পাঠক বাড়ছে, দরকার ভালো বই


প্রকাশিত: ০২:৪০ পিএম, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আপাদমস্তক বইয়ের মানুষ। চট্টগ্রামে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। একজন স্বপ্নবাজ তরুণ হিসেবে মানুষকে বই পড়ানোর কাজে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়েই একটি ভালো বইয়ের দোকান দেয়ার স্বপ্ন উঁকি দেয়। ধীরে ধীরে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন দীপঙ্কর দাশ। তার বইয়ের দোকান ‘বাতিঘর’ ইতোমধ্যে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সুধীজনের দৃষ্টি কেড়েছে। প্রকাশনায়ও নেমেছে ‘বাতিঘর’। বাতিঘরের আলো ছড়াচ্ছে ঢাকায়ও।  স্বপ্ন ও স্বপ্নের রূপায়ন নিয়ে তিনি মুখোমুখি জাগো নিউজ-এর সঙ্গে।

জাগো নিউজ : আপনার বইয়ের দোকান ‘বাতিঘর’র আলো চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে গোটা দেশের পাঠক মনে। যদি শুরুর কথা বলতেন।
দীপঙ্কর দাশ : ২০০৫ সালের কথা। চট্টগ্রামের চেরাগী মোড়ে ছোট্ট একটি জায়গা নিয়ে যাত্রা শুরু করি। একটি বিশেষ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের পথচলা। ওই সময় বইয়ের দোকানগুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বইয়ের ব্যবসা কোথাও ভালো যাচ্ছিল বলে তখন মনে হচ্ছিল না। দেশের বাইরেও তাই ছিল। চট্টগ্রামও এর বাইরে ছিল না।

জাগো নিউজ : এমন সময় কেন বইয়ের ব্যবসায় গেলেন?
দীপঙ্কর দাশ : নিছক একটি বইয়ের দোকান দেব, তা আমি শুরু থেকে ভাবিনি। আমি দীর্ঘদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ করেছি। সুতরাং বইকে ব্যবসা হিসেবেই নেব, তা মূলত উদ্দেশ্য ছিল না।

জাগো নিউজ : এই ধারণা জন্মালো কেন?
দীপঙ্কর দাশ : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সময় দেখেছি, পাঠক নানা ধরনের বই চায়, কিন্তু বইয়ের দোকানগুলো তার জোগান দিতে পারছিল না। আমি প্রথমত বইয়ের দোকানগুলো চাঙ্গা করার চেষ্টা করলাম। দেখলাম, সেটা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এরপরই আমি নিজ উদ্যোগে দোকান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। পাঠক, লেখক এবং প্রকাশকদের কাছে আমি পরিচিতও হয়ে উঠছি তখন। প্রথমে জায়গা পাওয়া বড় মুশকিল হয়ে দেখা দিল। অর্থও ছিল না। তখন ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিতে দায়িত্ব পালন করছি। পরে চেরাগী মোড়ে ১০০ বর্গফুটের একটি জায়গা নিলাম। ২০০৫ সালের ১৭ জুন কবি নির্মলেন্দু গুণ দোকানের উদ্বোধন করতে গেলেন। চট্টগ্রামের পাঠকদের কাছে তখন এটি বিশেষ পরিচিত হতে লাগল। ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানের যেমন বিশেষ পরিচিতি, ঠিক আমার প্রতিষ্ঠানও এমন রূপ নিতে থাকল।

জাগো নিউজ : ওই সময় এমন একটি দোকান দেয়া তো চ্যালেঞ্জও ছিল।
দীপঙ্কর দাশ : অবশ্যই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল আমার জন্য। কিন্তু আমার জন্য বড় ধরনের সুবিধা ছিল, পাঠক দোকানটিকে নিজেদের দোকান মনে করেছে। তারাই দোকানের প্রচার করতে থাকল।

জাগো নিউজ : কী এমন করলেন যে, পাঠক দোকানটিকে নিজেদের মনে করলেন?
দীপঙ্কর দাশ : আমরা ব্যবসার পাশাপাশি সেবাটাকেই বড় করে দেখতে চাইলাম। আমাদের দোকানটি ছিল একেবারেই ছোট। সব বই দোকানে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। আমরা বললাম, যদি কোনো পাঠক অমুক বই চায়, তাহলে দুনিয়ার যেখানেই থাকুক না কেন, আমরা পাঠকের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করব।

জাগো নিউজ : তা কি সম্ভব হলো?
দীপঙ্কর দাশ : বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাঠককে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছি। এখনও। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। এটিই আমাদের সফলতার কারণ হতে থাকল। দ্বিতীয়ত. আমরা বই পড়ানোর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও সম্পৃক্ত করলাম পাঠককে। বিষয়ভিত্তিক অনুষ্ঠান, আলোচনারও আয়োজন করা হতো।

Dipongkor
জাগো নিউজ : অনলাইনের যুগ। কাগুজে বইয়ের কদর কমছে বলে মনে করা হয়। অন্য ব্যবসাও করতে পারতেন।
দীপঙ্কর দাশ : বই নিয়ে ব্যবসা করব, এটি আমার প্রথমে ধারণা ছিল না। অথবা এটিও যে একটি ব্যবসার অংশ হতে পারে, তা মনে করিনি। আমার চিন্তা ছিল বই নিয়ে কিছু একটা করতে পারা। মানুষ বলেন, পাঠক হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, পাঠক বাড়ছে, দরকার ভালো বই হাতে দেয়া। আর অনলাইনে বইয়ের বাজার খুব বড় হয়ে উঠছে আমি তা মনে করি না। এখনও মানুষ কাগজের বই হাতে নিয়েই পড়েন।

