পোশাক শ্রমিকদের মূল বেতন বাড়লেও আয় কমেছে
সম্প্রতি ‘দি উইকেস্ট লিঙ্ক ইন গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন : হাউ দ্য প্যানডেমিক ইজ অ্যাফেক্টিং বাংলাদেশ গামেন্টস ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গত এক বছরে দেশের ৩৫ শতাংশ পোশাক শ্রমিকের বেতন কমেছে। ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করে কাজ করলেও যথাযথ পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না তারা। ফলে তাদের অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছেই।’
এ প্রতিবেদনকে ‘উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন এ খাতের দেশীয় উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এখন তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক সঙ্কট রয়েছে। কারখানা মালিকরাই প্রতিযোগিতা করে শ্রমিক নিচ্ছেন। বৈশ্বিক মহামারি শুরুর আগে কারখানায় যে বেতন ছিল, এখন তা থেকে প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
অন্যদিকে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বেতন বেড়েছে। তবে অনেক কারখানায় কাজের অর্ডার কমে যাওয়ায় বাড়তি আয় (ওভার টাইম) কমে গেছে। মূল বেতন বাড়লেও আয় কমেছে।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, মালিকপক্ষ অনেক কিছুই গোপন করেন। অনেক শ্রমিক চাকরি হারানোর ভয়ে কথা বলতে পারে না। এখনও অনেক কারখানায় বকেয়া রয়েছে। ওভার টাইম না থাকলে কীভাবে চলবে, সেগুলোও উঠে আসা উচিত।
গত বছর বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের শুরুর পর সব কিছু স্থবির হয়ে পড়ে। এর প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিও কোণঠাসা হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে দেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্পে। একের পর এক অর্ডার বাতিল হতে থাকে। ক্রেতাদের কাছে বকেয়াও পড়ে বেশিরভাগ কারখানার।
এরই মধ্যে সবকিছু লকডাউনের আওতায় আনে সরকার। লকডাউনের সময় ২০২০ সালের ৪ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকে সব কারখানা। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের ৬৫ শতাংশ বেতন দেয়া হয়। অনেক কারখানায় আবার পুরো টাকাই দেয়া হয়, যদিও এ সময়ের মধ্যে তারা কারখানায় কোনো কাজ করেননি।
মালিকপক্ষ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্ধের সময় শ্রমিকদের ৬৫ শতাংশ হারে বেতন হওয়া মানে বেতন তার কমেনি। কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হলে ৫০ শতাংশ বেতন হওয়ার কথা। তবে শ্রমিকরা ৬৫ শতাংশ পেয়েছেন। যোগদান এক বছরের কম হলে টাকা পাবেন না, আইনে এ বিধান থাকলেও সবাই সে সময় অর্থ পেয়েছেন। ২২ দিনে ৬৫ শতাংশ বেতন তারা পেয়েছেন, কেউ কেউ পুরো বেতন পেয়েছেন। এটাকে বেতন কমা বলা যাবে না, বেতন বেড়েছে।
তাদের দাবি, কোভিড-১৯ সময়ে অনেক কারখানায় কাজের অর্ডার কম থাকায় সেখানে ওভার টাইম দেয়া হয়নি। কিন্তু তাদের মূল বেতন কমেনি, অধিকাংশ কারখানায় ইনক্রিমেন্ট হয়েছে। এ সময় ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘দি উইকেস্ট লিঙ্ক ইন গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন : হাউ দ্য প্যানডেমিক ইজ অ্যাফেক্টিং বাংলাদেশ গামেন্টস ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে করোনাকালে গার্মেন্টসের, বিশেষ করে নারীকর্মীদের বিভিন্ন ঝুঁকির চিত্র উঠে এসেছে। গত ২৭ এপ্রিল প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর করোনা শুরুর পর দেশের ৩৫ শতাংশ পোশাক শ্রমিকের বেতন কমানো হয়। এছাড়া বাজারে চাহিদা কমা, করোনার কারণে বাজার বন্ধ, শিপমেন্টে দেরি হওয়া, সময়মতো পণ্যের মূল্য না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে পোশাকখাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শ্রমিকদের ঝুঁকি বেড়ে যায়। করোনার অজুহাতে নারী শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অনেকের বেতন হ্রাস করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে কর্মীরা ধার-দেনায় জড়িয়ে পড়েছেন।’
এ নিয়ে কথা হয় ময়না নামে এক শ্রমিকের সাথে। মালিবাগ এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের কারখানায় বেতন বেড়েছে। এখন আমার কাছে দুটি কারখানা থেকে অফার আছে, পরিবর্তন করলেই কিছু টাকা বেশি পাব। আয়টা কমে গেছে, কারখানায় বেশি কাজ না থাকায় ওভার টাইম আর পাচ্ছি না।’
এ বিষয়ে কথা হয় শ্রমিক নেতা মোশরেফা মিশুর সাথে। তিনি বলেন, ‘কারখানা মালিকরা অনেক বিষয় গোপন রাখেন। ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বেড়েছে, এটা অগ্রহণযোগ্য কথা। মজুরি কমিয়ে দেয়ার কাজ তারা করেন। অদক্ষ শ্রমিক হলে তারা দায়সারা কথা বলেন, দক্ষ করার দায়িত্ব তো তাদের। তাছাড়া অনেক কারখানায় বকেয়া বেতন আছে এখনও, সেসব উঠে আসা প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে কথা হয় পোশাক শিল্প উদ্যোক্তা ফতুল্লা অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি ফজলে এহসান শামীমের সাথে। তিনি বলেন, ‘কোভিড পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় কোভিড পরবর্তী সময়ে শ্রমিকদের বেতন ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এখন শ্রমিক সঙ্কট, যেকোনো মালিক বেশি বেতন দিয়ে শ্রমিক নিতে চাচ্ছেন। অনেক কারখানায় অর্ডার পর্যাপ্ত না থাকায় বাড়তি সময় (ওভার টাইম) কাজ হচ্ছে না। এতে তাদের আয় কিছু কমছে কিন্তু বেতন কমেনি। আজ আমার শ্রমিকের বেতন ১০ হাজার টাকা হলে অন্য একজন মালিক তাকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে অফার করছেন। কারণ এখন শ্রমিক সঙ্কট আছে এ খাতে।’
ইএআর/এমএইচআর/এসএইচএস/এমকেএইচ