ড. জাহিদ হোসেন
মার্কিন বাজার থেকে ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানি আয় হতে পারে
চীন ও ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মার্কিন বাজার থেকে বাংলাদেশের দুই বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানি আয় আসতে পারে মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
শনিবার (৩০ আগস্ট) রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) অডিটোরিয়ামে ‘ম্যাক্রোইকোনমিক চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের পথ’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তব্য দেন ড. জাহিদ হোসেন।
‘মোয়াজ্জেম হোসেন স্মারক বক্তৃতা’ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে ইআরএফ। এ মেমোরিয়াল লেকচারে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফের সভাপতি দৌলত আকতার মালা। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
যখন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ প্রতিক্রিয়া শুল্কারোপ করেছিল, তখন মনে করা হচ্ছিল যে বাংলাদেশ মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হবে এবং রপ্তানি আয়ের ২২ শতাংশ ভারতে চলে যেতে পারে। তবে, শুল্কের হার কমে ২০ শতাংশ হওয়ায় এটি আমাদের কাছের প্রতিযোগীদের সমান হয়ে যায়, তখন এটি আমাদের জন্য দারুণ সুযোগ নিয়ে আসে।
প্রতিক্রিয়া শুল্কের হার ছাড়াও মার্কিন সরকার ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্কারোপ করেছে, ফলে ভারতীয় শুল্কের হার ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে, এ শুল্কের হার পণ্যের ধরন অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে।
দুই বিলিয়ন ডলারের আয়ের মধ্যে নিটওয়্যার পণ্য থেকে আসতে পারে ৩২৫ মিলিয়ন ডলার, ওভেন পণ্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলার, ফুটওয়্যারে ৯৬ মিলিয়ন ডলার, হিমায়িত মাছ থেকে ১২০ মিলিয়ন ডলার, কৃষিপণ্য ১৪৮ মিলিয়ন ডলার, ফার্নিচার ৬৯ মিলিয়ন ডলার এবং হোম টেক্সটাইল ১০৮ মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, চীন থেকে আসতে পারে ৭৪ মিলিয়ন ডলার।
জাহিদ হোসেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক—স্থিতিশীলতা, কর্মচাঞ্চল্য এবং জনকল্যাণ—অনুসমীক্ষা করেছেন। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে কারণ, অস্থিতিশীলতার পেছনে যারা কাজ করছিলেন, তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। ফলে অর্থপাচার ব্যাপকভাবে কমেছে এবং ব্যাংকখাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ হয়েছে। যদিও নীতিগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ কৃতিত্ব দেখা যায়নি, তবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। তবে, এটি মানে এই নয় যে, সরকারের সব সিদ্ধান্ত সঠিক এবং কার্যকর।’
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘গত এক বছরে হুন্ডি কার্যক্রম কমে গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রবাহিত হচ্ছে এবং ব্যাংকখাতে লুটপাটের ঘটনা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকখাতের আসল পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি এবং খেলাপি ঋণও বেড়েছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো আমাদের অর্থনীতির জন্য বেশ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের পর্যায়ে আটকে পড়েছে, যার প্রধান কারণ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, ব্যাংকখাতের দুর্বলতা, প্রশাসনিক জটিলতা এবং শ্রমবাজারে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হওয়া। এসব বিষয় আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
জাহিদ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীলতা ফিরে পেয়েছে এবং ২০২২–২৩ অর্থবছরের তুলনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। তবে, এসময়ে গৃহস্থালি পর্যায়ে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, দারিদ্র্য এবং অস্থিতিশীলতা বেড়েছে।
সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টার বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা সফলতার জন্য যথেষ্ট নয়। কার্যকর সংস্কারের জন্য শুধু রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি নয়, শক্তিশালী বাস্তবায়ন ক্ষমতাও প্রয়োজন। এটি একটি সমন্বিত প্রচেষ্টার বিষয়—যেখানে কাউন্সিল অব অ্যাডভাইজার্স, প্রশাসন, ব্যবসায়ী মহল এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা থাকতে হবে। এ চারটি গোষ্ঠী একসঙ্গে কাজ না করলে সংস্কার প্রক্রিয়া থেমে যেতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে মন্তব্য করে জাহিদ বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে তারা সৎ এবং সাহসী, তবে অন্য কিছু ক্ষেত্রে দিশাহীন বা অক্ষম হয়ে পড়েছেন।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য মাহবুবুর রহমান। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘যুগান্তকারী পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা ছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি বরং অস্থিতিশীলতা আরও বেড়েছে।’
আইএইচও/এমএমএআর/এমএএইচ/এমএস