বিশ্বজুড়ে বিড়াল নির্যাতনকারীদের ভয়াবহ নেটওয়ার্ক, বর্বর সব কাণ্ড

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৫৩ পিএম, ০৪ আগস্ট ২০২৫
ছবি: এএফপি

বিড়াল ও বিড়ালছানার ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি আন্তর্জাতিক চক্রে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি। এই গোপন নেটওয়ার্কে রয়েছে হাজার হাজার সদস্য, যারা নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে, বিক্রি করে এমনকি, কখনো কখনো নিজেরাই এসব ছবি ও ভিডিও তৈরি করে থাকেন।

একটি এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপে গঠিত গ্রুপে বিবিসি এমন কথোপকথনের সন্ধান পেয়েছে, যেখানে ব্রিটিশ সদস্যরা বিড়ালছানা দত্তক নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন শুধু নির্যাতনের জন্য। তাদের কেউ কেউ যুক্তরাজ্যের প্রাণিসংরক্ষণ সংস্থা (আরএসপিসিএ) থেকে বিড়ালছানা নিয়ে সেগুলো বিকলাঙ্গ করার পরামর্শ দিচ্ছিলেন।

এই অনুসন্ধান এমন এক সময় সামনে এলো, যখন উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের রুইসলিপে দুটি বিড়ালছানাকে কেটে ঝুলিয়ে রাখার অভিযোগে দুই কিশোর আদালতে দোষ স্বীকার করেছে। ঘটনাস্থল থেকে ছুরি, ব্লোটর্চ ও কাঁচি উদ্ধার করে পুলিশ। এই অপরাধের দায়ে সোমবার (৪ আগস্ট) ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরী ও ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরের শাস্তি ঘোষণা করা হবে।

তদন্তকারীদের ধারণা, এই কিশোরদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিড়াল নির্যাতনকারী চক্রের সংযোগ থাকতে পারে। যারা পরিকল্পিতভাবে নির্যাতনের ভিডিও বানিয়ে তা গোপন অ্যাপে বিক্রি করে থাকে।

বিবিসি বলছে, এই চক্রটির মূল উৎপত্তি চীনে হলেও এখন তা বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশেই এর সক্রিয় সদস্য রয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।

প্রাণী অধিকার সংগঠন ‘ফিলাইন গার্ডিয়ানস’ জানায়, ২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত প্রায় প্রতি ১৪ ঘণ্টায় একটি করে বিড়াল নির্যাতনের ভিডিও অনলাইনে প্রকাশ পেয়েছে। সংগঠনটি চলতি বছরে এমন ২৪টি সক্রিয় গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে, যার মধ্যে একটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। সবচেয়ে সক্রিয় নির্যাতনকারী একাই ২০০টির বেশি বিড়াল নির্যাতন ও হত্যা করে ভিডিও আপলোড করেছেন বলে দাবি সংগঠনটির।

বিবিসি যেসব গ্রুপ পর্যবেক্ষণ করেছে, সেগুলোর কথোপকথনে যুক্তরাজ্যের অবস্থান শনাক্ত করা অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে, যারা বিড়াল কিনে কিংবা দত্তক নিয়ে নির্যাতনের পরিকল্পনা করছিল। একটি চ্যাটে এক সদস্য আরএসপিসিএ-তে বিড়াল দত্তকের আবেদনপত্র শেয়ার করে। আরেকজন যুক্তরাজ্যে বিড়াল বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে লেখেন, আমি ওদের খুব কষ্ট দিতে চাই।

ফিলাইন গার্ডিয়ানসের স্বেচ্ছাসেবক লারা (ছদ্মনাম) বলেন, প্রতিদিনই আমার হৃদয় ভেঙে যায়। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন আমি না কাঁদি। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে গ্রুপগুলোতে ছদ্মবেশে কাজ করেছেন। তার অভিজ্ঞতায়, নির্যাতনকারীদের নিষ্ঠুরতার কোনো সীমা নেই।

বিবিসির দেখা ভিডিওগুলো এতটাই ভয়াবহ যে সেগুলো প্রকাশ উপযোগী নয়। এসব ভিডিওতে দেখা যায়, বিড়ালকে পানিতে ডুবিয়ে মারা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হচ্ছে। একটি ভিডিওতে একটি খাঁচাবন্দি বিড়ালছানাকে না খাইয়ে রাখলে কত দিন বাঁচবে, তা পরীক্ষা করা হচ্ছে।

