মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বাঁচার লড়াই

সফিকুল আলম
সফিকুল আলম সফিকুল আলম , জেলা প্রতিনিধি পঞ্চগড়
প্রকাশিত: ০৬:৩৬ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০২৪

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার সাকোয়া এলাকার ষাটোর্ধ্ব মোমেনা বেগম। দৈনিক ৪৫০ টাকা পারিশ্রমিকে পাথর ভাঙার কাজ করেন বাংলাবান্ধার রুবেলের পাথরের সাইটে। দীর্ঘদিন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করায় শরীরে বেঁধেছে নানান ব্যাধি।

মোমেনার কোনো ছেলে নেই। স্বামী কিডনি রোগে শয্যাশায়ী। দুই মেয়ের একজনের বিয়ে দিলেও স্বামী নিরুদ্দেশ। একসময় হাসকিং মিলে কাজ করে জমানো ৫০ হাজার টাকা দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা ও মেয়ের ব্রেস্ট টিউমার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শেষ করেছেন।

বড় মেয়েসহ তার তিন মেয়েকেও তিনিই লালন-পালন করেন। ছোট মেয়ে রাজিয়ার বিয়ে দিয়েছেন পাশের গ্রামে। নিজেও অসুস্থ। এ অবস্থায় ১১ বছর ধরে পাথরের সঙ্গে লড়াই করছেন বাঁচার আশায়।

মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বাঁচার লড়াই

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে কাজ করা হাজারো পাথরশ্রমিকের গল্প মোমেনা বেগমের মতোই। বেঁচে থাকার তাগিদে লড়াই করে চলেছেন তারা। তবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করায় তাদের শরীরে বাসা বাঁধে নানান রোগ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন্দরটিতে ভুটান, নেপাল ও ভারত থেকে প্রতিদিন ৩৫০-৪০০ ট্রাক বোল্ডার পাথর আমদানি করা হয়। তিন শতাধিক ট্রাকে পাথর ওঠানামা আর চার শতাধিক মেশিনে পাথর ভাঙা হয়। মেশিনে পাথর ভাঙার সময় পাথরকণায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় গোটা এলাকা। এতে মারাত্মক হুমকির মুখে এখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশ, নষ্ট হচ্ছে ফসলের ক্ষেত, ফল গাছের মুকুল। শ্রমিকদের পাশাপাশি শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ মরণব্যাধি সিলিকোসিসে।

সকাল থেকে মেশিনের উচ্চ শব্দে চলতে থাকে শব্দদূষণ। শ্রমিকদের নাক, মুখ, শরীরসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িঘর, ফসলের ক্ষেতে জমে যায় পাথর কণার স্তূপ। মাস্কে পাথর কণা জমে শ্বাস নিতে না পারায় শ্রমিকরা মাস্ক ব্যবহার করেন না। তাদের নাক, মুখ দিয়ে অবিরাম বালু ও পাথরের ধুলিকণা ঢুকছে। এখানে স্টোন ক্রাশিং জোন করার দাবি দীর্ঘদিন থেকেই উপক্ষিত। শ্রমিকদের ন্যূনতম স্বাস্থ্য সচেতনতায় কারো কোনো উদ্যোগ নেই।

মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বাঁচার লড়াই

সম্প্রতি বাংলাবান্ধা এলাকা ঘুরে কথা হয় কয়েকজন পাথরশ্রমিকের সঙ্গে। মোমেনা বেগম বলেন, ‘আমার হার্টের সমস্যা, শরীরে নানান রোগ। স্বামী বুড়ো এবং অসুস্থ। মানুষ কাজে নেয় না। নিজে ৪৫০ টাকা হাজিরায় এই কাজ করি। শ্রমিকদের সঙ্গে ম্যাচ করে থাকি। স্বামী, বড় মেয়েসহ ছয়জনের সংসার চালাই। কাজের সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাই। একবার পাথরের ওপরে পড়ে ছিলাম। সেদিন মহাজন কাজ না করে বসিয়ে রেখেই টাকা দিয়েছিল।’

একই এলাকার পাথরশ্রমিক আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘আমাদের অনেক ক্ষতি হয় জেনেও কাজ করি। বুকে জাম জাম লাগে, নিশ্বাস নিতে পারি না। জ্বর ও শরীরে অনেক ব্যথা হয়। মাস্ক পরি না। কারণ, একটুতেই ধুলাবালিতে মাস্ক জাম হয়ে যায়। তখন আর নিশ্বাস নিতে পারি না। ১০ টাকা দামের মাস্ক কত ব্যবহার করবো?’

মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বাঁচার লড়াই

পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম মাহবুব উল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিলিকোসিস রোগ হয় মূলত বালু ও পাথরের ধুলিকণা থেকে। পাথর বা বালুর ধুলিকণা ওড়ে এমন পরিবেশে দীর্ঘদিন কাজ করলে সেই ধুলিকণা ফুসফুসের উপরিভাগে পড়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে সিলিকোসিস রোগ হতে পারে। এ রোগের উপসর্গ বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, মাথা ঘোরা। একপর্যায়ে আক্রান্ত রোগীর শরীর নীলাভ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।’

তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা ইউপি চেয়ারম্যান কুদরত-ই-খোদা মিলন বলেন, ‘পাথরনির্ভর বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে মেশিনের ভাঙা পাথরের ধুলিকণার কারণে শ্রমিকদের পাশাপাশি এলাকায় বিভিন্ন রোগ হচ্ছে। প্রত্যেক বাড়িতে ধুলার স্তূপ পড়ে, গাছে ফল ধরে না। ফলের মুকুল নষ্ট হয়ে যায়। এখানে আলাদা একটি স্টোন ক্রাশিং জোন করার দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু বাস্তবায়ন নেই।’

মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বাঁচার লড়াই

এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফজলে রাব্বী বলেন, ‘স্থলবন্দরের আশপাশে কোনো স্টোন ক্রাশিং জোন করা যায় কি না, তা নিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সহায়তায় আমরা স্টাডি করছি। স্টাডি ফিজিবল হলে একটি রিপোর্ট পাঠাবো। সেক্ষেত্রে সরকার পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।’

এসআর/আরএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।