জ্ঞানের চেয়ে সনদের গুরুত্ব কমানো দরকার

আহসান রাজীব বুলবুল
আহসান রাজীব বুলবুল আহসান রাজীব বুলবুল , কানাডা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০১:৫৬ পিএম, ০৫ নভেম্বর ২০২২

‘দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় জ্ঞানের চেয়ে সনদপত্রের গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। বইয়ের চেয়ে নোট ও শিক্ষকের চেয়ে কোর্স গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। আমাদের এই জায়গা থেকে বের হতে হবে। শিশুর শারীরিক-মানসিক-সাংস্কৃতিক ও নৈতিক উৎকর্ষতা সাধনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে তবেই আলোকিত মানুষ গড়া সম্ভব।’

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের আয়োজনে গতকাল চট্টগ্রামের বৌদ্ধমন্দির সড়কস্থ ফুলকি স্কুলের এ. কে. খান স্মৃতি মিলনায়তনে ‘মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শ অর্জনে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা’ বিষয়ক এক সেমিনারে প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন এ মন্তব্য করেন।

তিন পর্বে বিভক্ত এ সেমিনারে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইয়েন্স বিশ্বদ্যালয়ের প্রক্টর তাসনিম ইমামের উপস্থাপনায় সেমিনারে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে স্বাগত বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী ভালদোসতা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক (অবঃ) ড. মিজানুর রহমান মিয়া।

এ সময় সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের মহাপরিচালক এবং বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এ. এফ ইমাম আলী।

আরও বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নর্থ আমেরিকার আহ্বায়ক আবু জাফর মাহমুদ, কলামিস্ট উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক মো. মাহমুদ হাসান এবং কানাডার প্রবাস বাংলা ভয়েসের প্রধান সম্পাদক আহসান রাজীব বুলবুল।

জ্ঞানের চেয়ে সনদের গুরুত্ব কমানো দরকার

এছাড়াও বক্তব্য দেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক, সেন্টার ফর ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ, ইউল্যাবের পরিচালক ড. ফাহিম হাসান শাহেদ, সরকারি সিটি কলেজ চট্টগ্রামের অধ্যক্ষ ড. সুদীপ্তা দত্ত, শিক্ষক নেতা ও বিজয় সরণি কলেজ, চট্টগ্রামের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, সমাজ গবেষক ও লেখক খন্দকার শাখাওয়াত আলী, রাঙ্গুনিয়া হাসিনা জামাল ডিগ্রি কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শীলা দাশগুপ্তা।

বক্তারা বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরে গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, দেশে শিক্ষার হারের ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলেও শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে সচেতন নাগরিকদের মধ্যে একটি বড় প্রশ্ন রয়েছে।

নানা শ্রেণিতে বিভক্ত এই সমাজে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ সবার জন্য সমান নয়। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্যমূলক একটি ব্যবস্থা চালু আছে। শিক্ষাক্ষেত্রে হার বাড়লেও তা গুণগত মানের বিচারে এখনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

বক্তারা বলেন, শিক্ষা এখন শুধু পরীক্ষা-পরীক্ষার ফলাফলভিত্তিক হয়ে গেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে না পারলে ও শিক্ষাকে শুধুমাত্র অর্থপ্রাপ্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হলে সেই শিক্ষা থেকে কোনো মানবিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী সমাজব্যবস্থা তৈরি করতে পারবে না।

তাই শিক্ষাকে সময় উপযোগী করে যৌক্তিকভাবে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা সময়ের দাবি। তাই মুক্তিযদ্ধের আদর্শের ওপর ভিত্তি করে তৃণমূল পর্যায় থেকে অভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক ও সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করাটি জরুরি। এছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ নেবেন বলে বক্তারা অভিমত ব্যক্ত করেন।

সংগঠনটির মহাপরিচালক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজতত্ত্ব বিভাগের সাবেক সুপার নিউমারি প্রফেসর ড. ইমাম আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে পাঁচজন শিক্ষাবিদ তাদের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

জ্ঞানের চেয়ে সনদের গুরুত্ব কমানো দরকার

কবি-সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন ‘শিশুর বিকাশ ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা’, যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসুধন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স ম রেজাউল করিম ‘গুণগত মানসম্মত শিক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন’, বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষক নেতা কানাই দাশ ‘মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষাদর্শন ও মাধ্যমিক শিক্ষার চালচিত্র’, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আবদুল আউয়াল বিশ্বাস ‘বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য গুণগত শিক্ষা’ বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

প্রাবন্ধিক-শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বলেন, স্কুল থেকে শিক্ষা চলে গেছে কোচিং সেন্টারে। নোট আর গাইড বই-ই যেন ভরসা। শিক্ষাটা পরীক্ষামুখী হয়ে গেছে। শিক্ষা জিনিসটা স্কুল থেকে কোচিং সেন্টারে গেছে। বইয়ের চেয়ে নোট বই গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষকের চেয়ে কোর্স গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে।

লেখাপড়ার চেয়ে পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। জ্ঞানের চেয়ে সনদপত্রের গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। এই জায়গা থেকে বের হতে হবে। আবুল মোমেন শিশুর শারীরিক-মানসিক-সাংস্কৃতিক ও নৈতিক উৎকর্ষতা সাধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে সর্বজনীন-বিজ্ঞানমনষ্ক একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালুর আহ্বান জানান।

শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মাহবুবুল হক ‘শিক্ষা কোনো বাণিজ্য নয়, শিক্ষা সবার অধিকার’ এই স্লোগানটিকে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবনের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে।

পাশাপাশি তিনি ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির মধ্যে যে সুবিধাবাদিতা প্রবেশ করেছে তার সমালোচনা করে সে জায়গা থেকে বের হয়ে আসার আহ্বান জানান। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান না করে প্রাইভেট ও কোচিং ব্যবসার মধ্য দিয়ে বেশি টাকা উপার্জনের যে প্রক্রিয়া শিক্ষকদের মধ্যে চলমান রয়েছে তা বন্ধ করে শিক্ষার্থী ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত হতে হবে।

শিক্ষক নেতা কানাইদাশ বলেন, বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিনির্ভর মানুস গড়ে তুলতে প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ও রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা যেমন অপরিহার্য তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কর্ণধারদের শিক্ষাচিন্তা। ড. কুদরত এ খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে মুক্তিযুদ্ধের সেই শিক্ষাদর্শ রয়েছে। যার লক্ষ্য অবশ্যই হতে হবে একটি সেক্যুলার প্রকৃত গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাহাত্তরের সাংবিধানিক রাষ্ট্রাদর্শ।

ড. আবদুল আউয়াল বলেন, দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের যোগ্য করে গড়ে তোলা সব শিক্ষকের জাতীয় দায়িত্ব। একই সঙ্গে তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবলিত জ্ঞানদানের মধ্য দিয়ে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

ড. খ ম রেজাউল করিম বলেন, শিক্ষা যে কোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ও টেকসই সমাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেখানে শিক্ষকই হলেন প্রধান চালিকাশক্তি। শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে এ পেশায় আনা, পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

এমআরএম/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।