গ্রুপের সদস্যরা নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে কষ্ট দীর্ঘায়িত করতে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে বিড়ালকে অজ্ঞান ও ফের জাগিয়ে তুলছে। নতুন সদস্যদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা নিজেরা বিড়াল নির্যাতনের ভিডিও বানিয়ে গ্রুপে পোস্ট করেন। এর মাধ্যমে আরও বড় গোপন নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়।

আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, এসব গ্রুপে শিশুদের অংশগ্রহণের প্রমাণও পাওয়া গেছে। এক সদস্য লিখেছে, আমি ১০ বছরের, আমি বিড়াল নির্যাতন করতে ভালোবাসি।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই নেটওয়ার্কে ‘১০০ বিড়াল হত্যা প্রতিযোগিতা’ নামে একটি চ্যালেঞ্জ আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে কত দ্রুত ১০০টি বিড়াল নির্যাতন ও হত্যা করা যায় তা দেখাতে সদস্যদের আহ্বান জানানো হয়েছিল।

চীনে প্রথম ২০২৩ সালে এমন ভয়াবহ ভিডিও ভাইরাল হয়। দুটি ভিডিওর জন্য দায়ী ব্যক্তি ওয়াং চাওয়ি মাত্র ১৫ দিনের জন্য আটক হয়েছিলেন ও ‘অনুতাপপত্র’ লেখার পর তাকে ছাড় দেওয়া হয়। কিন্তু তার ভিডিওর জনপ্রিয়তা এমন জায়গায় পৌঁছে যে, পরবর্তী সময়ে আরও অনেকেই চীনা ও পশ্চিমা সামাজিক মাধ্যমে অনুরূপ কনটেন্ট বানাতে শুরু করেন। পরে এই চক্র গোপন মেসেজিং অ্যাপে স্থানান্তরিত হয়।

এমনকি, একটি ওয়েবসাইট নিজেদের ‘বিড়ালপ্রেমীদের কমিউনিটি’ বলে দাবি করে, অথচ তারা বিড়াল নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত। এই ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীদের ‘নিজের কাজ জমা দেওয়ার’ আহ্বান জানানো হয়। সেখানে প্রবেশাধিকার পেতে হলে ব্যবহারকারীকে বিড়াল নির্যাতনের প্রমাণ দেখাতে হয়।

এদিকে, এই নির্যাতন চক্রে ‘লিটল উইনি’ নামে কিছু অ্যাকাউন্টের নাম শোনা যায়, যেগুলোতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ব্যঙ্গচিত্র হিসেবে ‘উইনি দ্য পুহ’র ছবি ব্যবহার করা হয়। এসব অ্যাকাউন্ট অনেক গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবেও রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফিলাইন গার্ডিয়ানসের একজন অ্যাকটিভিস্ট ‘লিটল উইনি’ নামে একটি অ্যাকাউন্টের মালিকের সঙ্গে অনলাইনে সম্পর্ক গড়ে তোলেন ও ভিডিও কলের মাধ্যমে তার পরিচয় শনাক্ত করেন। ওই ব্যক্তি জাপানের টোকিও শহরে বসবাসকারী ২৭ বছর বয়সী একজন পুরুষ। তবে বিবিসির কাছে তিনি বিড়াল নির্যাতনকারী নেটওয়ার্কের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন।

ফিলাইন গার্ডিয়ানস এরই মধ্যে লন্ডনে চীনা দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছে। চীনে এই ধরনের নির্যাতন ঠেকাতে কার্যকর কোনো আইন নেই। ফলে অপরাধীরা আইনের ভয় ছাড়াই এমন নির্মম কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই ভয়াবহ ও নৃশংস নেটওয়ার্ক শুধু পশুদেরই নয়, সমাজের জন্যও বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। মানবিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার এই জঘন্য প্রবণতার বিরুদ্ধে এখনই বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরকারের কড়া আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন প্রাণী অধিকারকর্মীরা।

সূত্র: বিবিসি

এসএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।