থামানো গেলো না জনসমুদ্র, ঐতিহ্যবাহী হুমগুটিতে মাতলো লাখো মানুষ

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ময়মনসিংহ
প্রকাশিত: ০৮:৫৮ এএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় একটি আজব খেলার নাম ‘হুমগুটি’। প্রতিবছর হাজারো খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণে ঐতিহ্যবাহী এই খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। এবার ২৬৬তম খেলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে খেলাটি শেষ পর্যন্ত শুরু হবে কি না এ নিয়ে ছিল নানা কল্পনা-জল্পনা। তবে যথাসময়ে খেলোয়াড় আর দর্শনার্থীদের বাঁধভাঙা জনস্রোতে খেলা শুরু হয়। এবার খেলায় বিজয়ী হয়েছে পূব্বা। এ নিয়ে তিনবার বিজয়ী হলো দলটি।

মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) রাত ৯টার দিকে উপজেলার দেওখোলা ইউনিয়নের কালিবাজাইল গ্রামে হুমগুটি টেনে-হিঁচড়ে কাড়াকাড়ি করে গুম করে ফেলায় ওই গ্রামের খেলোয়াড়রা বিজয়ী হন। মূলত গ্রামটির অবস্থান পূর্বদিকে হওয়ায় পূর্বকে পূব্বা বলা হয়।

এর আগে মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল থেকেই ফুলবাড়ীয়া, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্রের তালে হাজারো খেলোয়াড় ও দর্শনার্থীরা আসতে থাকেন উপজেলার দেওখোলা ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের দশমাইল এলাকায় খেলার মাঠে। বিকেল তিনটায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয় খেলার মাঠ। এসময় হাজার হাজার খেলোয়াড় হুমগুটি লুকাতে টানাটানি করতে থাকেন। ধীরে ধীরে খেলার আশপাশে দর্শনার্থী আরও বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে জনসমাগম জনস্রোতে পরিণত হয়।

ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রুকনুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে খেলা বন্ধ করতে সোমবার রাত থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপরতা চালিয়েছে। তবে এটি এতটাই জনপ্রিয় যে, মানুষের ঢল থামানো যায়নি। ফলে যথাসময়ে খেলা শুরু হয়। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, খেলাকে কেন্দ্র করে কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ফলে আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে খেলোয়াড়সহ দর্শনার্থীরা।

থামানো গেলো না জনসমুদ্র, ঐতিহ্যবাহী হুমগুটিতে মাতলো লাখো মানুষ

বিজয়ী দলের খেলোয়াড় আরাফাত হোসেন বলেন, এ খেলার কোনো নিয়ম নেই, রেফারি নেই। যে যার মতো খেলতে পারে। তবে হুমগুটির অনেক ওজন থাকায় অনেক পরিশ্রম হলেও আনন্দ পাওয়া যায়। এছাড়া জমিদার আমলের খেলার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে খেলোয়াড়ের অভাব হয় না। এবারও হুমগুটি লুকিয়ে আমরা বিজয়ী হওয়ায় খুশি।

পার্শ্ববর্তী উপজেলা মুক্তাগাছা পৌর এলাকা থেকে আসা দর্শনার্থী মইনুল হক বলেন, বিকেলে দর্শনার্থীদের ঢল নামায় খেলার মাঠে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। খেলার মাঠের মেলা আর হুমগুটি লুকাতে এদিক-সেদিন টানাটানি দেখে অন্যরকম এক আনন্দ পাওয়া যায়।

জনশ্রুতি আছে, মুক্তাগাছার জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী ও ত্রিশালের বৈলরের জমিদার হেম চন্দ্র রায় জমি পরিমাপের বিরোধ সমাধানে তাদের প্রজাদের মধ্যে কৌশল ও শক্তির খেলা বৃত্তাকৃতির বল ‘হুমগুটি’ খেলার আয়োজন করেছিলেন দুই জমিদারের সীমানা তেলিগ্রাম বড়ইআটা গ্রামে ধানের পতিত জমিতে। খেলার শর্ত ছিল যে জমিদারের প্রজারা প্রায় ৪০ কেজি ওজনের এক পিতলের বলকে নিতে পারবেন সেই জমিদারের জমির পরিমাপ হবে সাড়ে ৬ শতাংশে এক কাঠা। পরাজিত জমিদারের এলাকার জমির পরিমাপ হবে ১০ শতাংশে এক কাঠা। জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর প্রজারা খেলায় বিজয়ী হন। এরপর থেকে জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর ‘পরগনা’ এলাকায় জমির পরিমাপ হয় সাড়ে ৬ শতাংশে এক কাঠা। জমিদার হেম চন্দ্র রায়ের এলাকার ‘তালুক’ জমির পরিমাপ হয় ১০ শতাংশে এক কাঠা।

সেই রেওয়াজ মেনে এখনো প্রতিবছর খেলার আয়োজন করা হয়। খেলোয়াড়রা পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ চার ভাগে বিভক্ত হয়ে খেলতে শুরু করেন। খেলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয়রা এগুলোর নাম দিয়েছে পুব্বা, পশ্চিমা, উত্তইরা ও দক্ষিণা। কোনো বছর সন্ধ্যায় আবার কোনো বছর রাতে খেলা শেষ হয়। তবে ঐতিহ্যবাহী এই খেলাটি শুরু হওয়ার পরদিনসহ টানা কয়েকদিন খেলার রেকর্ডও রয়েছে।

কামরুজ্জামান মিন্টু/এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।