শেখ হাসিনার স্বর্ণ উদ্ধার, আলোচনায় ব্যাংকের ভল্ট-লকার

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০২৫
রাজধানীর মতিঝিলে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখায় শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা লকার থেকে ৮৩২.৫ ভরি সোনা পাওয়া গেছে, ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাংকে রাখা দুটি লকারে পাওয়া গেছে ৮৩২ দশমিক ৫ ভরি সোনা। অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে উদ্ধার হয় এসব সোনা। এরপর থেকেই ব্যাংকে রাখা সোনা নিয়ে চলছে আলোচনা। নিরাপত্তার বিষয়টির পাশাপাশি অনেকেরই জিজ্ঞাসা ব্যাংকে মূল্যবান সামগ্রী রাখা কতটা নিরাপদ, লকার আর ভল্টের পার্থক্য কী এবং গ্রাহকের অনুপস্থিতিতে লকার খোলা যায় কি না।

গতবছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের কর ফাঁকি ও দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে। এর অংশ হিসেবে শেখ হাসিনার নামে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের লকার জব্দ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। গেলো ২৫ নভেম্বর একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সিআইসি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) যৌথ টিম লকার দুটি খুলে সোনার গহনা জব্দ করে। আদালতের অনুমতি নিয়ে এই প্রথম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাংকের লকার খোলা হলো।

গত ১০ সেপ্টেম্বর সিআইসি রাজধানীর সেনা কল্যাণ ভবনে অবস্থিত পূবালী ব্যাংকের মতিঝিল করপোরেট শাখায় অভিযান চালিয়ে শেখ হাসিনার নামে থাকা ১২৮ নম্বর লকারটি জব্দ করে। এ সময় পূবালী ব্যাংকের ওই শাখায় শেখ হাসিনার দুটি ব্যাংক হিসাবও জব্দ করে। একটি হিসাবে ১২ লাখ টাকা এফডিআর এবং অন্যটিতে ৪৪ লাখ টাকার সন্ধান পান তারা। এ সব হিসাব তখন জব্দ করা হয় এবং টাকা উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এরপর, গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখায় (সাবেক স্থানীয় কার্যালয় শাখা) শেখ হাসিনার আরও দুটি লকারের সন্ধান পায় সিআইসি। লকারের নম্বর দুটি হলো ৭৫১ ও ৭৫৩। পরবর্তী সময়ে আদালতের নির্দেশে লকার দুটিই খোলা হয় এবং উদ্ধার করা হয় ৮৩২ দশমিক ৫ ভরি সোনা।

এরপর থেকেই ব্যাংকের লকার ও ভল্ট নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে।

ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভল্ট এবং লকারের মূল পার্থক্য ব্যবহারকারীর জন্য। ভল্ট ব্যবহার করে ব্যাংকগুলো আর লকার ব্যবহার করেন গ্রাহকরা। লকার ব্যবহার করার নিয়মকানুন ব্যাংক-কোম্পানি আইন ১৯৯১ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নির্ধারণ হয়ে থাকে। এছাড়া সরকারি বা বেসরকারি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকও মৌলিক নিয়মগুলো একই রেখে নিরাপত্তার খাতিরে তাদের মতো করে কিছু নিজস্ব নিয়মও যুক্ত করে থাকে।

বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, লকার আনলক বা খোলার ক্ষেত্রে গ্রাহক বা তার দ্বারা নির্ধারিত প্রতিনিধির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। তবে আদালতের নির্দেশে অনেক সময় ব্যাংকের লকার জব্দ বা খোলার উদাহরণ রয়েছে।

ভল্ট ও লকারের পার্থক্য

ভল্ট হলো ব্যাংকের একটি সুরক্ষিত ও কেন্দ্রীয় স্থান যেখানে নগদ টাকা, মূল্যবান সম্পদ এবং গুরুত্বপূর্ণ নথি রাখা হয়। অন্যদিকে, লকার হলো ভল্টের ভেতরে থাকা একটি ছোট, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বক্স, যা গ্রাহকরা ভাড়া নেন তাদের ব্যক্তিগত মূল্যবান জিনিস যেমন স্বর্ণ, দলিলপত্র রাখার জন্য। ব্যাংকের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ভল্ট। আর ভল্টের ভেতরে আলাদা রুমে থাকে লকার ব্যবস্থা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত মূল্যবান সামগ্রী নিরাপদ রাখতে ব্যাংকের সেফ ডিপোজিট লকার ব্যবহার করেন অনেকে। প্রতিটি ব্যাংকেই এই সুবিধা থাকে, তবে সব শাখায় নয়।

অন্যদিকে, ভল্ট ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। এ ক্ষেত্রে সহজ ভাষায় বলতে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট হলো সরকারের মূল কোষাগার আর অন্যান্য ব্যাংকের ভল্ট সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কোষাগার যেখানে অর্থ বা সম্পদ রাখার পরিমাণ নির্দিষ্ট।

আরও পড়ুন:

অগ্রণী ব্যাংকে শেখ হাসিনার দুই লকারে পাওয়া গেল ৮৩২.৫ ভরি সোনা
শেখ হাসিনার সম্পদ কত?

