ওষুধের বিকল্প যখন খাবার
খাবার শুধু পেট ভরানোর উপকরণ নয়। এটি হতে পারে রোগ প্রতিরোধের ঢাল, আরোগ্যের পথ এবং দীর্ঘজীবনের চাবিকাঠি। আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞান ও চিকিৎসা গবেষণা বারবার প্রমাণ করেছে যে, সঠিক খাদ্যাভ্যাসই অনেক রোগের প্রতিষেধক ও প্রতিকার হতে পারে। ‘খাবার যখন ওষুধ’ কথাটি কেবল প্রবাদ নয়, এটি আধুনিক বিজ্ঞানের স্বীকৃত ধারণা। মানবদেহের সুস্থতা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকাংশে নির্ভর করে সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যের ওপর।
খাবারের বিভিন্ন উপাদান যেমন- ভিটামিন, খনিজ, প্রোটিন, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের কোষ মেরামত, রোগ প্রতিরোধ ও বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, ভিটামিন–সি ও ই শরীরকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে; ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়; আর আঁশযুক্ত খাদ্য হজম প্রক্রিয়া ও রক্তে শর্করার ভারসাম্য বজায় রাখে। আধুনিক ‘নিউট্রিশনাল সায়েন্স’ প্রমাণ করেছে, অনেক দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা ও ক্যান্সারের প্রাথমিক প্রতিরোধ খাদ্যের মাধ্যমেই সম্ভব।
চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন ‘ফাংশনাল ফুড’ বা ‘মেডিসিনাল ফুড’র ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। যা শুধু শক্তি জোগায় না বরং শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিসও বলেছিলেন, ‘সঠিক খাবারই হতে পারে শ্রেষ্ঠ ওষুধ।’ তাই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, সুষম ও সচেতন খাদ্যাভ্যাসই দীর্ঘস্থায়ী সুস্থতার মূল ভিত্তি।
খাদ্য ওষুধের বিকল্প
‘খাবার যখন ওষুধ’ ধারণাটি মূলত হিপোক্রেটিসের উক্তি থেকে এসেছে। আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক রোগের মূল কারণই অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। যেমন- ডায়াবেটিস টাইপ-২ অতিরিক্ত চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ হারায়। ট্রান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত লবণ ও কোলেস্টেরলসমৃদ্ধ খাবার হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি করে। কিছু খাবারে থাকা রাসায়নিক উপাদান বা সংরক্ষণকারী পদার্থ ক্যানসার সৃষ্টির ঝুঁকি বাড়ায়।
বিজ্ঞান যা বলে
বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, প্রোবায়োটিক, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ইত্যাদি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার শরীরের কোষকে সুস্থ রাখে, প্রদাহ কমায় এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। উদাহরণ- বেরি, ডার্ক চকোলেট; অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-কোষের ক্ষয় রোধ করে। মাছ, চিয়া সিড; ওমেগা-৩ ও হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। দই, কেফির; প্রোবায়োটিক ও হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। শাকসবজি, ফল ফাইবার; রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে।
আরও পড়ুন
সংসার চালানোর তাগিদ থেকে উদ্যোক্তা বগুড়ার কনক
শেয়াই পিঠা বাগেরহাটের শীতকালীন ঐতিহ্য
খাবারেই সুস্থতার চাবিকাঠি
রঙিন শাক-সবজি ও ফল: এগুলোতে থাকে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যেমন- গাজরে বিটা-ক্যারোটিন চোখের জন্য উপকারী।
পূর্ণ শস্য: ব্রাউন রাইস, ওটস, বার্লি এগুলো রক্তে কোলেস্টেরল কমায় এবং দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে।
বাদাম ও বীজ: আমন্ড, আখরোট, চিয়া সিড এগুলোতে থাকে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও প্রোটিন।
মসলা ও ভেষজ: হলুদে থাকে কুরকুমিন, যা প্রদাহ কমায়। আদা হজমে সহায়তা করে।
মানসিক স্বাস্থ্যে খাবারের প্রভাব
খাবার শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে। ওমেগা-৩, ভিটামিন বি১২, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি উপাদান মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা কমাতে সাহায্য করে।
খাবার যখন বিষ
প্রক্রিয়াজাত খাবারে থাকে অতিরিক্ত সোডিয়াম, চিনি ও কেমিক্যাল। রেড মিট ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। সাদা চিনি ও ময়দা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করে।
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস
প্রতিদিন অন্তত ৫ রকমের ফল ও সবজি খান। প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন। পর্যাপ্ত পানি পান করুন। নিয়মিত খাবার গ্রহণ করুন, না খেয়ে থাকবেন না। চিনি ও লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। খাবার যখন ওষুধ এ ধারণা শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি একটি জীবনদর্শন। সঠিক খাদ্য নির্বাচনই হতে পারে সুস্থ জীবনের মূলমন্ত্র। বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি আজকের দিনে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
‘খাবার যখন ওষুধ’ ধারণাটি প্রমাণ করে, পুষ্টিকর খাদ্যই সুস্থ জীবনের মূল ভিত্তি। বৈজ্ঞানিকভাবে দেখা গেছে, সুষম খাদ্যের উপাদান যেমন- ভিটামিন, খনিজ, প্রোটিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং কোষের ক্ষয় রোধ করে। উদ্ভিদজাত খাবারে থাকা ফাইটোকেমিক্যাল উপাদান হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
অতএব, প্রাকৃতিক ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিয়মিত গ্রহণ করলে তা শুধু শরীরের শক্তি জোগায় না বরং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ খাবারই হয়ে ওঠে জীবনের প্রকৃত ওষুধ।
এসইউ/জেআইএম