জাগো নিউজ : এখন বাতিঘর কোথায় দাঁড়িয়ে?
দীপঙ্কর দাশ : এক সময় জায়গা সংকুলান হচ্ছিল না। এরপর আমরা নতুন জায়গার সন্ধানে বের হলাম। অবশেষে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে একটি জায়গা পেলাম। সেখানেই একটি ফ্লোর নিই। দোকানের নকশা করা হয় একটি জাহাজের আদলে।

জাগো নিউজ : জাহাজের আদলে কেন?
দীপঙ্কর দাশ : একটি থিম দাঁড় করিয়েই করা আর কি। চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে জাহাজের একটি সম্পর্ক আছে। এর দরজা. জানালা, বুকসেল্ফ সবই জাহাজের আদলে করলাম। এখন ঢাকায় যেটি করছি, সেটি ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে মিল রেখেই। ডিজাইনার শাহিনুর রহমানের এক্ষেত্রে বড় অবদান রয়েছে। তার নকশাতেই সব করা।

জাগো নিউজ : এখন ব্যবসার পরিধি নিয়ে কী বলবেন?
দীপঙ্কর দাশ : চট্টগ্রামে প্রায় ১ লাখ বই স্টকে থাকে। বিক্রিও বেশ। আমার ধারণা সেরাদের মধ্যে আমরা রয়েছি। এত সংখ্যক বই দেশের অন্য কোনো দোকানে আছে বলে আমার জানা নেই। ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনে যে দোকানটি দিচ্ছি, তা চট্টগ্রামের পরিধিকেও ছাড়িয়ে যাবে। এখানে প্রায় দেড় লাখ বই রাখা যাবে।

জাগো নিউজ : প্রকাশনার সঙ্গেও জড়ালেন।
দীপঙ্কর দাশ :  হ্যাঁ, গত বছর থেকেই আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বই প্রকাশ করছি। বাতিঘর নামেই আমাদের প্রকাশনী। ২০০৯ সাল থেকে আমরা দুই একটি করে বই প্রকাশ করে আসছিলাম। তবে ২০১৬ সাল থেকে ব্যাপকহারে বই প্রকাশ করছি। ওই বছর অমর একুশে বইমেলায় আমাদের স্টল ছিল, এবারও স্টল রয়েছে।

জাগো নিউজ  : দোকান আর প্রকাশনী একই ব্যবস্থাপনায়?
দীপঙ্কর দাশ : বাতিঘর নামেই দোকান আর প্রকাশনী। তবে বিভাগ তো আলাদা। প্রকাশনার ব্যবসাও ভালো যাচ্ছে। যদিও ছোট পরিসরে করা। এ বছর ২৫টির মতো বই প্রকাশ করা হয়েছে।

জাগো নিউজ : প্রকাশনার সম্ভাবনা নিয়ে কি বলবেন?
দীপঙ্কর দাশ : ভালো সম্ভাবনা দেখছি। আমরা সিলেকটেড বই প্রকাশ করতে চাই। ইতোমধ্যেই বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে আমাদের প্রকাশনা। পাঠকের আস্থাও তৈরি হয়েছে।

জাগো নিউজ : ঘনঘন কলকাতায় যাচ্ছেন। সেটাও কি বইয়ের কাজেই?
দীপঙ্কর দাশ : হ্যাঁ। কলকাতা থেকে বই এনে আমরা বিক্রি করি। বাংলাদেশের বই কলকাতায় কিভাবে বাজার দখল করতে পারে, তার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কলকাতা থেকে যে পরিমাণ বই বাংলাদেশে আসে, সেই পরিমাণ বই কলকাতায় যায় না। এটি আমরা সবসময় বলি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নিজেদের বাজার নিজেদেরই তৈরি করতে হয়। আমি সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।

জাগো নিউজ : এটি কি আসলে উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপার? ভালো বই তো পাঠকই খুঁজে নেয়?  
দীপঙ্কর দাশ : আমি মনে করি, সবকিছুতেই পরিচিত বা উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপার থাকে। লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপন দেখেই এ দেশের লাখ লাখ মানুষ এটি ব্যবহার করে থাকেন। বইও তো এক ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত পণ্য।

জাগো নিউজ : কেমন সাড়া পাচ্ছেন সেখানে?
দীপঙ্কর দাশ : কলকাতায় বাংলাদেশের বইয়ের ভালো সম্ভাবনা আছে বলে আমার ধারণা। অনেকেই বলেন, চাহিদা অনুযায়ী সেখানে বাংলাদেশের বই পাওয়া যায় না।

জাগো নিউজ : লেখকদেরও দায় থাকে। একক প্রচেষ্টায় কতটুকু সফল হওয়া যায়?
দীপঙ্কর দাশ : এককভাবে কখনই সফল হওয়া যাবে না। আমাদের সঙ্গে লেখকরাও আছেন। প্রকাশকরাও আছেন। কলকাতায় আমার এক বন্ধু প্রকাশক আছেন। তাকে নিয়ে প্রকাশক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সকলের সহযোগিতা আছে বলে আমার বিশ্বাস।

জাগো নিউজ : ‘বাতিঘর’নামে কলকাতায় বইয়ের দোকান দেবেন কিনা?
দীপঙ্কর দাশ : এখন আমরা আইনগত দিক নিয়ে ভাবছি।  আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। অথবা কলকাতার কাউকে দিয়ে করানো যায় কিনা, সেটাও গুরুত্ব দিচ্ছি।

এএসএস/ওআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।