ভল্টের সীমা অতিক্রম করলে নিয়ম অনুযায়ী বাড়তি অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা সোনালী ব্যাংকের চেস্ট শাখায় (সোনালী ব্যাংকের যে শাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিবর্তে কাজ করে) রাখতে হয়।

অগ্রণী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল বাশার বিবিসি বাংলাকে বলেন, লকার খোলার ক্ষেত্রে দুটি চাবির প্রয়োজন হয়, যার ‘মাস্টার কি’ থাকে ব্যাংকের কাছে এবং অন্যটি থাকে গ্রাহকের কাছে। দুটি চাবি একসঙ্গে ব্যবহার করেই কেবল লকারটি খোলা বা বন্ধ করা যায়।

অত্যন্ত গোপনীয় হওয়ায় লকার ব্যবহারের সময় সেখানে গ্রাহক ছাড়া অন্য কেউ থাকার সুযোগ পান না। একক বা যৌথভাবেও লকার ভাড়া নেওয়া যায় এবং গ্রাহক নিজের পছন্দ অনুযায়ী ব্যক্তিকে নমিনি করতে পারেন।

তিনি বলেন, যেখানে লকার থাকবে সেখানে সিসি ক্যামেরাও থাকার সুযোগ নেই। প্রতিবার প্রবেশ বা বের হওয়ার সময় তার হিস্ট্রি নির্দিষ্ট লকবুকে নথিভুক্ত থাকে।

সাধারণ গ্রাহকরা নির্দিষ্ট অর্থ পরিশোধ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের লকার ব্যবহার করতে পারেন। লকার নেওয়ার সময় নির্দিষ্ট একটি ফরম পূরণ করে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়। এক্ষেত্রে লকার থেকে কোনো সম্পদ গায়েব হলে গ্রাহক ক্ষতিপূরণ কীভাবে পাবে সেটিরও নিয়ম নির্ধারণ করা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকেও লকার সিস্টেম রয়েছে তবে সেটি ব্যবহারের সুযোগ পান ওই ব্যাংকের কর্মকর্তারা। যদিও নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় এই সুযোগ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা।

লকার কি যে কেউ খুলতে পারে?

সাধারণত লকার খোলার ক্ষেত্রে গ্রাহক বা তার মনোনীত প্রতিনিধির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। কারণ গ্রাহকের কাছে থাকা চাবি ছাড়া লকারটি খোলা সম্ভব নয়। এছাড়া একান্ত ব্যক্তিগত হওয়ায় লকারে থাকা সম্পদের নিরাপত্তা এবং এর জবাবদিহি নিশ্চিতের বিষয়টিও রয়েছে।

সম্প্রতি শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বোন শেখ রেহানা, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদসহ পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা অগ্রণী ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের লকারগুলো থেকে ৮৩২ ভরি স্বর্ণ পেলো দুদক। এক্ষেত্রে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, গ্রাহকের অনুপস্থিতিতে লকারের ভেতরে থাকা সম্পদের সঠিক হিসাব দেওয়া হচ্ছে কি না। এছাড়া জব্দ হওয়া সম্পদের পরিমাণ ফলাও করে প্রচার করার পেছনে রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কি না।

এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল বাশার বিবিসি বাংলাকে বলেন, শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের কয়েকজনের নামে থাকা লকারগুলো খোলার ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা মানা হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছেন তারা। এটি একটা অন্য পরিস্থিতি। সরকার চাচ্ছে, আদালতের বিষয় এখানে তো ব্যাংকের কিছু করণীয় নেই।

প্রয়োজনীয় আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই লকারগুলো খোলা হয়েছে বলে মনে করে এই মামলার তদন্তকারী সংস্থা দুদক। তারা বলছে, আইনগতভাবে এক্ষেত্রে কোনো অস্বচ্ছতা নেই, তা না হলে তো দুদক একাই এটা করতে পারতো।

দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী লকারগুলো খুলেছেন তারা। এসময় একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, অনুসন্ধান তদারক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোনীত একজন স্বর্ণ বিশেষজ্ঞ, এনবিআরের কর গোয়েন্দা ও সিআইসি মনোনীত দুজন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যাংক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের প্রায় দেড় বছর পর লকারগুলো খোলা হলো কেন এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক মহাপরিচালক বলেন, আমাদের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা আদালতে আবেদন করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালত আদেশ দিয়েছেন। সবকিছু একটা প্রসিডিওরের মধ্য দিয়ে যাওয়ায় একটু সময় লেগেছে।

অতীতেও এমন ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরীর বাংলাদেশ ব্যাংকের লকার থেকে স্বর্ণ, নগদ ডলার, ইউরোর মতো সামগ্রী উদ্ধার করে তা জব্দ করা হয়েছিল। সেবারও লকারটি খোলার আগে আদালতের আদেশ আনতে হয়েছিল দুদক কর্মকর্তাদের।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোর্শেদ বলেন, আদালতের নির্দেশনা থাকলে ব্যাংকের লকার খোলার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকে না। তবে তদন্তাধীন একটি বিষয় ফলাও করে প্রচার করার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

এসএনআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।