ খাবার হোটেল, মুদি দোকান ও গ্যারেজ বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এখনো চালু রয়েছে হাতেগোনা কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।

আরও পড়ুন: ‘পদ্মা সেতু চালু হলে বেঁচে যাই, ফেরিঘাটে বসে থাকতে ভালো লাগে না’

ঘাট এলাকায় কথা হয় হকার (ঝালমুড়ি ও পেঁয়াজু বিক্রেতা) মামুন মোল্লা, শাহাদাত ফকির, সোহেল রানা, সাচ্চু সরদার ও জিহাদুল খানের সঙ্গে। দরিদ্র পরিবারের সদস্য হওয়ায় ঘাটে হকারি করেন তারা।

jagonews24

তাদের ভাষ্যমতে, এখন ঘাটে আগের মতো গাড়ি নেই, তাদের ব্যবসাও নেই। পদ্মা সেতু চালুর আগে তারা প্রতিদিন এক হাজার টাকার ওপরে আয় করতেন। এখন হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকা। যে কারণে অনেক হকার কমে গেছে।

মুদি দোকানি শফি মোল্লা ও সোহেল শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেচাবিক্রি না থাকায় বর্তমানে বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আগে দিনে ১০-২০ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। এখন সেখানে হয় মাত্র ২০০-৩০০ টাকার মতো। বেশি হলে তিন হাজার। তবে সেটা মাঝে মধ্যে। দোকান খুলে বেকারের মতো বসে থাকতে হয়।’

প্রায় ২৮ বছর ধরে ঘাট এলাকায় আখের রস বিক্রি করেন ইসলাম খাঁ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে আখের রস বিক্রি করে মোটামুটি ভালোই ছিলাম। কিন্তু এখন দিনে মাত্র কয়েকশ টাকা বিক্রি হয়। বর্তমানে সবকিছুর যে দাম, তাতে এ কয়েকশ টাকায় কী হয়?’

jagonews24

আরও পড়ুন: ‘৬ কোটি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে পদ্মা সেতু’

পানি বিক্রেতা রুবেল বলেন, ‘আগে দিনে ২ থেকে ৩ কেস পানি বিক্রি করেছি। এখন এক কেস বিক্রি করতে কয়েকদিন লাগে।’

প্রভাব পড়েছে বই বিক্রিতেও। ঘাট এলাকায় ১৫ বছর ধরে বইয়ের ব্যবসা করেন আনোয়ার হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন যে বেচাকেনা তাতে সংসার চলে না। আগে টুকটাক চলতো। পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে আছি।’

হোটেল ব্যবসায়ী রাশেদ বলেন, ‘দৌলতদিয়ায় আর ব্যবসা নেই। আগে দিনে ১০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হলেও এখন দেড় হাজার হওয়াটাই কষ্ট। পদ্মা সেতুর চালুর পর থেকে এ অবস্থা।’

jagonews24

তিনি বলেন, ‘গাড়ি না থাকলে তো আর ব্যবসা হবে না। প্রায় ৭০ শতাংশ গাড়ি কমে গেছে। বেচাকেনার অভাবে এক-দেড় হাজার দোকানের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচটা দোকান খোলা আছে।’

হোটেল ব্যবসায়ী ও রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী মোটরচালক লীগের সভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন তপু জাগো নিউজকে বলেন, আগে ঘাট পার হওয়ার অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতো। এখন গাড়ি সরাসরি ফেরিতে উঠছে। এতে ঘাটের হোটেল ব্যবসায়ী, শ্রমিক, রিকশাচালক, হকারসহ অন্যরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। ঘাট শাসন করে আধুনিকায়নসহ টানেল করা হলে ঘাটকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা একটু বাঁচতেন।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেন যাবে ২০২৩ সালের জুনে

তিনি বলেন, বর্তমানে অনেক শ্রমিক আছেন যারা দিন শেষে পাঁচ কেজি চাল নিয়ে বাড়ি যেতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রী এসব শ্রমিককে যদি কোনো ভাতার ব্যবস্থা করে দিতেন তাহলে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু ভালো থাকতেন।

কথা হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক মো. সালাউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের বহরে ১৮টি ফেরি রয়েছে। বর্তমানে যানবাহনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় সবগুলো ফেরির প্রয়োজন হয় না। ১০-১২টি ফেরি দিয়েই যানবাহনের চাপ সামাল দেওয়া সম্ভব। বর্তমানে ফেরিই যানবাহনের অপেক্ষায় থাকে।

তিনি বলেন, যাত্রী ও যানবাহন পারাপারে এ রুটে এখন কোনো ভোগান্তি নেই। স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার আগে অধিক সংখ্যক যানবাহন পারাপার হলেও বর্তমানে ১৭০০-২০০০ যানবাহন পারাপার হয়।

এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।